সম্প্রতি ৪০ ওভারের
আইপিএল ক্রিকেটের সঙ্গে সংলগ্ন নানান মহলের বেটিং বিষয়ে নিরন্তর সংবাদ প্রকাশে
আমরা উদবিগ্ন। আমরা বাংলার পারম্পরিক কারু, বস্ত্র এবং অভিকর শিল্পীদের সংগঠন,
বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বাস্ত্র শিল্পী সংঘ, এবিষয়ে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য,
ভাবনা নিবেদন করতে চাই। এই সংগঠন শিল্পীদের জন্য তৈরি মধ্যবিত্তের সমাজ সেবা
বিলাসী সংগঠন নয়। শিল্পীদের নিজেদের সংগঠন। সংগঠনে ৮০ শতাংশই পরম্পরার শিল্পী।
অন্ততঃ ছহাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্যবান পারম্পরিক শিল্পীদের জীবন জীবিকা, তাদের
অধিকার রক্ষা, বিশ্বায়নের খোলা বাজারে তাদের বিপন্ন অস্ত্বিত্ব, পুরনো ইতিহাস
বিষয়ে গবেষণা, ইতিহাসে নতুন করে তারিখ নির্ণয়, জ্ঞান নথিকরন ইত্যাদি বিষয়ে
শিল্পীরা নিজেরাই আন্দোলন করে থাকে। কেন্দ্রিয় এবং ১৭টি জেলার জেলা সংগঠন বিগত তিন
বছর ধরে সদস্য চাঁদা, আর বন্ধুদের সহায়তার ওপর ভিত্তি করে চলছে। নানান দাবি আদায়ের
আন্দোলন ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের নানান গ্রামীণ অঞ্চলের সঙ্গে, ভারতের নানান স্থানে,
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের নানান পারম্পরিক, ঐতিহ্যশালী নানান উৎপাদন নিয়ে
প্রদর্শনী করে থাকে।
বেটিং অর্থে জুয়া –
আইনি বা বেআইনি যাই হোক। খেলোয়াড়, আম্পায়ার, এমনকি দল মালিকদের বিরুদ্ধে হয় বিশেষ এক
ক্রিকেট খেলার দিনে বিশেষ কোনও সময়ের খেলার নির্দিষ্ট অংশে কি হতে যাচ্ছে তার ওপর
বাজি ধরা, নয়তো গোটা খেলাটির পরিনাম আন্দাজ করার ওপরে বাজি ধরার অভিযোগ(বেটিং)
উঠেছে। অভিযোগ খেলোয়াড়, দল মালিক, আম্পায়ারা যৌথভাবে নিজেদের মধ্যে খেলার জন্য যে কলাকৌশল
তৈরি হয়, সেই তথ্য এবং পান্টারদের বিক্রি করে নিজেরা জুয়ায় অর্থ বিনিয়োগ করত। এই
অভিযোগে মুম্বাইএর অভিনেতাদের সঙ্গে ক্রিকেটের সঙ্গে জুড়ে থাকা ভারতজোড়া নানান
ব্যক্তি, সংগঠনকে দিল্লি এবং মুম্বাই পুলিস হয় জেরা নয়ত গ্রেপ্তার করেছে। শোনাযাচ্ছে
এই ব্যাবসায়, শুধু আইপিএলেই (যদি লোকঠকানোকে, নৈতিকভাবে ব্যবসা বলা উচিত নয়) বছরে ৪০
হাজার কোটি টাকা খাটে(ক্রিকেটে সব মিলিয়ে প্রায় হাজার লক্ষ কোটি টাকা), এই কাজে
মদত দিচ্ছে ভারতের বাইরে বসে থাকা অন্ধকার জগতের মাথারা।
আইপিএল প্রসঙ্গে বলা
যাক, জেলায় সংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, জুয়ার জাল একেবারে তৃনমুলস্তরেও ছড়িয়েছে
অনেকদূর। সংগঠন চালাতে কিভাবে জুয়ার সহজ অর্থের প্রস্তাবের মুখোমুখি হচ্ছি, সেই
অভিজ্ঞতাটি এবং এই উচ্চসমাজের জুয়ার সঙ্গে বাংলার তৃনমুলস্তরের জুয়ার যোগাযোগের
আশঙ্কা যে থেকেই যায়, সেই বিষয়টি আপনাদের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে প্রকাশ করার
অনুমতি চাইছি।
সংগঠন তৈরি হওয়া থেকে গত
তিন বছর ধরে বাংলার নানান অঞ্চলে সদস্যদের নিয়ে প্রদর্শনী করে চলেছে সঙ্ঘ।
প্রদর্শনীর বেশ কিছু সময়ের আগে, জেলা
কমিটিগুলোর সঙ্গে বসে প্রদর্শনীর জন্য প্রয়োজনীয় স্থান নিরূপণ, অর্থ তোলার
ব্যাবস্থা করা হয়। প্রত্যেক সংগঠনের মতই, প্রত্যেক প্রদর্শনীর আগের কয়েক মাস
সংগঠনে প্রয়োজনীয় অর্থ তোলা নিয়ে বেশ চুল ছেঁড়াছেঁড়ি চলে। শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটা
কাজ, স্থানীয় মানুষ, সংগঠনের সহায়তায় বেশ সন্তোষপূর্ণভাবে শেষ হয়। সেই প্রদর্শনী
থেকে আবার নতুন পরিকল্পনা নতুন উদ্যমে নেওয়া হয়েছে।
সংগঠনের ১০১২র কুচবিহারে
অনুষ্ঠিত উত্তরবঙ্গ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, ২০১৩র মে মাসে উত্তর দিনাজপুরের কোনও
একটি গ্রামীণ এলাকায় একটি প্রদর্শনী করা হবে। কেননা, মুলতঃ শহরাঞ্চলের বাইরে,
যেখানে শিল্পীদের বাসস্থান, সেখানের সাধারনেরা কি বলছেন, তা বোঝা, এবং গ্রামের
বাজারকেও বুঝতে চেষ্টা করা। ঠিক হয়, প্রস্তাবিত মেলাটি কালিয়াগঞ্জের, ফতেপুর মোড়ের
থেকে আড়াই কিমি ভেতরে, চান্দোল হাটে হবে সাতদিন ধরে। দিনখন ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর
এল অর্থের সমস্যা। জেলা সম্পাদক সেখানের বেশ কিছু ক্লাব সংগঠনকে নিয়ে মিটিং ডাকেন।
বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়। কিন্তু আর্থিক সমস্যার সমাধান হয় না। স্থানীয় সংগঠনগুলো
নানানভাবে পিছিয়ে যেতে থাকে।
মেলা প্রায় করা যাচ্ছে
না, এমন এক অবস্থায়, চতুর্থ বৈঠকের মাঝের বিরতিতে, সংগঠনের কেন্দ্রিয় এক নেতার
কাছে সঙ্গোপনে ঘুরপথে প্রস্তাব আসে, মেলার অর্থের সমাধান হয়ে যেতে পারে, যদি সংগঠন
মেলায় জুয়ার বোর্ড বসানোর অনুমতি দেয়। সেই নেতা, প্রস্তাবটি শোনা মাত্রই খারিজ করে
দেন। ফলে প্রস্তাবটি আর মিটিংএর পরের অর্ধে পেশ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু উঠল। বোঝাগেল
যে আটটি সংগঠন সঙ্গে নিয়ে আমরা এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছি, তার একটির অন্যতম
কর্মকর্তা এই প্রস্তাবটি দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে বোর্ডওয়ালাদের যোগাযোগ আছে। একজন
বোর্ড মালিক তাঁর গ্রামের মেলা দেখাশুনো করে। প্রত্যাখ্যাত হয়েও তিনি দমেন নি।
মরীয়া হয়ে মিটিঙে তিনি এই সমাধানটি প্রস্তাব করে ফেলেন। হয়ত ভেবেছিলেন প্রায় ১ লাখ
টাকার প্রস্তাবটা আমরা হয়ত অনুষ্ঠানের স্বার্থে লুফে নেব। মিটিঙে প্রায়-সর্বসম্মতিক্রমে
প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। আমাদের স্বস্তি দিয়ে অন্য সংগঠনগুলো শিরদাঁড়া সোজা করে
আমাদের সমর্থন করে সেদিন। সেই ক্লাবটি আর প্রদর্শনী সংগঠনে থাকে নি। বুঝলাম, শুধু
অর্থ-লালসার জেরে মানুষকে দিয়ে অনৈতিক অনেক কিছু করিয়ে নেওয়া যায় না, আজও মানুষকে
নৈতিকতা চালোণা করে। সংগঠনের কেন্দ্রিয় অর্থ, স্থানীয় সংগঠনগুলোর উদ্যম, নানান ব্যক্তির
সহায়তায় মেলাটি অসম্ভব সফল হয়। আমরা গ্রামের বাজার সম্বন্ধে নতুন দৃষ্টি লাভ করি।
সে এক অন্য দীর্ঘ আলোচনা।
মিটিঙ শেষে, আমাদের
অসীম কৌতূহল মেটালেন জেলা সম্পাদকমশাই। তিনি বললেন, গ্রামেগঞ্জে চাঁদা দিয়ে আর
মেলা আয়োজন করা হয় না। মেলার পরিকল্পনা করার সময় থেকেই স্থানীয় জুয়া সংগঠনগুলো
নিলামে মেলার ডাক হয়। সেই নিলামে যে দল, মেলা কমিটিকে সব থেকে বেশি টাকা দেওয়ার
অঙ্গিকার করে, সেই জুয়ার বোর্ড বসানোর অধিকার পায়। শুধু থোক টাকা দেওয়াই নয়, জমকাল
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য আলাদা অর্থের বরাদ্দ থাকে। যত বেশি মানুষ, তত বেশি
জুয়ার বোর্ডে অর্থ বিনিয়োগ, তত বেশি রোজগার। মেলার জন্য সংগঠকেরা আলাদা করে চাঁদা তোলেন।
লাভের গুড় সংগঠকেদের সিন্দুকে। নামী মেলা হলেতো কোথাই নেই। জুয়া দলগুলোর
রেষারেষিতে সে ডাক যে গিয়ে কোথায় থামবে কেউ জানে না। আমাদের মেলা চলাকালীন সময়ে শুনলাম
মাত্র তিন দিনের একটি স্থানীয় পুরনো মেলার ডাক উঠেছে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা!
নতুন মেলা হলে প্রাথমিক তহবিলটি স্থানীয় যুবকেরা চাঁদা দিয়ে তৈরি করে। পুরনো মেলা
হলে মাছের তেলে মাছ ভাজা। জুয়ার বোর্ডের অর্থ উঠে আসে সুদে আসলে। তবে জুয়ার বোর্ড
মেলার একটু দূরেই বসে, বেশ অনেকটা যায়গা নিয়ে। শোনাগেল, মোটামুটি আমাদের মত নতুন
মেলায়(রোজ অন্ততঃ হাজার দশেকের বেশি মানুষ এসেছেন এই মেলায়) সাত দিনের জন্য খুব কম
করে ১ লাখ টাকার ডাক ওঠে। এছাড়াও প্রসাশন, স্থানীয় প্রভাবশালী মানুষ, সংগঠনের
জন্যও বিশেষ প্রণামী বরাদ্দ থাকে। সব ক্ষমতাশালী দেবতা তুষ্ট করে সমগ্র বাংলা জুড়ে
চলছে জুয়ার টাকায় মেলা নামক মোচ্ছব।
এক একটি জুয়ার দল খুব কম করে
বছরে ৫০-৬০ লাখ টাকা রোজগার করে। জেলায় মানুষ ঠকানোর ব্যাবসা হিসেবে খুব কম
সম্পদের ব্যাবসা নয়। একটি জেলায় খুব কম করে ১০টি(থাকে অনেক বেশি) দল থাকলে,
সেখানেই রোজগার ৫ কোটি। ১৯টা জেলা ধরলে সারা বাঙলায় কমবেশি প্রায় ১০০ কোটি। মোটব্যবসার
পরিমান কত? আমরা জানিনা এই জেলার ছোট ছোট জুয়াড়িদের সঙ্গে কোনভাবে এশিয়াজোড়া জুয়ার
ব্যাবসার যোগাযোগ আছে কি না। মুঠোফোন, অন্তরজাল ইত্যাদির মাধ্যমে যেভাবে সহজেই
যোগাযোগের সুযোগ বেড়ে চলেছে তাতে এই আশঙ্কা বেড়েই চলে বই কমে না। বার্ষিকভাবে
জেলাওয়ারি এই জুয়াড়িদের রোজগার খুব কম নয়। ফলে এই রোজগারে এদের যদি আন্তর্জাতিক
যোগাযোগ বাড়ানোর সাধ হয়ে থাকে তাহলে পুরো ব্যাপারটাই খুব শঙ্কার। ভারত বিরোধী বহু
সংগঠন আইপিএলেরমত জুয়ার শৃঙ্খল থেকে অর্জিত অর্থ ভারত ধংসের কাজে ব্যাবহার করছে।
এবার যদি বাংলার গ্রামস্তরে তাদের বেটিং বা স্পট ফিক্সিং নেমে আসে, তাহলে নিশ্চিত বাঙলা
বড় এক ধ্বংসযজ্ঞের জন্য অপেক্ষা করছে। এবিষয়ে প্রশাসন কি কিছু করতে পারেন না?
No comments:
Post a Comment