নারায়ণগড়ের শবর শিল্প
মধু নায়েক এক আপূর্ব শিল্পী। মহাশ্বেতা দেবীর কল্যাণে
আমরা জেনে গিয়েছি, লোধা-শবর শিল্পীরা ঘাস আর খেজুর পাতা দিয়ে কী না করতে পারেন।
দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। ঘাসের টুপি, নানা কৌটো, কলম দানি, মাথার কাঁটা
আরও কতকী তৈরি করেন তাঁরা শুধুই নিজেদের দক্ষতায়। খড়্গপুর-দীঘা রাস্তায় খড়গপুর
যেতে পড়ে নারায়ণগড়। সেখানে থাকে ট্রেকারে ১০ কিমি মধু নায়েকের মার্কুণ্ডা গ্রাম। স্ত্রী রূপালীর সঙ্গে মিলে হাতে হাতে তার জাদু মাখা শিল্প আর মাথায় অপূর্ব
সৃষ্টির প্রেরণা। যে কোনও মেলায় মধু সংগঠনের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
গয়না বড়ি
যে কথা না বললে মেদিনীপুরের পরিচিতি শেষ হতে পারে না
সেটি হল মেদিনীপুরের গয়না বড়ি। যে মেদিনীপুরের বিশাল সংস্কৃতি, বাংলার তথাকথিত
মূলধারার সংস্কৃতির সঙ্গে প্রায় বিচ্ছিন্ন, ফলে সেখানেও কলকাতার ঠাঁই নেই বল্লেই
চলে, সেই উপকূলীয় সংস্কৃতির অংশ মেদিনীপুরের গয়না বড়িকে সত্যজিৎ রায় ঠাঁই দিয়েছেন
তাঁর চলচ্চিত্রে। সারা মেদিনীপুর জুড়েই গয়না বড়ির চল; কিন্তু দক্ষতা ব্যবসাকে
কিছুটা মেলাতে পেরেছেন গেঁয়োখালি মহিষাদল তমলুকের নারীরা যারা একদা হাতে ঝাণ্ডা
ধরে তমলুক স্বাধীন করেছিলেন, তারাই আজ তৈরি করছেন চিক্কন গয়না বড়ি।
লেখকের ছোটবেলা যেহেতু উপকূল মেদিনীপুরে কেটেছে, তাঁর
স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল রয়েছে শীতের দিনে দেওয়া গয়না বড়ি। আগের রাত্রে বিউলির ডাল
বেটে রাখা হত। মা দিদিমারা সকালে স্নান করে, পরিষ্কার কাচা কাপড়ে, শুদ্ধ হয়ে এবারে
শীতের সকালের ওম গায়ে মেখে সেই মিহি করে বাটা ডাল ফেঁটাতে বসতেন। সত্যি সত্যি কয়েক
ঘন্টা ধরে ফেঁটানো হত সেই বিউলির ডাল। ফেঁটানোর কাজ যত ভাল হবে, বড়ি তত হালকা,
নরম, ভাজলে কুড়কুড়ে হবে। ন্যাকড়ায় তেল নিয়ে, সেই তেল মিহি করে বিশাল কাঁসার বুলিয়ে
নেওয়া হত এমন ভাবে যাতে থালায় সেই বুলোনো তেলের রেখা চোখে না পড়ে। আর এক দল প্রায়
অদক্ষ, কাজ শেখার জন্য গোলগল চোখে মা দিদিমা পিসিমার কাজ দেখা কচিকাঁচাদের কাজ ছিল
সেই থালায় পোস্ত ছড়িয়ে বুলিয়ে দেওয়া – তবে সেই পোস্ত সমান ভাবে ছড়াতে হবে যাতে
থালাটি না দেখা যায়।
আগে থেকেই রুমালের আকারের একটি শুকনো ন্যাকড়ায় ছোট্ট
ফুটো করে সেই ফুটোর চার পাশে হাতে সেলাই করে নেওয়া হত। সেই ন্যাকড়ায় ফেঁটানো
ডাল নিয়ে মা দিদিমা পিসিমা মাসিমারা গোল হয়ে বসে, রোদের দিকে পিঠ করে নিজের নিজের
থালায় গয়না বড়ি দিতেন। এ সময় ছোটদের হাতে থাকত পরিষ্কার নারকেল পাতার কাঠি। চিক্কন
বড়ির প্যাঁচ শেষ হয়ে গেলে সেই ন্যাকড়া থেকে বেরিয়ে আসা ডালের মিশ্রণকে কেটে দিয়ে
সেই বাকি অংশটিকে দক্ষ হাতে মিলিয়ে দিতে হত সেই প্যাঁচের সঙ্গে যাতে কোথায় বড়ি
দেওয়া শুরু হয়েছে আর কোথায়ই বা শেষ হয়েছে, সেটি বোঝা না যায়। তবে বড়িগুলি রোদ
পাওয়া ভীষণ জরুরি। কয়েকদিন মেঘলা হলেই চিত্তির। বড়ি আর নরম হবে না, ছাতা ধরে যেতে
পারে।
মুশকিল হল গয়না বড়ি, আন্যান্য গ্রাম শিল্পের মতই খুব বেশি বানানো যায় না। সহজে ভেঙে যায় ফলে
পরিবহনে অসুবিধা। আর ওজনে
তুলনামূল্কভাবে ভারি করার জন্য খুব সহজে চালের গুঁড়োরমত আরও অনেক কিছু মিশেল দেওয়া
যায় যা কেনার সময় অনভ্যস্ত চোখে আভাস না পাওয়া যায়। ফলে সাধু সাবধান অন্তত মেলা
থেকে সুন্দর সুন্দর দেখতে গয়না বড়ি কেনার সময়। খুব সুন্দর সাদা সাদা দেখতে হলে না
নেওয়াই বুঝবেন তাতে অবশ্যই চালের গুঁড়োর মিশেল আছে, ভাজলেই শক্ত হয়ে যেতে পারে আর
প্রার্থিত স্বাদ নাও মিলতে পারে। একটু হলুদ হলুদ আভা থাকলে কিনুন। চালের ভাগ কম আছে। এখন
পোস্তর দাম বেড়েছে
বহু গুণ, আনেকেই পোস্তর বদলে তিল ব্যবহার করছেন। ঘাবড়াবার কারণ নেই। খেতে অতটা
সুস্বাদু না হলেও ফ্যালনা নয়। ভাল লাগবে।
বিনপুর-শিলদা-বেলপাহাড়ির পাথর শিল্প
এলাকার মিস্ত্রী উপাধিধারী পরিবাররা পাথর কেটে নানান
ধরণের তৈজস বানান। এগুলির বেশ চাহিদাও আছে। আজও বাংলার ঘরে বিশেষ করে পুজোর ঘরে হয়
কাঁসা-পিতলের অথবা পাথরের বাসন ব্যবহার হয়। তাই হয় শুশুনিয়ার পাথর শিল্প অথবা বিনপুর-শিলদা-বেলপাহাড়ির পাথর শিল্পই ভরসা।
বেলনচাকি থেকে শুরু করে ধুপ, মোম দানি, চন্দনপিড়ি, পাথরের শিবলিঙ্গ, নানান ধরণের
বিশেষ করে সসন্তান দুর্গা মূর্তি তৈরি করেন। কলকাতা থেকে ঝাড়্গ্রাম। সেখান থেকে ৩০
কিমি দূরে মালাবতীর জঙ্গল পার হয়ে শিলদা মোড়। সেখান থেকে আরও কিছুদূর গেলে
বেলপাহাড়ী।
তবে এই এলাকায় যদি আসেন তাহলে অবশ্যই লালজল গ্রামে
যাবেন। বেলপাহাড়ী থেকে বাঁশপাহাড়ীর রাস্তায় পড়বে লালজল মোড়। সেখনা থেক ২ কিমি গেলে
লালজল গ্রাম। দেওপাহাড়ে রয়েছে আদিম গুহা। দেওয়ালে খোদাই করা বেশ কিছু ছবি। আর যাবেন ডুলুং পেরিয়ে চিল্কিগড়ের স্বর্ণদুর্গা।
এই নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছে। তাই আর বেশি কথা বাড়ালাম না। শুধু মনে করিয়ে দেওয়া
গেলমাত্র।
No comments:
Post a Comment