ব্রিটিশ সরকার দেশের অকেন্দ্রীভূত
শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে, এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার বীজ রোপণ করে গিয়েছিল, যে
ব্যবস্থায় ভারতের বাস্তব সামাজিক পরিস্থিতির বিন্দুমাত্রও যোগাযোগ ছিলনা। যোগাযোগ থাকুক এমন
কেনো উদ্দেশ্যও তাদের ছিল না।
তত্কালীন বঙ্গের মহাবলীরা যে সময় হিন্দু কালেজে ব্রিটিশ পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেছেন,
তাঁরাও বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছিলেন কীনা সে বিষয়ে অনেকেই অনেক কথা লিখেছেন। সমস্যা হল, যে সব বামপন্থী, ডানপন্থী অথবা মধ্যপন্থী
গবেষক এই বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তারা ভারতীয় প্রগতিকে দেখেছেন ব্রিটিশিয়
শিল্পবিপ্লবীয় প্রগতির মাপকাঠিতে।
ফলে কোম্পানি আমলে দেশের মানুষ যখন স্বাধীণতা ঘোষণা করছেন, যখন গ্রামে গ্রামে সেনা
দিয়ে কর সংগ্রহ চলছে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে উদ্ভুত নব্য জমিদারদের লেঠেলরা রক্ত
হোলি খেলে দেশের সমাজ-শিল্পধংসের পরিকল্পনায় মাতোয়ারা, শিল্পভিত্তিক গ্রামের পর
গ্রাম মানুষ বাপদাদার বৃত্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে মজুরে পরিণত হচ্ছে, ভারতের অকেন্দ্রিকৃত
সমাজের পরিকাঠামো ভেঙে যখন ব্রিটিশিয় নানান পরিকাঠামোর বীজ বোণা হচ্ছে, তখনকার
অবস্থা বিশ্লেষণে গবেষকেরা হাহুতাশ করছেন যে, কেন বড় শিল্প স্থাপনে ভারতের ধণীরা
উদ্যোগী হচ্ছেন না, ভারত তথা বাঙলার সমাজ ভেঙে কেন ব্রিটেনের সমাজের মতকরে ভারত
তথা বাঙলাকে গড়ে তোলা হচ্ছে না।
ডান, বাম,
সাবঅল্টার্ণ সব ঐতিহাসিক-গবেষকই ব্রিটিশ তথা ইওরোপের বিকাশের পথকেই একমাত্র
বিকাশের পথরূপেই দেখেছেন। সাবঅল্টার্ণরা বলছেন
ব্রিটিশেরা ভারতে অমিত অত্যাচার চালিয়েছে, ব্রিটিশেরা যাকে ডাকাত বলেছে, তাকে আমরা
স্বাধীণতা সংগ্রামী বলছি। সাধুবাদযোগ্য
প্রকল্প। কিন্তু, এর সঙ্গে সঙ্গে
এটাও হয়ত পরোক্ষে মানতে বলছেন, ব্রিটিশদের তৈরি করা প্রায় সবকটি পরিকাঠামো, দর্শণ,
আধুনিকতা, প্রগতিশীলতার লক্ষণযুক্ত।
আমলাতন্ত্র, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থার আদতেই কিন্তু সাম্যের ধারণা
ভিত্তিকরেই গড়ে উঠেছে। ভারতে সার্বজনীক
সাম্যএর ধারণাটি পশ্চিমের কাছ থেকে পেয়েছে, এ তথ্য লেখকদের ই-মেল করে দাবি করেছেন
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহন।
ফলে দেশের গ্রামীণ মানুষ এক তিমিরে ভাবছেন, জীবন ধারণ করছেন, ঠিক বিপরীতে শহুরে,
উচ্চবর্ণ অথবা পড়াশোনা করে প্রায়উচ্চবর্ণ হয়ে ওঠা মানুষেরা ইংরেজি পদ্ধতিকেই
নিজেদের সমাজ বিকাশের মোক্ষরূপে ভাবছেন। ব্রিটিশ এককেন্দ্রিক দর্শণ চারিয়ে যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি ইংরেজি জানা
মানুষের মধ্যে।
ইওরোপিয়রা(আজও) বুঝতেই
পারছে না, তারা যে উন্নত দর্শনধারী জীবনযাত্রা দয়া করে বহন করে এই পোড়া ভারতকে
উন্নত করতে এসেছে, তাকে গ্রামীণ ভারত নিচ্ছে না কেন! এই কারণেই পর্তুগিজদের সময়
থেকেই গ্রামীণ ভারতের জাতপাতে ডুবে থাকার তত্ব ভেসে ভেসে উঠছিল। ক্ষমতায় ছিলনা,
তাই সামাজিক হার্মাদি চালাতে পারে নি। ভারত দখল করে ব্রিটিশ জ্ঞানীরা সেই তত্বকে
অসম্ভব উদ্যমে, ঘষে মেজে ভারত বিশ্লেষণের কুড় হিসেবে ব্যবহার করলেন। আজও, সেই
তত্ববিনা ভারতের সমাজবিশ্লেষণ পূর্ণ হয় না। যেহেতু গ্রামীণ ভারত ইওরোপিয়
জীবনযাত্রার পদ্ধতি আপন করে নেয় নি, তাই নানান সময়ের ভারত বিশ্লেষণে, ইতিহাস রচনায়
কল্পিতভাবে নানান সমাজ, ধর্মকে লড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কখনো বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে
ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, কখনও আবার এক সমাজের সঙ্গে অন্য সমাজ। তবুও গ্রামভারত ভাঙা
যাচ্ছেনা। তাই কী নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদের জিগির তুলছেন রবীনবাবু!
আশ্চর্যের কথা নয় যে
মানুষটি নিজের সমস্ত সম্পদ বিলিয়ে দিলেন নিজের মতো করে দেশকে জানতে, দেশ সেবায়,
তিনি ভারত সমাজ বিশ্লেষণে ঔপনিবেশিক ভারত চর্চার পথ ধরলেন। তিনি শেষ বয়স পর্যন্ত
স্পষ্ট মনে করতেন একমাত্র ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতিতেই চরিত্র গঠন হয়, দেশিয়(ব্রিটিশ-পূর্ব)
পদ্ধতিতে হয় না(ইটন, রাগবী, হ্যারো
প্রভৃতি মত ইংরাজী স্কুলে ... ছেলেরা এমন অনেক কিছু শিখে, যাহা অমুল্য এবং যাহার
ফলে তাহাদের চরিত্র গঠিত হয়। বই পড়িয়া যাহা শেখা যায় না, এরূপ সব বিষয়ে সেখানে
তাহারা শিখে। ওয়াটারলুর যুদ্ধ ইটন স্কুলের ক্রীড়াক্ষেত্রেই জিত হইয়াছিল –
ওয়েলিংটনের এই উক্তির মধ্যে অনেকখানি সত্য নিহিত আছে। এই সব স্কুলের হেডমাষ্টারদের
অনেক সময় বিশপের পদে অথবা অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজের মাষ্টারের পদে উন্নতি হয়।
এইরূপ স্কুলে একজন আর্নল্ড – অন্ততপক্ষে বাটলারের – গর্ব করিতে পারে। কিন্তু
বাঙ্গালী ছেলেরা সাধারনত যে সব স্কুলে পড়ে, তাহাদের এমন কোন সুবিধা নাই)। আমরা যেন মনে রাখি, তাঁর জীবনের নানান টানা পড়েনের কথা।
তিনি যতটা ব্রিটিশ সাহিত্য, ব্রিটিশ শিল্প, ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যাবস্থায় মুগ্ধ,
ব্রিটিশ বৌদ্ধিকতায় প্রভাবিত, ততটাই আবার চরকাবন্ধু, গান্ধীতে নিবেদিত। সিপাহি স্বাধীনতা সংগ্রামের
পক্ষে যুক্তি সাজিয়ে সংগ্রামী ভাষণ দিচ্ছেন, নাইট উপাধি পাওয়ার রাতেই ভাষণ দিচ্ছেন
রাওউলাট আইনের বিরুদ্ধে, একই সঙ্গে লর্ড ক্লাইভের সিপাহি স্বাধীনতাসংগ্রাম(আজও
বিদ্রোহ বলব!!!) দমন করতে ভারতে আসার মিথটি সগৌরবে বিবৃত করছেন(“সিপাহি বিদ্রোহ
আরম্ভ হইয়াছে। স্যর কলিন ক্যাম্পবেল(পরে লর্ড ক্লাইভ) তখন ছুটিতে আছেন এবং
এডিনবার্গ ফিলজফিক্যাল ইন্সটিটিউটে বসিয়া সংবাদপ্ত্র পড়িতেছেন। ইন্ডিয়া অফিস হইতে
তারযোগে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিনি ভারতে যুদ্ধে যাইতে প্রস্তুত আছেন কিনা?
তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন “হ্যাঁ”। কয়েক মিনিটের পরেই আবার তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা
হইল, কখন তিনি যাত্রা করবার জন্য প্রস্তুত হইবেন? তিনি উত্তর দিলেন “এই মুহূর্তে””।)।
কেন্দ্রিভুত সামরিক দর্শনের প্রতিধ্বনি। তিনি চরকার দর্শনকে প্রাধান্য দিচ্ছেন,
কিন্তু পুঁজি নির্ভর বৃহত শিল্প গড়তে তাঁর উতসাহের শেষ নেই, তেমনি মিল পিতাপুত্রের
বিষয়েও স্পর্শকাতর(“বঙ্গদর্শনএর...প্রাধান বিশেষত্ব ছিল জন স্টুয়ার্ট মিলের
আত্মচরিত অনুবাদ। উহা আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিল”।)।
গ্রামভারত বিশ্লেষণে তাঁর
আইডলএর যুক্তিকে হুবহু মান্যতা দিলেন রবীনবাবু – তাঁর ঢাল হল ব্রাহ্মণ্যবাদ। অথচ আমরা এর আগেই আলোচনা করে দেখেছি, অন্তত ব্রিটিশ
পূর্ব কালে, গ্রামীণ বাঙলায় ব্রাহ্মণদের রমরমা ছিল না। সেটি এসেছে ১৭৫৭র পর। শহরে
বল্লালি অতিচার, অভিচার আজকের ভাষায় প্রান্তিক ঘটনামাত্র, কেননা তখনও জ্ঞান চর্চার
কেন্দ্র শহর নয়। গ্রামের অবদান শহরের থেকে অনেক বেশী। গ্রাম প্রশাসনে শহরের ভূমিকা
খুবই কম ছিল। আমাদের এইটুকুই ফরিয়াদ।
পাঠশালের অন্যতম প্রোডাক্ট ঈশ্বরচন্দ্র যেমন অ্যাডামের শিক্ষা সমীক্ষা থেকে মুখ
ঘুরিয়ে পরোক্ষে বাংলা-বিহারের গ্রামশিক্ষাব্যবস্থাকে খুন করেছিলেন, চারকার গুণগান
করে বাংলার জন্য জীবন সমর্পণ করা প্রফুল্লচন্দ্রও অ্যাডামের সমীক্ষাটি উল্টিয়েও
দেখলেন না। আমরা
মনেকরি, বাঙলায় ব্রাহ্মন্যবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে ব্রিটিশ শাসনের পর থেকে, যখন ভারতবিকাশের
কেন্দ্রাবিন্দুকে, গ্রাম থেকে নগরে উঠিয়ে নিয়ে আসা হল। প্রায়োজন ছিল ঔপনিবেশিক শাসানের সময়ের তথাকথিত মহাজনদের কাজের ব্যবচ্ছেদ।
সেটি করে উঠতে পারাগেল না। হয়ত প্রফুল্লচন্দ্রই পারতেন এই কাজটি করতে।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস,
যিনি বাংলার চরকা বিষয়ে বিশদ লিখতে গিয়ে(“কৃষির পরেই সূতাকাটা ও বস্ত্র বয়ন ভরতের
জতীয় ব্যবস্থা। সমস্ত কাটুনীই স্ত্রীলোক এবং জেলার(পটনা সহর ও বিহার জেলা) ডাঃ বুকাননের গণনা মতে
তাহাদের সংখ্যা ৩,৩০,৪২৬। ইহাদের অধিকাংশ কেবল বিকালে কয়েকঘন্টা মাত্র সূতা কাটে এবং প্রত্যেকে গড়ে
বার্ষিক ৭ আনা ৮ পাই মূল্যের সূতা কাটে। সুতরাং এই সমস্ত কাটুনীদের কাটা সূতার মোট মূল্য আনুমানিক(বার্ষিক) ২৩,৬৭,২৭৭। এইভাবে হিসাব করিলে দেখযায় ইহাদের সূতাকাটার জন্য
প্রয়োজনীয় কাঁচা তূলার মূল্য ১২,৮৬,২৭২ টাকা এবং কাটুনীদের
মোট লাভ থাকে ১০,৮১,০০৫ টাকা অর্থত প্রত্যেক কটুনীর বার্ষিক লাভ গড়ে সাড়ে তিন
আনা। ...সূতাকাটা ও বস্ত্র বয়ন সীহাবাদ জেলার প্রধান জাতীয় ব্যবসা। এই জেলার প্রায় ১,৫৯,৫০০ জন স্ত্রীলোক
সূতাকাটার কাজে নিযুক্ত আছে এবং তাহাদের উত্পন্ন সূতার মোট মূল্য বার্ষিক ১২,৫০,০০০ টাকা। ...পূর্ণিয়া জেলা সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, - কার্পাস বস্ত্র বয়নকারীর সংখ্যা বিস্তর
এবং তাহারা গ্রামের লোকেদের ব্যবহারের জন্য মোটা কাপড় বুনে। সূক্ষ্ম বুনিবার জন্য সাড়ে তিন হাজার তাঁত আছে। তাহাতে ৫,০৬,০০০ টাকা মূল্যের বস্ত্র উত্পন্ন হয় এবং মোট ১,৪৯,০০০ টাকা লাভ হয় অর্থাত্
প্রত্যেক তাঁতে বার্ষিক গড়ে ৮৭ শিলিং লাভ হয়। মোটা কাপড় বুনিবার জন্য ১০ হাজার তাঁত নিযুক্ত আছে এবং
তাহাদের উত্পন্ন কাপড়ের মূল্য ১০,৮৯,৫০০ এবং মোট ৩,২৪,০০০ টাকা লাভ হয়, অর্থাত প্রত্যেক তাঁতে বার্ষিক গড়ে ৬৫ শিলিং লাভ হয়। রমেশ দত্ত কৃত ভারতের আর্থিক ইতিহাস গ্রন্থ হইতে এই সমস্ত
বিবরণের কিয়দংশ উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি উপসংহারে বলিয়াছেন – উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদ পর্যন্ত নানা শিল্প কার্যে নিযুক্ত ছিল। লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোক সূতা কাটিয়া জীবিকার্জন করিত”) সাধারণ মানুষের জীবিকার
কথা, ভারতের গ্রামভিত্তিক শিল্পের কথা অসীম মমতায় উল্লেখ করেন, তিনি অবশ্যই অ্যাডামের
শিক্ষা সমীক্ষার প্রভাবিত হতেন, এবং গ্রাম বাংলাকে নতুনভাবে দেখার উদ্যম নিতেন।
আসলে বাংলা বা ভারতের
আজকের দুর্গতির জন্য ভারতীয়দের দায়ী করার জ্ঞানচর্চার যে ইতিহাস উপনিবেশ তৈরি করেছে
তাকে নতুন করে প্রশ্ন করার সময় আজও বোধহয় আসেনি। প্রফুল্লচন্দ্রতো অনেক আগের
ব্যাক্তিত্ব। ঐতিহাসিক,
সমাজতাত্বিকেরা বাংলার নবজাগরণের সমালোচনা করলেন, বাঙলার উদ্যোগীরা বড় শিল্পএর দিকে
অগ্রসর হলেন না কেন সেই প্রশ্ন তুলে। বাঙলায় কেন পুঁজি পুঞ্জিভূত হলনা তাই নিয়ে
হাহুতাশের শেষ নেই। বাংলা ইওরোপের মত করে কেন বেড়ে ওঠেনি সেই দিকটা বারবার উঠে
এসেছে তাদের লেখায়। গণতন্ত্রের নামে ভারতে বিকশিত গ্রামভিত্তিক পঞ্চায়েতি গণতন্ত্রের
শেকড় উপড়িয়ে ফেলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল,
ভারতকে টেনে হেঁচড়ে ভারিশিল্প বিকাশভিত্তিক উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া হল, ভারতীয়
জ্ঞানচর্চাকে সমূলে উপড়ে ফেলে, পশ্চিমি জ্ঞানচর্চাকে ভারতে স্বীকৃতি দেওয়া হল, সেই
দিকগুলি সকলেই সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। কেননা পুঁজিভিত্তিক বৃহৎ শিল্পই প্রগতির
অন্যতম হাতিয়ার। আর পুঁজি এসেছে প্রথমে আমেরিকা, আফ্রিকা, পরে বাংলা আর ভারত লুঠের
সম্পদে। এ প্রসঙ্গে ১৯১৩কে ভিত্তিবর্ষ ধরে ব্রিটেনের জিডিপি(যারা জিডিপিকে বিকাশের পরিপুরক মনে
করেন তাদের জন্য) বিকাশের ইতিবৃত্ত – ১৭২০-২১ – ২.১, ১৭৬০-৬১ – ২.৬, ১৭৭০-৭১ – ৩.৩,, ১৭৮০-৮১ – ৩.৫, ১৭৯০-৯১ – ৪.৬, ১৮০০-০১ – ৫.৭, ১৮১০-১১ – ৭.১, ১৮২০-২১ – ৯.৭, ১৮৩০-৩১ – ১৮.৩, ১৮৪০-৪১ – ১৯.৬(সুত্রঃ বিনয় ঘোষ,
বাঙলার নবজাগরণ)। লক্ষ্য করুন ১৮০০র
পর থেকে জিডিপি ৫এর উর্ধমুখী আর ৩০এর পর লাফিয়ে দুই অংক ছাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে
কুড়ির ঘরে প্রবেশ করেছে।
পলাশীর পরের বাংলা আর
ভারতজুড়ে যে অবর্ণনীয় লুঠ, খুন, অত্যাচার আর বিশিল্পায়ন এবং তাঁর ফল ইয়োরোপে
শিল্পায়ন, এই কার্য কারণ সম্পর্ককে চাপা দিতেই কি উপনিবেশের এই প্রচেষ্টা? মেকলে,
ম্যাক্সমুলার, মিল, হিল অথবা ডাফের ভারত সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় কুত্সাকান্ড পুরোপুরি
প্রশ্রয় সমর্থন পেয়েছে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের। ভারতীয় দেশজ জ্ঞাণচর্চার বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব্যগুলিকে বিশ্লেষণ করতে
গিয়ে তারা এগুলির তকমা দিচ্ছেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর। ইওরোপিয়তত্ব সমান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী সমান প্রগতিশীলতা, আজকের
স্বতঃসিদ্ধ এবং সাধারণজ্ঞাণীয় এই সমীকরণটি ততদিনে কলকাতার মাটিতে শেকড় গজিয়েছে। প্রফুল্লচন্দ্র সেই শেকড়ের রসে বেড়ে উঠেছেন সেটিও সমান সত্য।
বাঙালি পন্ডিত-ঘরের জ্ঞাণী-পন্ডিত, টোলে পড়া, হটু আর হটি বিদ্যালঙ্কারের বংশধর,
অন্যপথে জীবনধারণকরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শিক্ষা কাউন্সিলের সেক্রেটারি
মোয়াটকে ভারতের বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শণ সম্বন্ধে লিখলেন, for
certain reasons which it is needless to state here, we are obliged to continue
the teaching of the Vedanta and Sankhya in the Sanscrit College. That the Vedanta and Sankhya are false systems of
Philisophy is no more a matter of diapute(সুত্রঃ বিনয় ঘোষ- বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ)। এই চিঠিটির ১২৫ বছর পর পরম
বামপন্থী বিনয় ঘোষ বলছেন(বিদ্যাসাগর ও ততকালীন বঙ্গসমাজ), বেদান্ত ও সাংখ্য যে ভ্রান্তদর্শণ তাতে কোনও
সন্দেহ নেই, এরকম মন্তব্য করারমত সত্সাহস বিদ্যাসাগরের যুগে তো দূরের কথা, তার
জন্মের দেড়শ বছর পরে আজকের দিনেও কজন ভারতীয় শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতের অথবা আধুনিক
সুশিক্ষিত বিদ্বানদের আছে বলা যায় না।
হয়ত এই সৎসাহসের
বিনিময়ে বিদ্যাসাগর ছাপার ব্যবসার প্রথম বরাতটি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে পেলেন। বন্ধু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের থেকে ৬০০ টাকা ধারে
সংস্কৃত ডিপজিটরি ছাপাখানা খুলে মূলধনী মূল্যের সমপরিমান অর্থের, অর্থাত ৬ টাকা
মূল্যের ভারতচন্দ্রের ১০০টি অন্নদামঙ্গল বইএর সরবরাহের বরাত পেয়েছেন। টোলবাড়ির সন্তানকে এই
সৎসাহস প্রদর্শনের সঙ্গে মেকলের অশ্লীল কটুক্তিতে নীরব থাকতে হয়েছে। দেশের সর্বজনীন গণশিক্ষাব্যবস্থা ধংস করে শহুরে
বাঙালিদের জন্য ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাবও পেশ করতে হয়েছে। রবীনবাবু অন্যধারার
চিন্তাবিদ। ১৩৩ পৃষ্ঠায় রবীনবাবু প্রশ্ন করছেন, আচার্যর লেখাগুলোকে কী আমরা
প্রাদেশিকতা বলব? আমাদের দৃষ্টিতে এই লেখাগুলোয় উপনিবেশিক চিন্তার ফসল। গান্ধিবাদি
প্রফুল্লচন্দ্র ব্রিটিশদের তৈরি চিন্তা কাঠামোর বাইরে বেরোতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে ছোট্ট কিছু কথা। মেকলে
যে পড়াশোনার পদ্ধতি তৈরি করে দিয়ে
গিয়েছেন, আমরা যারা ইংরেজি শিক্ষিত, আজও ছোটবেলা থেকেই উপনিবেশের তৈরি করে দেওয়া
পথেই নিজেদের ভাবনাকে ঢেলে নিতে থাকি। সেই
দর্শনকে প্রশ্ন করা, তার দিকে নতুন দৃষ্টিতে তাকানোর ভাবনা খুব একটা মাথায় আসে না।
প্রফুল্লচন্দ্র অনেক ধাক্কার পরে, গ্রামের দিকে নজর ফেরাচ্ছিলেন। শেষ বয়সে গান্ধীর
ভাবনা যে তাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল, তা তাঁর নানান রচনা থেকে পরিষ্কার।
কিন্তু শহর আমাদের অজান্তেই, আমাদের থেকে অনেক বোধ কেড়ে নেয়। গ্রামে বেড়েওঠা
সত্ত্বেও শহরে এসে অনেকেই নানান দেশি বাস্তবতা ভুলে যেতে ভালোবাসি। কোনও আঘাতে কেউ
কেউ হয়ত নতুন করে গ্রাম দর্শন ফিরে পান। অধিকাংশের সেই বোধটুকুও জাগে না।
বিদ্যাসাগর, রামমোহনের আত্মসমর্পণ এর বড় প্রমাণ। শহুরে মনন আজও উপনিবেশের অঙ্গুলি
হেলনে চলে।
বাল্যবয়স থেকে মেকলের উপনিবেশবাদের কল্যাণে তিনি বেড়ে উঠেছেন, শেষ বয়স পর্যন্ত সেই
দর্শনের প্রভাব প্রফুল্লচন্দ্রের মনোজগতে ছেয়ে ছিল। আমাদের কাছে এটাই বাস্তব। তিনি
অতিমানব ছিলেন না। তাঁর সীমাবদ্ধতা নিয়েই তিনি আমাদের কাছে প্রফুল্লচন্দ্র। রবীনবাবু
সার্ধশতবর্ষে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র... অধ্যায়ে স্পষ্টই বলছেন স্যর উপাধি পেয়েছেন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরকারকে নাইট্রিক অ্যাসিড সরবরাহ করার পুরস্কার স্বরূপ। রবীন্দ্রনথের
মতো তিনি নাইটহুড ত্যাগ করতে পারেন নি। তবুও সেই ঔপনিবেশিক উপাধি বহন করে আচার্য
যেসব কাজ করেছেন, করার চেষ্টা করেছেন, যেসব লেখা লিখেছেন তার প্রতিঘাতে আজও বিস্মিত
হতে হয়।
No comments:
Post a Comment