এক ব্যতিক্রমী মহিলার কথা বলা দরকার
এখানে। এক সময় লৌকিক বাঙলায় প্রবাদ ছিল চাষ করতে আর তাঁত চালাতে না পারলে বাঙালির মেয়ের বিয়ে হয় না। মালদার গঙ্গা পেরিয়ে দিনাজপুরে, এই বাক্যটাই ঈষদ পাল্টে বলা হয়, ধোকড়া বোনা, চাষের কাজ আর বাঁশের শিল্পকর্ম না জানলে গ্রামীণ মেয়ের বিয়ে হওয়া মুশকিল।বাঙলার পারম্পরিক বাঁশের কাজের শিল্পী শান্তি বৈশ্য নিজের জীবন সংগ্রামে শুধু এই প্রাচীণ বাঙালি প্রবাদটি সত্যি প্রমাণ করেন নি, বাঁশের কাজ করে আজও নিজের সংসার প্রতিপালন করেন অপরিসীম প্রাত্যহিকতায়।
বিবাহসূত্রে স্বামী সেল্টু বৈশ্য থাকতেন শ্বশুর বাড়িতে, স্ত্রী শান্তির ভিটেতেই। বিশ্বায়ণ আর শহুরে রাজনীতির প্রভাব যখন মহামারীরমত ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম সমাজে, তখন দুই দিনাজপুরে এই ভঙ্গুর সময়েও বাঙলার সাম্যবাদী তন্ত্র সভ্যতার নানান রেশ জড়িয়ে রয়েছে সমাজের স্তরেস্তরে। ঘরজামাই কথাটির চল থাকলেও, কথাটিতে শহুরে পুরুষতান্ত্রিকতার মরণ কামড় নেই।শান্তির স্বামী সেই এলাকায় দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যবহার হওয়া নানান ধরণের বাঁশের দ্রব্য তৈরি করতেন। বাল্যাবস্থা থেকেই শান্তি বাঁশের কাজ করতেন। দুজনে মিলে তৈরি করতেন বিয়ের ডালা, বিয়ের ফুল রাখার রঙিন বরণ ডালা, সাদা ও রঙিন কুলো, মুড়ি ভাজার চালন, ভাত গড়ানো আর তরকারি রাখা ঝুড়িরমত বাঙলার নিজস্ব গড়নশৈলীওয়ালা অসংখ্য দ্রব্যাদি।
শান্তির জীবন চমক বিহীন। শহুরে ভেজালময় জীবনযাত্রার পক্ষে বড্ড বেশি নিস্তরঙ্গ শান্তির জীবনযাত্রা। শান্তি তাঁর শিল্পদ্রব্য জেলা অথবা রাজ্য অথবা জাতীয় স্তরে প্রতিযোগিতার জন্য পাঠান নি। শান্তির খেদ নেই।অথচ তাঁর কাজে
এতটাই শান্তি যে কলকাতার মেলায় তাঁর গতানুগতিক কাজ বিকিয়ে যায় চট করে।
শান্তি নিভৃতে পুজোরমত আজও বয়ে নিয়ে চলেন বাঙলার পারম্পরিক শিল্প সম্ভার, নিজেরমতকরে পারম্পরিক শিল্পীদের বিনম্রতায়, মাথা নিচু করে কাজ করে চলেন শ্রীমতী নদীর ধারে ফতেপুর-কালিয়াগঞ্জ রাস্তার ধারেই ঊষাহরণে, নিজের ভিটায়। এধরণের হাজারো শান্তির প্রাত্যহিকতায়
এই লুঠেরা সময়ে বিশ্রান্তিহীনভাবে বয়ে চলেছে অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুরের নানান
সাংস্কৃতিক প্রবাহমানতা। সন্ধ্যের টিভির ফর্সা হওয়ার বিজ্ঞাপন থেকে মোবাইলের নীল
ছবি কোনোটাই বদলাতে পারেনি রাজবংশী সমাজের আক্ষদণ্ডকে।
এছাড়াও রাজবংশীদের সমাজে নানান আচার আচরণে কাঠের
আর শোলার মোখা বা মুখোশ আজও প্রচলিত রয়েছে। বিভিন্ন উপাচারে এদের ব্যবহার করা হয়।
কখনও মুখোশ পরে নাচের কাজে – যার নাম গমীরা নৃত্য আর কখনো মুখোশ উতসর্গ করার কাজে।
অপূর্ব সব আকারের দেবতার, দেবীর মুখোশ তৈরি করেন রাজবংশীরা। কিছু কিছু হয় এক রঙা,
কিছু কিছু হয় বহু রঙা। দেবতাদের থেকে দেবীদের রমরমা বেশী। মনসা, কালী, চামুণ্ডা,
তারা, উগ্রতারার মূর্তির সঙ্গে নতুন সময়ের বৈষ্ণব ধর্মের হনুমানের মুখোশ আপনাকে
মুগ্ধ করবেই। মুখোশ যেমন প্রাচীন আকারের তেমনি প্রাচীন মুখোশ দেখলে মনে হবে যেন
এক্কেবারে আধুনিক মুখোশ দেখছেন।
No comments:
Post a Comment