সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতারও আগে থেকে ভারতীয়রা
বঙ্গোপসাগর, ভারত মহসাগর বেয়ে নানান দ্বীপে বাসতি স্থাপন করেছে। বেদ, জাতক,
পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, বিভিন্ন মহাকাব্য, অর্থশাস্ত্রে বিশদে সমুদ্র যাত্রা, সমুদ্র
বাণিজ্যের নানান তথ্য বিশদে উল্লিখিত হয়েছে। নানান চিত্র, খোদাই এবং খননে পাওয়া
নানান প্রত্নদ্রব্যতে নৌযানের চিত্র দেখা গেলেও, বহুপরে, এগারশ শতকে রাজা ভোজের
নামে একটি পুঁথি যুক্তিকল্পতরুতে সেগুলি তৈরির বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়।
আজকের মধ্যপ্রদেশ,
একাদশ শতকের ধারা অঞ্চলের পারমার(উজ্জয়নীর রাজপুত) বংশীয় রাজা, মহারাজাধিরাজ শিষ্ট
শিরমনি শ্রী ভোজদেব, সাধারণের ভাষায় রাজা ভোজের নামে চলা যুক্তিকল্পতরু (এখন থেকে
যুক্তি বলাহবে) পুঁথিটি নিয়ে বিদেশী বিশেষজ্ঞতো বটেই, ভারতের ঐতিহাসিকদের অনাগ্রহ
আশ্চর্যজনকই নয়, পীড়াদায়কও বটে। সম্প্রতি বলদেও সহায় এ প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধ রচনা
করেছেন। ভোজ রাজা ৮৪টি পুঁথি রচনা করেছেন। শহর পরিকল্পনা, নৌবিদ্যা(নৌ যাত্রা এবং জাহাজ
তৈরি পদ্ধতি), স্থাপত্যবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ, রাজধর্ম, রাজনীতি,
সংস্কৃততে কাব্য, গদ্য, লেক্সিকোগ্রাফি, সংগ্রহ(এন্থলজি), ব্যাকরণ, সংগীতবিদ্যা,
ভেষজবিদ্যা, দর্শনেরমত নানান বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন। যুক্তিকল্পতরু ছাড়াও রাজা ভোজের নামে সমরঙ্গন সুত্রধরেও শহর পরিকল্পনা
এবং বাসস্থান সম্পর্কিত বিদ্যা বিষয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। বেশ কয়েক দশক ধরেই
যুক্তিকল্পতরু আদৌ ভোজরাজের রচনা কিনা, সেই তথ্য নিয়েও খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
উঠেছে। এই প্রবন্ধ শেষে সেই বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদে আলোচনা করা যাবে।
আমরা কিছু আগেই আলোচনা করেছি, সরস্বতী-হরপ্পা
সভ্যতার সময় থেকেই ভারতীয়রা নৌবিদ্যায় মাহির ছিলেন। কিন্তু সেই বাস্তবের
তাত্বিকস্তরে মাপজোক বা বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় নি। বোধহয়, ভারতবর্ষে নৌবিদ্যা বিষয়ে
মাপজোকসহ প্রথম আলোচনা পাওয়া যায় রাজা ভোজের নামে চলা পুঁথিটিতে। নৌককে যুক্তিতে
দুটি ভাগে ভাগ করা হয় – সামান্য এবং বিশেষ। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স আকাদেমির, ড. এ কে বাগেরমত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন নদিতে চলাচল করা নৌকোগুলকে তিনি সামান্য
অভিধা দিয়েছেন এবং অন্যগুলি হয়ত সমুদ্রগামী নৌকো। তবে ভোজ বলছেন, “all Samanya vessels, except Manthara are ambudhagati,
that is sea-going”.
সাধারণ নৌকোর ১০টি বিভাগ ছিল। বড়টি
লম্বায় ১২০ হস্ত, চওড়ায় ৬০ হস্ত(১ কিউবিট = ৫০ সেমি) একই উচ্চতা বিশিষ্ট। এর নাম
মন্থরা। সবথেকে ছোটটি ১৬ হস্ত দীর্ঘ, চওড়া আর উচ্চতায় ৪ কিউবিট। নাম ক্ষুদ্র।
নৌকোর সঙ্গে দীর্ঘ শব্দ যোগ হওয়ার প্রথম শর্ত ছিল সেটি অবশ্যই লম্বা হতে হবে আর
উন্নত শব্দটি যোগ হওয়ার শর্ত ছিল সেটি বেশ উঁচু হওয়া। দীর্ঘর দশটি শ্রেণী বিভাগ
ছিল। আর উন্নতর পাঁচটি। দীর্ঘর সব থেকে বড়টি ছিল ১৭৬ হস্ত ২২ হস্ত চওড়া ২৭ হস্ত
উচ্চতা বিশিষ্ট। এটির নাম বেগিনী।
সবথেকে উঁচু নৌকোটির উন্নতি আর প্রস্থ
ছিল ৪৮ হস্তের, আর দৈর্ঘে ৯৬ হস্ত। সবথেকে লম্বা জাহাজটির পরমাপ ছিল ১৭৬ হস্ত, ৬০
হস্ত প্রস্থ আর একই উচ্চতা বিশিষ্ট।
সামান্য জাহাজ – ১০টি বিভাগ
জাহাজের নাম বর্ণনা পরিমাপ(কিউবিট
- হস্ত)
দৈর্ঘ প্রস্থ উচ্চতা
১। ক্ষুদ্র ছোট ১৬ ৪ ৪
২। মধ্যমা মাঝারি ২৪ ১২ ৮
৩। ভীম ওজনদার ৪০ ২০ ২০
৪। চপল দুদিকেই
চলতেপারা ৪৮ ২৪ ২৪
৫। পাটোলা ছইয়ালা ৬৪ ৩২ ৩২
৬। অভয় ৭২ ৩৬ ৩৬
৭। দীর্ঘ লম্বা ৮৮ ৪৪ ৪৪
৮। পত্রপুট যেন
ভাঁজকরা কাপেরমত ৯৬ ৪৮ ৪৮
৯। গর্ভর গলুইতে
ঘরওয়ালা ১১২ ৫৬ ৫৬
১০। মন্থরা বাঁকানো ১২০ ৬০ ৬০
বিশেষ জাহাজ(লম্বা হওয়া প্রথম শর্ত) –
১০টি শ্রেণীবিভাগ
১। দীর্ঘিকা লম্বা ৩২ ৪ ৩
২। তরণী স্থানীয়ভাবে
যাতায়াত করার জন্য ৪৮ ৬ ৪
৩। লোলা ৬৪ ৮ ৮
৪। গাতভরা তাড়াতাড়ি
নষ্ট হওয়া ৮০ ৮ ৮
৫। গামিনী ৯৬ ১২ ৯
৬। তরী ৯৬ ১২ ৯
৭। জঙ্ঘল ১২৮ ১৬ ১২
৮। প্লাবিনী ১৪৪ ১৮ ১৪
৯। ধারিণী ১৬০
২০ ১৬
১০। বেগিনী ১৭৬ ২২ ১৭
উন্নত(উচ্চতা মূল শর্ত) – ৫ টি বিভাগ
১। ঊর্ধ্বব উঁচু ৩২ ১৬ ১৬
২। অনুর্ধ্বব খুব উঁচু
নয় ৪৮ ২৪ ২৪
৩। স্বর্ণমুখী চাঁদবদন ৬৪ ৩২ ৩২
৪। গর্ভিণী মালবাহক ৮০ ৪০ ৪০
৫। মন্থরা বাঁকা ৯৬ ৪৮ ৪৮
যুক্তিতে জাহাজগুলির অনেকগুলিতে নানা
ধরণের ঘর তৈরি করা হত। জাহাজজোড়া ঘরের জাহাজকে সর্বমন্দির বলা হত। এগুলো রাজার
সম্পদ, ঘোড়া এবং মহিলাদের বহন করত। মধ্যমন্দিরে মাঝে ঘর তৈরি হত। এই জাহাজে রাজা
প্রমোদ ভ্রমনে বার হতেন। অগ্রমন্দিরের নৌকোগুলোর সামনের দিকে ঘর থাকত এবং যুদ্ধের
সময়, দূর যাত্রায় ব্যবহার হত। প্রাচীন ভারতের নৌ বিশেষজ্ঞ এস আর রাও বলছেন, “even Harappan ships had cabms as indicated by the seal
engravings and terracotta amulet &om Mohenjodaro”। নৌকোয় ঘরের আভাস পাওয়া গিয়েছে
সাঁচিস্তুপের খোদাই আর অজন্তা শিল্পে।
ভোজরাজ এমন কিছু জাহাজের কথা বলছেন
যেগুলির চারটি মাস্তুল এবং তাদের সাদা রং করার নির্দেশ দিচ্ছেন। তিন মাস্তুলের
জাহাজগুলির মাস্তুলের আলাদা আলাদা রং করারও সুত্র দিচ্ছেন, একটি লাল, অন্য দুটির
একটি হলুদ, আর একটি নীল। জাহাজের সামনের অংশটি হয় সিংহ, নয়
বাঘ, হাতি, মোষ বা সাপের মুখ খোদাই করার দাওয়াই দিচ্ছেন। জাহাজের গা’টি সূর্য,
চাঁদ, ময়ূর, কাকাতুয়া, এবং দুটো মৌমাছির ছবি দিয়ে আঁকতে বলছেন। হয়ত এগুলি ব্যাবসায়ী
গোষ্ঠীর প্রতীকছিল। অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ মাপতেন উত্তর মেরু থেকে লঙ্কা পর্যন্ত।
জাহাজ তৈরিতে যুক্তি – ব্রাহ্মী,
ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র, এই চারটি শ্রেণীর কাঠ ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন।
যুক্তিতে বলা হচ্ছে ক্ষত্রিয় শ্রেণীর কাঠে সব থেকে কার্যকারী ভাল নৌকো তৈরি হয়। এই
কাঠ হাল্কা কিন্তু মজবুত। অন্যগুলো বেশিদিন টেঁকে না। ঢেউয়ের হাল্কা ধাক্কা লাগলেই
জাহাজের কাঠে চিড় ধরে এবং নষ্ট হয়ে যায়। যুক্তিতে স্পষ্ট বলা হচ্ছে নৌকোতে লোহার
কিলক ব্যাবহার না করতে, কেননা সমুদ্রের জলে থাকা চুম্বক জাহাজকে নষ্ট করে দেয়। যুক্তি
লোহা ছাড়া অন্য ধাতু ব্যাবহার করতে নির্দেশ দিচ্ছে। একটি জাহাজ মোটামুটি ১০০ থেকে
৬০০ যাত্রী বহন করতে পারে। যাত্রীদের সুবিধার দিকে নজর দিয়ে তিনি জলযানগুলি তৈরি
করতে নির্দেশ দিচ্ছেন।
No comments:
Post a Comment