আজ আমরা প্রাচীন ভারতের কাঁচ তৈরির প্রযুক্তি বিষয়ে
আলোচনা করব। বিশেষ করে ৬০০ থেকে ২০০ খৃস্ট
পুরবাব্দ পর্যন্ত সময় ধরে অর্থাৎ গুপ্ত রাজেদের সময়ে। এই সময়ের রাজঘাট এবং
সায়াদপুর ভিতরি এলাকায় উৎখননের সময় বেশ কিছু কাঁচের পুঁতি পাওয়া যায়। কাঁচের ধর্ম
নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে(সি এইচ গ্রিন, গ্লাস, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ১৯৬১)।
কাঁচের বর্ণনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি একটি চতুর্থ অবস্থার পদার্থ/বস্তু, যেখানে
ক্রিস্টালের কাঠিন্যও রয়েছে, আর রয়েছে তারল্যের মত র্যান্ডম মলিকুলার স্ট্রাকচার।
এটি ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম এবং অন্যান্য ধাতুর সিলিকাটেসের শক্ত কিন্তু খুবই ভঙ্গুর
মিশ্রণ। এটিকে একসঙ্গে সেরামিক, ধাতু এবং নমনীয় প্লাস্টিকও বলাচলে। প্রায় প্রত্যেক
সভ্যতায় কাঁচ তৈরি হয়েছে, এবং এটি সেযুগের বেশ উচ্চ প্রযুক্তির নিদর্শন বলা যায়। এতগুলো
প্রশ্নের সঙ্গে আরও কয়েকটি আলোচনা খুবই উল্লেখ্য। প্রযুক্তির ঐতিহাসিকদের সঙ্গে
এবং প্রত্নতাত্বিকেরাও বলছেন সে যুগের তৈরি অনেক ধরণের কাঁচএর নিদর্শন আজকে নকল
করা সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় জং ছাড়া লোহা তৈরির উদ্যম। তাই এই মানুষেরা সে যুগের
কাঁচ তৈরির পদ্ধতি, তার উপকরণ এবং কোন আরথ-সামাজিক স্তরে কি ধরণের কাঁচ ব্যবহার হত
সেই প্রশ্ন পেতে তারা ইচ্ছুক।
আজকের দিনে আমাদের যে কাঁচ তৈরি পদ্ধতি রয়েছে, তাতে যে
মূল তিনটি উপাদান প্রয়োজন হয় সেগুলি হল কোয়ার্টজ(সিলিকা), সোডা, এবং চুন। যখন
এগুলির মিশ্রণকে ১২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে উত্তপ্ত করা হয়, তখন এগুলি গলতে শুরু
করে এবং তৎক্ষণাৎ যদি ঠাণ্ডা করা যায় তাহলে কাঁচের জন্ম হয়। আর ঠাণ্ডা করার সময়
যদি বেশি লাগে, তাহলে কোয়ার্টজের দানা(ক্রিস্টাল), সোডিয়াম ডিসিলিকেট (Na2Si2o5) এবং কিছু অন্য ডেরিভেটিভ (Na2.3CaO.6SiO2) উতপন্ন হয়। আমরা বিশ্বাস করি অতীতে যারা কাঁচ তৈরি
করতেন, তাঁরা নিশ্চয় এইসব উপাদানগুলো সম্বন্ধে পরিচিত ছিলেন, এবং হয়ত এইসব উপাদান
দিয়েই কাঁচ তৈরি করতেন।
প্রথম কাঁচের উতপত্তি এবং তার সময়
ই আর কেলি(অ্যানালাইসিস অব এন্সিএন্ট গ্লাসসেস,
১৭৯০-১৯৫৭) বলছেন সাম্রাজ্য পূর্ব মিশরের নাকুয়াদায় কাঁচের পুঁতির উল্লেখ রয়েছে।
সময়টা ৩৫০০ খৃস্ট পুরবাব্দ। যে পুঁতিটি পাওয়া গিয়েছে সেটি হাল্কা সবুজ রঙের। এফ
রাথজেন(আউস ডার অল্টেস্টেন জেস্টিসেট ডেস গ্লাসেস) এটির রাসায়নিক পরীক্ষায় এটিকে
কাঁচ রূপে চিহ্নিত করা গিয়েছে। তবে অন্য এক গবেষক, এইচ সি বিক(গ্লাস বিফোর
১৫০০বিসি, এন্সিএন্ট ইজিপ্ট অ্যান্ড দ্য ইস্ট), এই পুঁতিটিকে ষষ্ঠ রাজতন্ত্রের(২৫০০
খৃস্ট পুরবাব্দ) বলে দাবি করছেন। তার আরও বক্তব্য এটি হয়ত মেসোপটেমিয়ায় প্রথম তৈরি
হয়। তার এই সিদ্ধান্তের উতস হল তিনি ইরাকের আবু সাহারেইনে এধরনের নীল রঙের কাঁচ
এবং তেল আসমেড়ে সবুজ রঙের এধরনের পুঁতি দেখেছেন। এই দুটির সম্ভাব্য তারিখ ২৭০০-২৫০০
খৃস্ট পুরবাব্দ।
কাঁচ এবং কাঁচ তৈরির প্রযুক্তির
উদ্ভব
প্রাচীন কালে কাঁচের উদ্ভব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি ধারণা
উপস্থাপিত করেছেন। এদের মধ্যে সম্ভাব্য দুটি তত্ব উপস্থাপিত করা গেল। প্রথমটি হল, ধাতুগলনের
প্রযুক্তি থেকেই কাঁচের উতপত্তি। কপার, তামা গলন(স্মেল্টিং) পদ্ধতিতে কাঁচেরমত বর্জ্য
তৈরি হয়। একেই কাঁচ তৈরির পদ্ধতির সঙ্গে জোড়ার চেষ্টা হয়েছে। আর যেহেতু প্রাচীন
কালে পাওয়া যাওয়া কাঁচের রং প্রায় নীল বা সবুজ রঙের যা তামার উপস্থিতি জানান দেয়,
সেহেতু এই তত্বটি প্রাধান্য পেয়েছে। ছোট কাঁচের পুঁতি হয়ত, তামার গলনের সময় গলে
পড়া কাঁচেরমত চকচকে বর্জ্যের এক রূপ। তবে ক্রুসিবলের মধ্যে গলন পদ্ধতিতে উদ্ভুত প্রাকৃতিক
কাঁচের মত চকচকে অবস্থা তৈরি হয় বলেই হয়ত অনেকের ধারণা এই পদ্ধতিতে হয়ত কাঁচ তৈরি
হতে পারত। তবে এটি মনে রাখা প্রয়োজন, কাঁচে চকচকেভাব আনা এবং পুঁতি তৈরির প্রযুক্তি
দুটোই বেশ পুরনো। ফলে তামা গলনএর ধাতুবিদেরা কাঁচামালটি সম্বন্ধে জানতেন এবং সেটি
তৈরির পদ্ধতিটিও তাদের আয়ত্তে ছিল। তবে এই ধারনাটার বিরুদ্ধবাদীরা বলেন, এই
বর্জ্যতে এতই বেশি পরিমানে লোহার উপস্থিতি থাকে জে তা দিয়ে যাই হোক, কাঁচ অন্তত
তৈরি হতে পারে না। অন্য আরেক দল মনে করেন, চকচকে সেরামিক বাসন তৈরির পদ্ধতি বিকাশের
সঙ্গে সঙ্গেই কাঁচ তৈরির পদ্ধতির বিকাশ ঘটেছে। তাঁরা আরও বলছেন চকচকে কোটিনওয়ালা বাসন
পত্রের বিকাশের পরের স্তরে কাঁচ তৈরি পদ্ধতির বিকাশ ঘটেছিল। ফ্রিট, মিশরিয় নীল, ভাইট্রেয়াস
পেস্ট, ফিয়েঁস ইত্যাদি সব যৌগগুলোই কাঁচের ভাই বোন। এগুলো দিয়েই হয়তো কাঁচ তৈরির
পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। আর এইচ ব্রিল(এন্সিএন্ট গ্লাসেস, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ১৯৫৭)
বলছেন এশিয়ার নানান দেশে উৎখননের সময় ফিয়েঁসে যৌগটি পাওয়া গিয়েছে, এবং কাঁচ তৈরির
বহু আগে এই যৌগটির উতপত্তি হয়েছিল।
প্রথম স্তরের কাঁচ শিল্প(, ব্রিলএর প্রাগুক্ত বই এবং আর
জে ফোরবসএর স্টাডিজ় ইন এন্সিএন্ট টেকনলজি)
কোথায় কবে কীভাবে কাঁচ প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটেছিল, সেই
বিতর্কে না গিয়ে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে, মিশরে থুতমোস, হতসেপতুত,
ইখনাটোন এবং তুতেনখামেনের অষ্টাদশ রাজবংশের সময়ে (১৫৮০-১৩৫৮ খৃস্ট পুরবাব্দ) কাঁচ
তৈরির প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে। রঙ্গিন গভীর নীল কাঁচের রংকরা নানান প্রসাধনী তৈজসপত্রের সঙ্গে ঘোড় সাজানো সাদা এবং হলুদ রঙের
পুঁতিও পাওয়া গিয়েছে। সেই রাজবংশ পর্যন্ত হাওয়া দিয়ে কাঁচের দ্রব্য তৈরির
প্রযুক্তি জানা ছিল না। মাটি আর বালির তৈরির কাঁচের পাত্রে রং করে সেটি কোনও কাপড়
দিয়ে ঢেকে রাখা হত। হঠাতই অষ্টাদশ রাজবংশের সময়ে কাঁচ তৈরির প্রযুক্তির বিকাশ ঘটতে
থাকায় একটি বিষয় পরিস্কার হয় যে এই প্রযুক্তি মিশরে হয়ত অন্য কোনও দেশ থেকে আমদানি
করা হয়েছিল। আরও আশ্চর্যের কথা এই রাজবংশ লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর থেকেই যেন মিশরে
কয়েক শতক ধরে আবার কাঁচ তৈরির প্রযুক্তির লোপ ঘটে।
দ্বিতীয় বারের কাঁচ শিল্প
আবার আরব জগতের সিরিয়ায় খৃস্ট পূর্বাব্দে দ্বিতীয় সারাগনএর
রাজত্বের সময়, পালাস্তেনিয়ার উপকূল এবং আসিরিয়ায় নিজের জোরে দ্বিতীয় বারের জন্য
কাঁচ শিল্পের বিকাশ ঘটে। পরে এরসঙ্গে মেসোপটেমিয়ার পুরনো কাঁচ শিল্পের সঙ্গে যোগ
দেয়। ভারতেও এই সময়েই কাঁচ শিল্পের বিকাশ ঘটছে। পরে এবিষয়ে আলোচনা হবে।
তৃতীয়বারের কাঁচ শিল্প
খৃস্ট পূর্ব প্রথম শতকে হাওয়া দিয়ে কাঁচের বস্তু তৈরি
করার পদ্ধতি বিকাশ ঘটে। এই সময় রোমে কাঁচ শিল্পের ব্যাপকভাবে বিকাশ ঘটে এবং প্রচুর
কাঁচের দ্রব্য উৎপাদন হয়, এমনকি মধ্যবিত্তের ঘরেও কাঁচের তৈজস শোভা পেত।এর পর থেকে
রোমের বহির্বাণিজ্যে কাঁচ একটি বড় স্থান দখল করে এবং বিশ্বের নানান দেশের
সংস্কৃতিতে কাঁচের বাসন বড় উপাদান হিসেবে দেখা দিতে থাকে।
No comments:
Post a Comment