এখন প্রশ্ন, কোন সংগ্রামটিকে গুরুত্ব দেব আমরা, আর কোন মানসিকতাকেইবা
গুরু্ত্ব দেব আজ এই বিশ্বায়ণের করালগ্রাসে! কলকাতা না গ্রামবাঙলা। আমাদের পক্ষ নিতেই হবে। কলকাতার বাইরে
ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসী, নীলচাষী, গারো, ওয়াহবি- পূব ভারতের
পারম্পরিক সমাজ হাজারো বিদ্রোহে ফেটে পড়ছে। সমাজ ভাঙতে
দেখে গ্রামীণেরা সবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে গ্রামের পর গ্রাম স্বাধীণতা সংগ্রামের
আগুণ ছড়িয়ে দেওয়ার মৃত্যুব্রত গ্রহণ করেছিল। নিশ্চিত মৃত্যু ওঁতপেতে আছে জেনেও তাঁরা একপাও পিছু হটেনি, ব্রিটিশদের
সঙ্গে এককণাও সমঝোতা করে নি, ঘৃণাসম দৃষ্টিতে বর্জন করেছে ব্রিটিশ সরকারের দমননীতিকে। সরকার উত্খাতকেই জীবনের ব্রত ভেবে নিয়েছিলেন। হেরে গিয়েছেন। কুলমানহীন এই কৃষক-রায়ত-শিল্পী-ছোটব্যবসায়ীদের
এই অপরিসীম বীরত্ব গাথা আজ ইতিহাস।
স্বাধীণতার ষাট বছর পর এই সামান্যে অসামান্য স্বাধীণতাকামী
মানুষগুলির লড়াইএর প্রস্তুতির কথা ভাবলেও রূপকথা মনে হয়। ধন্য বাঙলার গ্রাম সমাজ। ধন্য এই সাধারণ
কিন্তু অসমান্য জ্ঞাণী-দূরদৃষ্টিসম মানুষ। এঁরা বিদেশিদের
আচরণে বুঝেছিলেন, ভারত সমাজে সমাজে দুর্দিন সমাসন্ন। শহুরে কলকাত্তাই ইংরেজি শিক্ষিত ভদ্রলোকেদের দিকে একবারও সাহায্যের হাত না
ধরে, নিজেরাই ছকে নিয়েছিলেন ইতিকর্তব্য। বাঙলা-বিহারের
গ্রাম সমাজ এঁচে নিচ্ছিল সংগ্রামের বিনিসুতোর মালাগাঁথার কায়দাকানুন। গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রাম গুরুত্ব পেল না কলকাতায়। সভা-সমিতিতে আলোচনাও নেই! অথচ কলকাতার সংবাদপত্রগুলো কেউ সরকারের পক্ষে,
কেউবা ছদ্ম-বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট নানান সংগ্রামের সংবাদ পরিবেশন করেছে।
আর কলকাতায় গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রামগুলি দমনের
মদতদাতা, রক্তে রাঙানো হাতের মালিক, রায়ান আর বার্ডকে সমাজ পরিবর্তনের গুরুঠাকুর
ধরে মুক্তবুদ্ধির আলাপ আলোচনা চলছে নিরন্তর। একহাতে
ব্র্যান্ডি, অন্য হাতে ভারতবিদ্বেষের পুস্তক, রাতে বেশ্যাবাড়ি। পরস্পরের
পৃষ্ঠকণ্ডুয়ণের বিদ্রোহনেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়ং বেঙ্গলিরা। হবসএর লেভিয়াথানএ ক্যাপটিভ আন্ডারস্ট্যান্ডিং তত্ব, রাইটস অব
ম্যান, টম পেনএর এজ অব রিজনিং, স্বাধীণভাবে মত প্রকাশের জন্য স্পিনোজার
তত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি পড়েও ইংরেজ শাসন বাঙলার গ্রামীণদের অধিকার ছিনিয়ে
নিচ্ছে, এই সাধারণতম তত্বটুকুও কলকাতার অসাধারণ আলোকপ্রাপ্তদের চিন্তায় প্রবেশ করল
না! ঔপনিবেশিক ইংরেজদের শাসনের বিরোধিতা যদি রাজনৈতিক চেতনা মাপার দিগদর্শক হয়,
নিজেদের স্বাধীণতা নিজেদেরই রক্ষা করতে হবে, এই সাধারণ তত্ব বুঝতে হাজার হাজার
বছরের অধিকার থেকে উত্খাত হওয়া গেঁয়ো, মূঢ়, নির্বোধ, অজ্ঞ, অশিক্ষিত,
সামন্ততন্ত্রে গলা পর্যন্ত ডুবে চাষীরা ইওরোপিয় তত্বে আলোকপ্রাপ্তও হননি, মাসে
পাঁচটাকা দিয়ে কালেজেও যাননি, ইংরেজিও শেখেননি।
ইওরোপিয় চিন্তার শিকড়
চিতপুর রোডে, ফিরিঙ্গি কমল(লোচন) বসুর বাড়িতে, ২০ আগস্ট ব্রাহ্মসমাজ
স্থাপন হল। ৪২০০ টাকায় চার কাঠা আধ পোয়া জমি
কেনা হল দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ রায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামচন্দ্র
বিদ্যাবাগীশ এবং রামমোহন রায়এর নামে। ১৮৩০এর ৮ই
জানুয়ারী সমাজ গৃহ প্রতিষ্ঠা হল চারজন ট্রাস্টি, রমানাথ ঠাকুর, রাধাপ্রসাদ রায় এবং
টাকীর বৈকুণ্ঠনাথ রায়এর তত্বাবধানে। ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীতে বলছেন ....আত্মীয়সভা নানান বিঘ্ন
বিপত্তির মধ্যেও চার বত্সর চলিয়া বন্ধ হইয়া গেল। ...১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে অন্যতম ব্যাপটিস্ট মিশনারি আ্যাডাম সাহেব রামমোহনের
সহিত যুক্তিতর্কে পরাজয় স্বীকার করিয়া একেশ্বরবাদী হইলেন। সেই অবধি রামমোহন রায় প্রতি রবিবারে আ্যাডাম সাহেবের বাটীতে উপাসনার জন্য
মিলিত হইতেন। ...রামমোহন রায় শুনিয়াছি যে, সমাজে
ইংরাজী ভাষায় ও ইংরাজ ধরনে উপাসনা ব্যবস্থা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া ছিলেন। খুব সম্ভবতঃ আ্যাডাম সাহেব যাহাতে পূর্ব্বেরমত তাঁহাদেরই সঙ্গে উপাসনায়
যোগদান করিতে পারেন এবং তত্সঙ্গে আরও অনেক ইওরেপিয় যাহাতে একেশ্বরবাদী হয়েন, এই
সকল ভাবিয়া ঐরূপ ইচ্ছা করিয়াছিলেন। ...হিন্দু
কালেজের প্রথম ফল এই ১৮৩০ সালে ফলিয়াছিল এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম সম্পাদক
তারাচাঁদ চক্রবর্তী ইংরাজী সভা, বক্তৃতা প্রভৃতির বড়ই পক্ষপাতী ছিলেন...।
রামমোহনের তত্বে(আদতে ইওরোপিয় ভাবধারায়) তৈরি হল
রোভারেন্ড এডামএর উদ্যোগে ইউনিটেরিয়ান কমিটি। এই সভায় ইউনিটেরিয়ান খ্রিস্টান মতে উপাসনা হত। ইউনিটেরিয়ান কমিটি আর ব্রাহ্মসমাজের দলাদলি ছেড়ে রামমোহন বিলেত গেলেন
দলাদলি আর দালালির কাজ নিয়ে। ভারতে ঘোমটাপরানো
দাসপ্রথা সমর্থক, ইংরেজ নীলকর আর দেশিয় নীলকরদের কলোনাইজেশন আন্দোলনের অন্যতম তাত্বিক
রামমোহন, মদ্যাসক্ত, বেশ্যাসক্ত নবজাগরণের অগ্রদূত ছাত্র-অনুগামীদের অনাথ করে, সাম্রাজ্যের
অসীমতম লোভের গ্রাসে বাঙলার কৃষকদের ফেলে ব্রিস্টলে দেহত্যাগ করলেন, ১৮৩৩এর ২৭ সেপ্টেম্বর। রামমোহনের ব্রিস্টলে মৃত্যুরপর আত্মীয় সভার পরবর্তী সংস্করণ ব্রাহ্ম সমাজ
প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তবুও কলকাতার দুধেভাতের বিদ্রোহের হাতিয়ার
সমিতি গড়া আর সেই সমিতিতে লড়াই, ঝগড়া, তর্ক, দলাদলি সবই চলতে থাকল।
কলকাতার কবিয়াল বাঙলার যুবকদের রঙ্গদেখে ছড়া কাটলেন, গুরুমশাযের
মারধোর, ঘুচেগেল তাঁর জারিজুরি, ডফ কেরি আদি মাশনারি, পাড়ায় সবার স্কুল করি। গঙ্গার জলে যে বিষ্ঠা ভাসে, বন্ধ হলো নাওয়া খাওয়া, লালদিঘীর জল হলো চল, পয়সা
দিয়ে জল খাওয়া। আসন পেতে বসল খেতে, তেলে ধূয়া পড়
ধূলা পাতে, টেবিল চেয়ারে ছেড়ে ভাই, ছেলেরা আর চায় না খেতে। বিলাতি খানা খায় যে তারা, কাঁটা চামচের সঙ্গে গেলে, মুরগী ভেড়ার মাংস
খেয়ে ব্র্যান্ডি হুইস্কি খেতে শিখলে। শুকনো ডাবা
গঙ্গায় দিয়ে, নর্দমায় যায় গড়াগড়ি, বেনিয়ান বাবু পাল্কি ছাড়ি, রাস্তায় বেড়ান
বগী করি। যা পারেন নাই ব্যাস মনু, সতীর মরণ আইনে
গেল, মাছের মায়ের পুত্র শোকে, সতীধর্ম তাই চলে গেল। গঙ্গাস্নান আর পাঁতি লেখা, টোলের ভিতর ছেলে পড়ানো, বেদাদির সূক্ষ্ মর্ম
ভুলে, জারি জুরি আর চলবে না।(কলিকাতার কথা, রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিক)
সাগরপারের পাদ্রি আলেকজান্দার ডাফ(রিফর্মিস্টদের প্রধান,
কৃষ্ণমোহনের ভাষায় Mr. D.) কলকাতায়
এলেন ভারত উদ্ধারে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে এবং ভারতবর্ষ উদ্ধারে(ডিরিজ়িও
রিমেম্বারডএর, ৫৯, ডাফের রচনা, ব্রিফ স্কেচেস অব সারসকামস্টানসেস... থেকে, বাট হাউ
কুড অল দিজ মোটলি, ইনফিকেসিয়াস, মেটা-ফিজিকো-রেলিজিওনিজ়ম, - হাউ কুড অল দিস ব্লাইন্ড
টেনাসিয়াস ক্লিভিং টু এরর, - অল দিস কন্টেমসুয়াস রিজেক্সন অব দ্য অনলি ফেথ দ্যাট
ইজ থ্রুআউট এ্যাডাপ্টেড টু দ্য নেসেসিটিজ অব উনিভারসাল ম্যান, - এভার প্রুভ
হেল্পফুল ইন রিয়ালি রিফরমিং আ নেশন করাপ্ট টু দ্য এভরি কোর? পিঠ চাপড়ে
দিলেন এনকয়ারার এবং জ্ঞানেনেষনএর – দিজ় বিকাম দ্য এস্টাব্লিসড অরগান্স অব দ্যাট
স্মল পারটি অব এডুকেটেড হিন্দুজ় হু হ্যাড মেড দ্য হায়েস্ট এটেইন্মেন্টস ইন ইংলিশ
লিটারেচার, অ্যান্ড দ্য হাইয়েস্ট আডভান্সেস ইন লিটারারি সেন্টিমেন্ট; হু, অ্যালাইভ
টু দ্য ইনেফিকেসি অব হাফ-মেজ়ারস; এ্যান্ড স্কোরনিং দ্য হিপোক্রাসি অব ডবল ডিলিং,
হ্যাড এ্যাট ওয়ান্স রিনাউন্সড, বোথ ইন থিওরি অ্যান্ড প্রাকটিস, দ্য হোল সিস্টেম অব
হিন্দুইজ়ম, পিওর এ্যান্ড ইম্পিওর, এন্সিয়েন্ট এ্যান্ড মডার্ন, ভেদান্তিক এ্যান্ড
পুরানিক; - এ্যান্ড হু, বিইং দাস লেফট ইন আ রিজিয়ন অব ভ্যাকেন্সি এ্যাজ় রিগারড
রেলিজ়িয়ন, এ্যানাউন্সড দেমসেল্ভস টু দ্য ওয়ার্ল্ড এ্যাজ় ফ্রি ইনকুইরারস আফটার
ট্রুথ।)। তিনি গড়ে ওঠা সমিতিগুলির দলাদলি নিয়ে
বেশ মশকরাও করেছেন, লিখেওছেন অনেক কিছু। ভঙ্গ কলকাতার রঙ্গ
দেখে উত্সাহিত হয়ে তরুণদের মনে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার তুঙ্গে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। ডাফ বলছেন, সভার সদস্যরা যখন বক্তৃতা দিত, তখন ইংরেজ লেখকদের প্রচুর
উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেদেরমত জোরালো করে শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরত। ঐতিহাসিক বক্তৃতা হলে রবার্টসন অথবা গিবন, রাজনৈতিক হলে এডাম স্মিথ অথবা
জেরিমি বেন্থাম(এঁরা আবার সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চাকুরে), বৈজ্ঞানিক বিষয়
হলে নিউটন আর ডেভি, ধর্ম বিষয়ে টম পেইন, হিউম, দার্শনিক হলে লক, রীড, স্টুয়ার্ট,
ব্রাউনের রচনা থেকে প্রচুর পরিমানে উদ্ধৃতি দেওয়া হত। বক্তৃতা তার বিষয়কে সাহিত্যিক মাধুর্যে জীবন্ত করে তোলার জন্য র্যান্ডলফ,
ওয়াল্টার, স্কট, বায়রনসহ নানান ইংরেজ কবি ও সাহিত্যিকদের রচনা থেকে ভালভাল উদ্ধৃতি
দিত। মধ্যে মধ্যে বার্নসএর কবিতা থেকেও উদ্ধৃতি আবৃত্তি হত। সভার পরিবেশ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পাদ্রি ডাফ বলছেন, But
the striking features in the whole was the freedom with which all the subjects
were discussed।
সেসময়ের প্রখ্যাতরা বিলেতাগতদের নানান সংস্কার উদ্যম সফল
করতে প্রাণপাত করছেন। মন্মথনাথ ঘোষ কর্ম্মবীর
কিশোরীচাঁদ মিত্র বইতে বলছেন, এই সময় একজন পবিত্রচেতা, উদারহৃদয়মহাত্মার
সহিত কিশোরীচাঁদ পরিচিত হইলেন। তিনি আর কেহই নহেন চিরস্মরণীয় ডাক্তার আলেকজান্ডার ডফ। যে অদম্য যে উত্সাহ ও একাগ্রতা লইয়া এই তেজস্বী ধর্ম্মযাজক এ দেশে
শিক্ষাবিস্তার ও নৈতিক উন্নতিসাধনের জন্য প্রযত্ন করিতেছিলেন তাহা কিশোরীচাঁদ
লক্ষ্য করিলেন – মুগ্ধ হইলেন। তিনি অবিলম্বে ডাক্তার ডফের মহত্ উদ্দেশ্যে উপলব্ধি করিলেন এবং তাঁহাকে
শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। ডফের বিদ্যালয় স্থাপিত হইল। কিশোরীচাঁদ সেই
বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে শিক্ষাদান করিতে স্বীকৃত হইলেন এবং কিয়তকাল শিক্ষকতা করিলেন। ...যিনি বাল্যে প্যারীচাঁদ কর্ত্তৃক, কৈশোরে ডেভিড হেয়ার কর্ত্তৃক, এবং
যৌবনে আলেকজান্ডার ডফ কর্তৃক জীবনের দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য সম্বন্ধে উপদিষ্ট
হইয়াছেন, তিনি যে উত্তরকালে অসাধারণ কর্ম্মবীর বলিয়া অক্ষয় যশ উর্জ্জন করিবেন
তাহাতে আর বিস্ময়ের কারন কোথায়! শুধু কিশোরীচাঁদই একাই ডফেদেরমত
পাশ্চাত্য ধর্মপিতাদের থেকে পথের নির্দেশ পেতে উদগ্রীব ছিলেন নয়, সে সময়ের অন্যান্য
প্রখ্যাতরাও তাঁদের মন্ত্রতেই ভবিষ্যতের চলারপথের রসদ যোগাড় করতেন, কেরিয়ার তৈরি
করতেন। মন্মথনাথ আরও বলছেন, ...১৮৪৩
খৃষ্টাব্দে আমাদের দেশের রাজনীতিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় বত্সর। এই বত্সরে বিখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুর, বাগ্মী পার্লিয়ামেন্টের অন্যতম সদস্য,
বিখ্যাত বাগ্মী ও ভারতহিতৈষী মহাত্মা জর্জ্জ টমসনকে বিলাত হইতে এই দেশে আনয়ন করেন। ইনি রামমোহন রায়ের অন্যতম বন্ধু মিস্টার আ্যাডাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ
ইন্ডিয়ান সভার একজন প্রধান সভ্য ছিলেন। ...শ্রদ্ধাস্পদ শিবনাথ শাস্ত্রী বলেন, যেমন চুম্বুকে লোহা লাগিয়া যায়,
তেমনি রামগেপাল ঘোষ, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, প্যারীচাঁদ মিত্র, প্রভৃতি জর্জ্জ টমসনের
সহিত মিশিয়া গেলেন।
এ প্রসঙ্গে একটাই তথ্য বলার। সারা বিশ্ব জুড়ে ইওরোপিয় সভ্যতাজাত তত্বগুলিকে বিশ্বের
সর্বজনগ্রাহ্য তত্বের মান্যতা দেওয়ার কাজ ভিত্তি পেতে শুরু করেছে। ন্যুনতম আট(কেউ বলেন পাঁচ) হাজার বছরের ভারত সভ্যতার
জ্ঞাণ, দর্শণ, বিজ্ঞাণকে ফুতকারে উড়িয়ে ইওরোপের ভাবনায় ভারতকে দেখা, শোনা, বোঝার
কাজ মান্যতা পেতে শুরু করেছে। ইওরোপিয় ধ্যানধারণার নানান রেণু ভারতে রোপণ করতে শুরু
করল বাঙালি আলোকপ্রাপ্তরা। সেই কাজ আজও করে চলেছেন তাঁদের প্রবল প্রখ্যাত উত্তরাধিকারীরা,
কেউ স্বদেশে, কেউবা বিদেশে বিলেত আমেরিকায়, কেউবা বামপন্থা, কেউবা মধ্যপন্থা আবার
কেউবা দক্ষিণপন্থার মোড়কে। ইংরেজি শিক্ষার সব থেকে মারাত্মক প্রভাব পড়ল কলকাতার
সমাজে। পাশ্চাত্যমুখীন হতে
শুরু করল কলকাতার শিক্ষিত সমাজ। ভারতীয় ধর্ম-সমাজের নানান রীতিনীতির প্রতি তাচ্ছিল্যের,
ধংস ভাবনার শেকড় পোঁতার যে কাজ শুরু করেছিল জেসুইটরা দুশ বছর আগে, তার শেকড়
চারিয়ে গেল কলকাতার মধ্যবিত্তের মানসিকতায়। ব্রিটিশাররা এতদিন ভারতের হাজার হাজার ধর্মীয় আচার
আচরণকে তথাকথিত মিথ্যে ধর্ম, হিন্দু ধর্ম বলে দেগে দিচ্ছিল। বৈচিত্র্যময় ভারত সমাজের চিরাচরিত আচার ব্যবহার,
প্রথা-সংস্কার, এমনকী ভাষার প্রতিও ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে বাঙালিরা সমস্ত শ্রদ্ধা-বিশ্বাস-নির্ভরতা
হারিয়ে ফেলছিল। টেকচাঁদ ঠাকুরের ভাই
কিশোরীচাঁদ মিত্র সেসময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ। মনেরাখতে হবে, কিশোরীচাঁদ বাঙলাতে একটাও লেখা লেখেন নি।
No comments:
Post a Comment