একটি বেশ মানী ও নামী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যত না খুবই
পরিচিত এবং কালকেই মারা যাবে না এমন কিছু হস্ত ও অভিকর শিল্পের সঙ্গে কাজ করে
প্রচুর যশ অর্থ কুড়িয়ে নাম কিনতে ইচ্ছুক, কিন্তু এদের মত প্রায় মৃত্যুর দিকে প্রায়
ঢলে পড়া শিল্পের সঙ্গে কাজ করতে কেন দ্বিধা? কেন দ্বিধা?
শুধু ভাবনা ভাবলে, গ্রন্থাগারে বসে, বা দু একদিন
সাংবাদিকতাঁর মত এঁদের গ্রামে ঘুরে ওপর ওপর উতসাহে প্রকল্প সমীক্ষা তৈরি করলে কেন
এদের বিক্রি কমলর মত সহজ উত্তরে আসা যায় না। একটি সহজ উদাহরণ হতে পারে আজ শহুরে
অনেকের বাড়িতে বাড়িতে স্টিলের তৈজস। বাপ দাদাদের সময়ের কাঁসা পিতলের হাঁড়ি কুঁড়ি থালা বাটির
স্থান হয়েছে বিয়ের সময়ে পাওয়া সিন্দুকে। বুকে হাত দিয়ে বলুন তো নতুন করে কাঁসা
পিতলের জিনিস বিগত পাঁচ বছরে কেই বা কিনছেন? দামও হুহু করে বেড়েছে কাঁচামালের। দাম
বাড়াতো প্রত্যেক শিল্পের বড় সমস্যা। তাহলে এদের অবস্থা এত দুঃসহ কেন? মনে রাখতে
হবে গ্রামে এখনও কিন্তু কাঁসা পিতলে খাওয়ার চল কমে নি। নিম্নবিত্ত পরিবারে এগুলি
এখনও দুঃসময়ের সম্পদ হিসেবে ধরা হয়। তাই অর্থ পেলেই গ্রামের মানুষ সোনা না কিনে
কাঁসা-পিতল কেনেন। আজও।
গুরুশিল্পী কালিপদ রাণা চোখের জলে চমকে দেওয়ার মত অন্য
উত্তর দিলেন। বলছিলেন একদা তাঁদের গ্রামের শিল্প দ্রব্য কাঁধে আসীম গর্বে নিয়ে
ফেরিওয়ালারা সারা পূর্ব ভারতের গ্রামে গ্রামে মেলায় মেলায় ঘুরতেন। চন্দনপুরের শিল্প দ্রব্য বিক্রি করতে তাদের খুব একটা মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে
হত না। ফেরিওয়ালারা আর ঘোরেন না – বলা ভুল হল, ঘুরতে পারেন না। কেন? সঙ্গত
প্রশ্ন। বিক্রি হয় না কী? না সেই বিক্রেতাদের দিন গিয়েছে? কালিপদ উত্তর দিলেন
অদ্ভুত রকম একটা।
উৎপাদক বিক্রেতার সম্পর্কের বিষয়টি দাঁড়িয়েছিল বহু কালের
সম্পর্কের চওড়া শক্ত ভিতের ওপরে। কোনও লেখাপড়া ছিল না উতপাদক আর বিক্রেতাদের মধ্যে। মৌখিক অঙ্কে আর সুচারু স্মৃতিতে শয়ে
শয়ে বছর ধরে কাজ হয়েছে বংশ পরম্পরায়। কোনও বাধা দেখা যায় নি। বরং দিনে দিনে কাজ
বেড়েছে গ্রামের পরিবারগুলোর। পূর্ব ভারত জুড়ে চন্দনপুরের কাঁসার তৈজস আর মূর্তির
চাহিদা তৈরি করেছেন এঁরা অদম্য উতসাহে।
আজ স্বাধীন ভারতে সেই ফেরিওয়ালাদের আস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে
পড়েছে সরকারি লাল ফিতের বেড়াজালে। ফলে বিপন্ন আজ উৎপাদকেরাও। এক রাজ্য থেকে অন্য
রাজ্য যেতে গেলে ফেরিওয়ালাদের থেকে সরকারি আধিকারিকরা কাগজ দেখতে চান। অক্ষর না
জানা বিক্রেতারা তার কিছুই দেখাতে পারেন না সর্বশক্তিমান ভারত রাষ্ট্রের কর্তাদের।
তাদের জিনিস চোরাই মাল বলে কেড়ে নিয়ে রেখে দেওয়া হয়। অথচ এই মানুষদের হাত ধরে অসম,
ওডিশা, বিহারের ঘরে ঘরে কয়েক শ বছর ধরে বিক্রি
করার কাজ করে ছিলেন এই ফেরিওয়ালারা। ব্রিটিশের
বাংলার কচুকাটা বিশিল্পায়নের কালাপাহাড়ি থেকে উপকূল মেদিনীপুরের চন্দনপুরের কাঁসার
শিল্পীরা বেঁচে গেলেও স্বাধীনতার পর ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া উদ্গারের উত্তরসূরীরা
কিন্তু শেষ দেখে ছাড়লেন বাংলার গ্রাম শিল্পগুলোর। হাজারো শিল্পের মত নাভিশ্বাস ওঠল
চন্দনপুরের।
সরকারি কর্পোরেট ভজনা আর শহুরে ক্রেতাদের উদাসীনতা নিয়েই
আজও না মরে কোনোমতে বেঁচে রয়েছেন চন্দনপুরের একদা দৌর্দ্দণ্ডপ্রতাপ শিল্পীরা। কেউ
নিজের বাপ দাদার বৃত্তি ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে মোবাইল সারাইএর দোকান, কেউবা অদক্ষ
হাতে আর পরিকল্পনায় পান বরজের মত ঝুঁকির কাজে দৌড়চ্ছেন। বরজে জল ঢালতে ঢালতে মনে
কিন্তু ধুকপুক করছে সেই স্বপ্ন কখন ঢালাই হবে কখন ভাটির পাশে তেতে ওঠা গরমে বসে
সন্তানসম দ্রব্যগুলি তৈরি করবেন তিনি। রাষ্ট্র বোধহয় কালিপদদের সেই সুযোগ আর দেবে না।
সরকারের কাছে তাদের একটাই দাবি ভিক্ষে চাই না মা কুকুর
সামলাও।
No comments:
Post a Comment