যন্ত্রের সূক্ষ্মতার
ওপর আজও নির্ভর করে না ভারতীয় গ্রামীণ শিল্পীর উত্পাদনের গুণমান। প্রয়োজন হয় উত্পাদকের বংশ পরম্পরায় অর্জিত জ্ঞাণ, কাজের
প্রতি ভালবাসা আর অপরিসীম সামাজিক সুরক্ষার বোধ। ভারত জুড়ে সামাজিক উদ্যমে গড়ে উঠেছিল এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সেচ ব্যবস্থা। যে সময় ব্রিটিশেরা ভারতীয় সমাজে ইওরোপিয় আধুনিকতা আর
ব্রিটিশ আধিপত্যের জীবানুটি অনুপ্রবেশ ঘটাতে প্রাণপাত করে চলেছেন, সে সময়েও কাটা
নাক জোড়া লাগাতে (রাইনোপ্লাস্টি), চোখের চিকিত্সায়, বসন্তের বিরুদ্ধে টিকা দিতে,
মাথার ব্যামো সারাতে, ভাঙা হাড় জুড়তে, সাধারণ রোগের নিদানে ভারতীয় সমাজ মাহির
ছিল। আর সে সমাজের অংক কষার বিষয়ে
অগ্রপথিক দীনেশচন্দ্র সেন মশাই বলছেন(সুত্র – বৃহতবঙ্গ) তাঁর এক চেনা ভারতীয়
জার্মানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে বসে যে পদ্ধতিতে দ্রুত মানসাঙ্ক করতে
পারতেন তা পশ্চিমিদের কাছে জাদুবিদ্যারমত মনেহত। বাংলা আর ভারতের জ্ঞান চর্চার এ এক বিন্দু পরিচয়(এই স্তবকের অনেকগুলির
তথ্য সূত্র ধরমপালজী)।
ব্রিটিশ শাসনের আগে
পর্যন্ত ভারতের চিরাচরিত জ্ঞাণসম্পদের অন্যতম প্রধান অধিকারী ছিলেন, তথাকথিত পিছিয়ে পড়া, গরীব, অন্ত্যজ উপসর্গ দেগে
দেওয়া সমাজ – এ তথ্য আজও খুব একটা বিস্তৃত হয় নি। ১৮৩৬ সালে পাদরি উইলিয়ম এডামের তিনদফা শিক্ষা সমীক্ষায়
বীরভূম জেলায় হিন্দু, মুসলমানএর সঙ্গে খ্রিষ্টিয় শিক্ষকের নাম পাওয়া যাচ্ছে। ৪০০ জন শিক্ষক ছিলেন হিন্দু। এদের মধ্যে ছিল ২৪টি জাতি – চন্ডাল, ধোবি, তাঁতি, কৈবর্ত, গোয়ালা(অর্থাৎ শিক্ষক শুধু ব্রাহ্মণ
সমাজ থেকে আসতেন না। উপনিবেশ এই মিথ তৈরি করেছে। ঢাকের বাঁয়া মধ্যবিত্ত ঔপনিবেশিক মিথএর ভেঁপু আজও বাজিয়ে
চলেছে। গ্রাম
বাঙলায় ব্রাহ্মণেরা সবকিছু নিয়ন্ত্রন করতেন না। বিজয়গুপ্ত, বংশীদাস, নারায়ণ দেব,
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম, মাধবাচার্য, জয় নারায়ণ, নাথ কাব্যের
কবিরা, চর্যাপদের ডোম কবিদের প্রাধান্য, গাথা কাব্যের ছত্রে ছত্রে নানান প্রমাণ
ছড়িয়ে রয়েছে। বদল শুরু হল ভারতচন্দ্রের সময় থেকে। ক্রমশঃ পল্লীসাহিত্য চলে যেতে শুরু করল শহরের
আঙিনার বাইরে অশ্লীল ছাপ পেয়ে। জ্ঞাণ আর সাহিত্য হয়েগেল একমাত্র ইংরেজি শিক্ষিত
শহুরে উচ্চবর্ণীয় মানুষদের খোরাক। জ্ঞাণচর্চার ইতিহাসে গ্রামীণদের ছাপ মুছে ফেলার
চেষ্টা শুরু হল, কোম্পানি আমল থেকে।
পাঠশালায় বটুদের
মধ্যে ছিল মুসলমান, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, ধাঙড়, ডোম, চন্ডাল, তেলি, ব্যধ, যুগি,
তাঁতি, হাড়ি, কুর্মি, মালি এমনকী ব্রাহ্মণ, কায়স্থও। তাহলে এই মিথটিও অপ্রমাণিত
হল, উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখে ছিল। বলাভাল শিক্ষা,
প্রযুক্তি চর্চা আর উৎপাদন নিয়ন্ত্রনে মধ্যবিত্ত কথিত নিম্নবর্ণের পকড় অনেক বেশি
ছিল(সমগ্র তথ্যসূত্রঃ ধরমপালের দ্য বিউটিফুল ট্রি এবং ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড
টেকনোলজি ইন এইট্টিন্থ সেঞ্চুরি, দিনেশ্চন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গ)। বেশি পাঠনিত আজকের ভাষায়
নিম্নবর্ণ বটুরা। বাঙলার এই শিক্ষাসাজ,
সমাজের সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার দর্শণ, সমাজের সবার জন্য শিক্ষাসত্রে পাঠদানের
আয়োজনের তথ্য আজও আশ্চর্যজনক শুধু নয়, বাস্তবে এক মহতি উদ্দেশ্যওবটে। এই পশ্চাৎপটে রবীনবাবুর
প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞানবোধ অধ্যায়টি আলোচনা করা যাক।
প্রফুল্লচন্দ্র যখন
ভারতে সমাজসংস্কারে (মধ্যবিত্ত প্রগতিশীল বাঙালির
সর্বশ্রেষ্ঠ লব্জ। কিন্তু কোন সমাজ! কোন সংস্কার!) ব্রতী হয়েছেন ততদিনে ঔপনিবেশিক
প্রচারে এটি মোটামুটি প্রমানিত হয়ে গিয়েছে যে, গ্রামীণ
ভারত পিছিয়ে পড়া, কুসংস্কারাচ্ছন্ন। প্রফুল্লচন্দ্র, মিল, কার্লাইল ইত্যাদি লেখকের বই থেকে খুঁটেখুঁটে তাঁর
বৌদ্ধিক রসদ সংগ্রহ করছেন। তাঁরা সকলেই ভারতের গ্রামীণদের কুসংস্কারে দীর্ণ,
পিছিয়ে পড়া ইত্যাদি বিশেষণে দেগে দিয়েছিলেন। সামগ্রিকভাবে সে সময়ের ভারত সম্বন্ধে কারোরই বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না।
এরা সকলেই কয়েক হাজার বছর পেছনের ভারতকে স্বপ্নের ভারত বলে মনে করতেন। মাক্সমুলার
স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক ভারত সেই ধ্রুপদী ভারতের পচা গলা রূপ। তার
সংস্কার দরকার। ধেয়ে এল ব্রিটিশ চিন্তাবিদদের সংস্কার নিদান। তাকেই শিরোধার্য করে
গন্যমান্যরা ভারত সংস্কারে ব্রতী হলেন।
দীনেশচন্দ্র সেনমশাই
বৃহৎবঙ্গতে লিখছেন বিগত একসহস্র বছর ধরে গৌড়বঙ্গের রাষ্ট্রিক-সামাজিক পরিবর্তন
নিরন্তর ভাঙাগড়ার মধ্যেদিয়ে চলেছে।
প্রথমে আগ্রাসী মুসলিম সাম্রাজ্য, পরে ধংসাত্মক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিঘাতে
বাঙলার সমাজজীবনে এসেছে নানান পরিবর্তন। ইসলামের সঙ্গে বাঙলার অভিঘাতি পারম্পরিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে, জমি
ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, অনেক অত্যাচারও ঘটেছে ঠিকই- কিন্তু ইসলামের বড় একটি
দিক ছিল, সে বাঙলা তথা ভারতের সম্পদ লুঠ করে যে দেশগুলি থেকে ভারত আক্রমণ করতে
এসেছিল, সেই সব দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। প্রথম যুগে লুঠেরা সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও, দীর্ঘ সময় ধরে ভারত তথা বাঙলার
সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাস করে নতুন এক সংশ্লেষী সংস্কৃতির নমুনা স্থাপন করে
গিয়েছে। যতটুকু অত্যাচারী পরিবর্তন
এসেছে, তা সমাজের বহিরঙ্গে, অন্তরে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা দেওয়া নেওয়ার। পারম্পরিক সমাজের ভেতরে প্রবেশ করে নিজের কেন্দ্রীভূত
দর্শণ ভিত্তিকরে, সমাজকে ভেঙেচুরে নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা
করে নি।
১৭৫৭র পর থেকেই ব্রিটিশদের মুঘলদেরমত শুধুই শাসন করে আশ
মেটেনি, প্রথমথেকেই উদ্দেশ্য ছিল ইংলন্ডের বিকাশ, এবং ভারতবর্ষসহ এশিয়ার আমূল ধংস
প্রক্রিয়া।
তাই যে কোনও মূল্যেই তারা চেষ্টা
করেগিয়েছে, প্রথমে বাঙলা, পরে ভারতের নানান স্থানের সম্পদ আহরণ করে, ভারতের বিকশিত
প্রযুক্তি আর জ্ঞাণ দখল করে, ভারতের শিল্পউত্পাদন, ভারতের চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থা
সমূলে ধংস করে এক বিকশিত সভ্যতা থেকে
অধস্তন দেশ হিসেবে গড়ে তোলার। পলাশির পর প্রথম ৭০ বছর লুঠতরাজি চালাবার পর ভারত এবং
তার মধ্যবিত্তকে নিজেদের দর্শণে পাখিপড়ারমতকরে গড়ে তুলেছে।
১৯০বছরের শাসন ব্যবস্থায় দেশ স্বাধীণ হয়েও ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত বিপুল সংখ্যক
মধ্যবিত্ত আজও বিশ্বাস করে ব্রিটিশের ভারত শাসনের আগে ভারত এক গরীব পিছিয়ে পড়া
দেশ ছিল, ব্রিটিশরা না এলে ভারত পড়ে থাকত মধ্যযুগে, তথাকথিত নতুন প্রযুক্তি আর
সমাজের বিকাশ ঘটত না। ব্রিটিশ যে শিক্ষাব্যবস্থার বীজ রোপণ করে গিয়েছে, সেই
বীজ আজ মহীরূহ হয়ে শহরে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং
প্রফুল্লচন্দ্রের লেখার ছত্রে ছত্রে গ্রামীণদের প্যাসিভভাবে দেখানোর চেষ্টা রয়েছে।
No comments:
Post a Comment