এই প্রেক্ষিতে আমাদের
আলোচনা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ভারতে এসে শিল্প স্থাপন করার কথা ভাবছেন। তখন কিন্তু
ব্রিটিশ শাসকেরা শহুরে ভারতীয়দের মনোজগত থেকে বিকেন্দ্রীভূত উৎপাদন আর বিতরন ব্যবস্থা
মুছে ফেলতে সাহায্য করেছে, যাতে সমাজের মেরুদণ্ডকে চিরতরে বাঁকিয়ে দেওয়া যায়। ভারতের সমাজগুলো অবার নতুন করে গড়ে উঠতে না পারে। পলাশীর পর থেকেই সনাতন ভারতের কারখানাগুলোর শ্মশান
যাত্রা শুরু হল। গ্রামীণ বাজার ধংস করা হল। ভারতের বাজার ক্রমশ ব্রিটিশ উত্পাদনে ছেয়ে যায়। একটা মিথিক্যাল প্রচার আছে, উতপাদনের ব্যাপকতায় ভারতের গ্রামশিল্পগুলো
বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। গ্রামীণ ভারতের উতপাদকেরা ১৭৬৩ থেকে লড়াই শুরু করেছে
ফকির-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে একযোগে। যতদিন ব্রিটিশ অত্যাচার সইতে পেরেছে, প্রতিরোধ
করতে পেরেছে ততদিন উৎপাদন করতে পেরেছে গ্রামীণ শিল্প। এটি ঘটেছে ১৮০০ সাল পর্যন্ত।
তার পরের ইতিহাস সকলের জানা।
তারা বুঝেছিল, কখোনো
ভারত আবার তার ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে, তবে সে বিকাশ হবে
ব্রিটিশের দেখানো ধংসমূলক বস্তুবাদী, কেন্দ্রীভূত, বড় পুঁজি নির্ভর, লাভসর্বস্ব
শিল্পবিকাশের দর্শণ অনুসারী। এই
দর্শণে ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন তত্কালীন ব্রিটিশের পরিকল্পনায় চাকরি, দালালি
আর ব্যবসা করে জীবিকা অর্জনে অভ্যস্ত শহুরে মান্যগণ্য বর্ণকুলীনেরা, যাদের
উত্তরাধিরারীরা পলাশীর একশ নব্বই বছর পরে ব্রিটিশ পথে ভারত রাষ্ট্র বিকাশের অধিকার
অর্জন করবেন, প্রায়মৃত ভারতবর্ষীয় সভ্যতার ধংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে। শিল্পায়নের নাম করে, আজকেও কিন্তু সেই ট্রাডিশন আরও
গভীরে পোঁতার ব্যবস্থা চলছে। প্রফুল্লচন্দ্র যে শিল্প স্থাপন করলেন সেটি চেহারায়
পশ্চিমি, কিন্তু তার পরিচালন ব্যবস্থা হল ভারতীয় দর্শন অনুসারী। টুলো পণ্ডিতের বাড়ির সন্তান হয়ে বিদ্যাসাগর
পরোক্ষে এক লাখ পাঠশালা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন, বেদান্ত আর সাংখ্যকে মিথ্যা
দর্শণ ঘোষণা করেছেন, মেকলের অশ্লীল মিনিটে চুপ থেকেছেন। তার পুরস্কারও পেয়েছেন
ঝুলি ভরে। গান্ধীর অনুগামী হয়েও প্রফুল্লচন্দ্র শিল্পবিপ্লবীয় বড় শিল্প তৈরি
করেছেন, সেই কারখানা থেকে রসায়ন তৈরি করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে
সরবরাহ করে নাইট উপাধি পেয়েছেন। সেই তিনিই আবার বিনা বেতনে মাস্টারি করেছেন, বৃহৎ
এক শিল্পের প্রধান হয়েও চেষ্টা করেছেন আর্থিক ভাবে বঞ্চিত থাকতে, যাতে কারখানা আর
কর্মীরা বঞ্চিত না থাকেন। পরের দিকের পরিচালকদের সঙ্গে বিতর্কে সমঝোতা না করেই
ত্যাগ করে এসেছেন নিজের হাতে সাজানো বাগান।
আমাদের দৃষ্টিতে প্রফুল্লচন্দ্র সমঝোতা করেছিলেন। আজকের
ভাবনাতে একে যদিও সমঝোতা বলা যাবে না। সমঝোতা মানুষই করে, আবার সেই সমঝোতা থেকে সে
কি করে উত্তীর্ণ হয়, সেই লড়াইের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে উত্তরনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যারা নিজেদের ছোট ছোট লড়াইয়ের মধ্যে থেকেও “বাধ্য” হই সমঝোতা
করতে। তারপরে বিবেকের দংশনে বিদ্ধ হই, বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমরা আদতে এই মানুষদের দিকে
তাকিয়ে থাকি। তাদের লেখা থেকে সেই উত্তরনের রসদ সংগ্রহ করে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ
করার কথা ভাবি। প্রফুল্লচন্দ্র আমাদের কাছেই এরকম একজন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরা এক
কর্মযোগী, যিনি নিজের জীবনে সমঝোতা করেও বারবার তা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার রাস্তা
খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, বারবার বাংলা মায়ের আঁচল ধরে তাঁর অধীতবিদ্যা কিভাবে
কাজে লাগে তার চেষ্টা করে গিয়েছেন। এই পুস্তকটির স্বার্থকতা সেইখানেই। রবীনবাবু
যদিও সরাসরি সেই দিকগুলো উল্লেখ করেননি, কিন্তু সেই দিকগুলোয় চিনির সিরার প্রলেপ
দেওয়ারও চেষ্টা করেননি। এমন প্রায় নির্মোহ আইডল সম্পর্কিত বই বাংলা বৌদ্ধিক জগতের
প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment