পট
মাদুরের মত দুই মেদিনীপুরের আন্যতম বড় রপ্তানি আর
পরিচিতি হল পট আর পটুয়া। পটুয়াদের গ্রামে কোন পরিবারে পাশপোর্ট নেই গুনতে গেলে
হতাশ হতে হবে। বাংলায় দুটি প্রধান পটুয়া গ্রাম - পাঁশকুড়া বা বালিচক স্টেশন থেকে
নয়া আর কলকাতা-দীঘা রাস্তায় চণ্ডীপুর থেকে নন্দীগ্রামের দিকে যেতে হাঁসচড়া। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাত ধরে নয়ার প্রত্যেক বাড়ি এখন ছবির মত
সেজে উঠেছে। রাণী বা মধু বা বাহার চিত্রকরের মত বহু শিল্পী একবার না
একবার বিদেশ গিয়েছেন। দেশেও তাঁদের কাজের চাহিদা তুঙ্গে। ছাতা, হাঁটার লাঠি, ঘর
সাজানো কুঁজো, দৈনন্দিনের যা কিছু ব্যবহার্য, সব কিছুর ওপরে তাদের হাতের কাজের
চাহিদা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। শৌখিন মানুষেরা তাঁদের বাড়ির দেওয়াল আঁকিয়ে নেন
পটুয়াদের দিয়ে নানান লৌকিক কাহিনী। বিভিন্ন পজো মণ্ডপে তাদের চাহিদাও দিনের পর দিন বাড়ছে।
এঁরা যে কোনও গ্রাম সংস্কৃতির মত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে
চলতে পারেন। নয় এগারোর প্রেক্ষিতে লাদেন পট, যে কোনও বড় বন্যার পরে বা সংসদে হানার
মত বড় ঘটনার প্রেক্ষিতে এঁদের কাজ এক সময়
বেশ বিকিয়েছে। এবং এগুলিই বাংলার গ্রাম সংস্কৃতির বেঁচে থাকার রসদ, তাঁরা কয়েক
হাজার বছর ধরে সারা বিশ্বের নানান বিষয়ের সঙ্গে জুড়ে থেকেছেন। চলতি নানান ইস্যুতে তাঁদের তীর্যক মন্তব্য শিল্প রসিকদের দৃষ্টি এড়ায় নি। এছাড়াও মঙ্গল কাব্যের নানান পালা
নিয়ে তাঁরা ছবি আঁকেন এবং গান তৈরি করেন। আজকাল আবার সরকারী নানান প্রচারে তাঁরা
নতুন নতুন ধরণের সামাজিক অভ্যেস তৈরি করার গান বাঁধছেন। মহান্ত আর এলোকেশীর ঘটনা
নিয়ে প্রচুর ছবি এঁকেছেন কালিঘাটের পটুয়ারা। বৌদ্ধ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সব
রাজত্বেই তাঁরা সমান নিজস্ব ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর। সোমবার ছাড়া যে কোনও দিন ঠাকুরপুকুরের গুরুসদয় সংগ্রহশালায় বাংলার প্রচুর প্রাচীন পটের নিদর্শন দেখা যেতে পারে। আর যাওয়া যেতে পারে
দুটি গ্রামে।
বাংলার চিত্রকলার এক বিশিষ্ট অঙ্গ পট। কমকরে আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য তাদের। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বৌদ্ধ আমলের বাংলার ঘটনা, বেনের মেয়ে উপন্যাসে যে
মস্করীদের কথা বলেছেন, তাঁরা আদতে সেকালের পটুয়া। দীনেশ চন্দ্র সেন বৃহৎবঙ্গএ
বলছেন বৌদ্ধ আমল থেকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় যে সব মহাযানী বৌদ্ধ মঠ তৈরি হয়েছে, সেই
সব মঠে বাংলার পটুয়াদের পট তৈরির পদ্ধতিতে দেওয়ালের গায়ে ছবি আঁকন হয়েছে। লেখককে তাঁর
এক গুণী বন্ধু, পেদঙ্গের গুম্ফার ছবিগুলো নতুন করে ঢেলে সাজের সময় দাঁড়িয়ে দেখেছেন,
২০০০ বছর আগের পদ্ধতিতে দেওয়াল আঁকার যোগ্য ক্রা হচ্ছে। আদতে অবিকল পটুয়াদের পট
তৈরির পদ্ধতিতে দেওয়াল তৈরি করে ছবি আঁকা হচ্ছে।
দীনেশ সেন মশাই বলছেন পটুয়াদের পূর্বপুরুষ মস্করী উপাধিধারী বৌদ্ধ ভিক্ষু। সপ্তম শতকের প্রথম দিকের
বাণভট্টের 'হর্ষচরিত'এ যমপট
ব্যবসায়ীদের উল্লেখ আছে। রাজা হর্ষবর্ধণ একজন পটুয়াকে
কতকগুলো ছেলেদের মাঝে বসে পট বোঝাতে দেখেছিলেন। আট
শতকের রচিত বিশাখাদত্তের মুদ্রারাস নাটকে কালিদাসের 'অভিজ্ঞান
শকুন্তলম্' ও মালবিকাগি্নমিত্র' নাটক, ভবভূতির উত্তররাম রচিত এবং ভট্ট রচিত হরিভক্তি বিলাস' পটচিত্রের বিষয়ে বিভিন্ন উল্লেখ রয়েছে। পটিদারেরা বুদ্ধের সময় হতে পটচিত্র এঁকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতেন। বাংলার মাস্করীদের নাম পটীদার। অত্যাচারিত পটুয়ারা
অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের পূর্ব পুরুষের বৃত্তি আঁকড়ে ধরেছিলেন,
এখন তাঁরা না মুসলমান না হিন্দু।
No comments:
Post a Comment