আলীগড় জার্নাল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ১৯৮৬এর বসন্ত
সংখ্যায় ইউ সি শর্মার সম্পাদনায় একটি প্রবন্ধ, দ্য সোর্সেস অ্যান্ড অথরশিপ অব দ্য
যুক্তিকল্পতরু, প্রকাশিত হয়। লেখক শ্রীরামুল রাজেশ্বর শর্মা । এই প্রবন্ধে নানান
যুক্তি তর্ক উল্লেখ করে সম্পাদক, এবং লেখক শ্রীরামুল রাজেশ্বর শর্মা এই সিদ্ধান্তে
উপনীত হচ্ছেন যে, এই পুঁথিটি রাজা ভোজের রচনা নয়। লেখক, তাঁর প্রবন্ধে যে
যুক্তিগুলি ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে দিচ্ছেন, সেগুলি এবারে পরপর সাজান গেল-
১। ইতিহাসের প্রমান রাজা ভোজ বহু
ধরণের বিষয় নিয়ে বহু পুঁথি রচনা করেছেন। কিন্তু যুক্তির পরের লেখা কোনও রচনায় এই
পুঁথিটির উল্লেখ নেই। এই পুঁথিটি প্রথম আবিষ্কার করেন ১৮৭১এ রাজা রাজেন্দ্রলাল
মিত্র(নোটস অন সংস্কৃত মানুস্ক্রিপ্ট। এছাড়াও ইন্দো-আরিয়ান্সএ, ফার্নিচার, ডোমেস্টিক ইউটেনসিলস, মিউজিক্যাল
ইন্সট্রুমেন্টস, আর্মস, হরসেস অ্যান্ড কারস ইন অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া শীর্ষক
প্রবন্ধ রচনার সময় তিনি যুক্তি থেকে নানান তথ্য ব্যাবহার করেছেন)। রাজেন্দ্রলালের
বক্তব্য ছিল এটি ভোজের সময়ের অনেক পরে লেখা হয়েছে। কিন্তু যুক্তির তিনটি পুঁথি ধরে
১৯১৭তে ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্রীর সম্পাদনায় প্রকাশিত পুস্তকএর(যুক্তিকল্পতরুহ
মহারাজাশ্রীভোজবিরচিতহ, ক্যালকাটা ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ) সংস্কৃত ভাষায় লেখা
মুখবন্ধে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে এই রচনাটির কৃতিত্ব রাজা ভোজকে অর্পণ করেন। সেই
মুখবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন Aufreche(Theodor Aufreche, Catalogus
Catalogorum, Leipzig, 1891) এর সেই কুখ্যাত উদ্ধৃতি, ভোজের নামে
যে কয়টি পুঁথি বাজারে চলছে, তাঁর একটিরও রচনাকার রাজা ভোজ নন, হয় তাঁর সময়ের কোনও
লেখক অথবা তাঁর পরের সময়ের কোনও যশস্বী। ঈশ্বরচন্দ্রএর বক্তব্য, ভোজের অন্য সব
রচনা অন্য গুপ্ত লেখকের হলেও হতেপারে, কিন্তু যুক্তিটি অবশ্যই রাজা ভোজ রচনা করেন।
উল্লেখ্য, শাস্ত্রিজি পুঁথিতে যা দেখেছেন, সেটিই তিনি ছেপেছেন। যেহেতু তিনি
পুঁথিটি সম্পাদনা করেন নি, পুঁথিটি বিশ্লেষণ করেননি, ফলে অনেক সময় তিনি পথভ্রষ্ট
হয়ে অদ্যন্ত ভুল তথ্য উল্লেখ করে গিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন তাতে ভবিষ্যতে
গবেষকদের বেশ অসুবিধাই হয়েছে।
তবুও ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে
যুক্তির অন্য একটি স্থান রয়েছে। প্রায় এক হাজার বছর পূর্বের ভারত সমাজের নানান
ব্যাবহারিক বিষয় নিয়ে যেহেতু এটিতে বিশদে আলোচনা রয়েছে, ফলে ভারতেতিহাসের
জিজ্ঞাসুদের সামনে যুক্তি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সন্দর্ভ।
যদিও পুঁথির শুরু আর শেষ পৃষ্ঠায়
রচয়িতা হিসেবে রাজা ভোজের নামোল্লেখ রয়েছে, কিন্তু পুঁথিবিদরা যখন খুব খুঁটিয়ে
যুক্তি পড়ছেন, তখনই সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। যুক্তির পাশাপাশি ভোজরাজের
সমরাঙ্গনসুত্রধর(এখন থেকে সুত্র)কে রাখাযাক। প্রথম পুঁথিতে পাঁচটি যুক্তি বরাদ্দ
রয়েছে স্থাপত্যবিদ্যায় – দ্বন্দ্বযুক্তি, নাগরীযুক্তি, বাস্তুযুক্তি, রাজগৃহযুক্তি
আর গ্রহযুক্তি। দ্বন্দ্বযুক্তি আলোচনা করেছে দুর্গ বিষয়ে। ভারতীয় কোনও জ্ঞানচর্চার
ইতিহাসে দুর্গের সমনাম দ্বন্দ্ব নয়। মধ্য ভারতেতো নয়ই। এটি যুক্তির একটি বিশেষত্ব।
পি এ মানকড ১৯৯৩-৩৬এ, অ্যানালস অব দ্য ভান্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইন্সিটিউটে,
সমরাঙ্গনসুত্রধর অ্যান্ড যুক্তিকল্পতরুঃ হোয়েদার দিজ ওয়ার্ক্স আর প্রোডাকসনস অব
ওয়ান অ্যান্ড দ্য সেম কিং ভোজ অব ধারা নগরী নামে, দুটি পুঁথিকে পাশাপাশি রেখে
তাদের বিষয়, রচনাশৈলী, ভাষা, প্রযুক্তিগত টার্ম, পরিমাপের একক, স্থাপত্যের নিদান
ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ তুলনা টেনে একটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর
বক্তব্য হল এই দুটির একটি যদি রাজা ভোজের হয়, তবে অন্যটি কোনোভাবেই তাঁর রচনা হতে
পারে না।
নানান শ্লোক বিশ্লেষণ করে দেখা
যাচ্ছে, যুক্তি এমন কিছু উদ্ধৃতির উল্লেখ
করছে, যা নিঃসন্দেহে ভোজের সময়ের পরের রচনা। বিশেষকরে মনিমুক্তা বিষয়ের অধ্যায়টি।
এই অধ্যায়টি পুঁথিটির সব থেকে বড়, ৪৮০টি শ্লোক বিশিষ্ট। অগস্ত্যসংহিতা ছাড়া,
রত্নপরীক্ষা বিষয়ে যত রকম পুঁথি রয়েছে, সেগুলির থেকেও এই অধ্যায়টি বেশ বড়। এখানে
গরুড়পুরাণএর উল্লেখ রয়েছে ১২ বার। বাস্তবে গরুড়পুরাণ থেকে ১৬০টি শ্লোক সরাসরি
তুলেছে যুক্তি। ৫টি শ্লোকে বিষ্ণুধর্মোত্তর থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই শ্লোকগুলি
আসলে বিনষ্ট হয়ে যাওয়া অগ্নিপুরাণের। একটি শ্লোকে বিষ্ণুধর্মোত্তর এবং গরুড়পুরাণ
দুটিরই উল্লেখ রয়েছে। রত্নপরীক্ষার এই অধ্যায়টি পদ্মরাগপরীক্ষা এবং বজ্রপরীক্ষা,
এই দুটি বিভাগে বিভক্ত। এটি যুক্তিগুলিকে, যুক্তিকল্পতরুর যে পদ্ধতি,
উপকরণযুক্তিতে ভাগ না করে, অধ্যায়গুলি, আসলে যার নাম যুক্তি, সেগুলি উদ্দেশ্যতে
ভাগ করা হয়েছে। এই প্রবণতাটি গরুড়পুরাণ থেকে ধার করা।
আর সি হাজরার প্রবন্ধ, ইজ দ্য
যুক্তিকল্পতরু আ ওয়ার্ক অব ভোজ(প্রফেসর পি কে গোদে কমেমোরেশন ভল্যুম, এম এম পাটকর
আর এইচ এল হারিয়াপ্পার সম্পাদনা, পুনা, ১৯৬০)এ, ভোজ রাজের পুঁথি রচনার ভঙ্গীতে
অগ্নি আর গরুড়পুরানের দীর্ঘ ছায়া দেখতে পেয়েছেন। তিনি বলছেন এই দুটি পূর্ব ভারতের
তান্ত্রিকদের রচনা। অগ্নিপুরান রচিত হয়েছিল নবম শতাব্দীতে। অগ্নিপুরান কিন্তু অনেক
পরে ভারতীয় জ্ঞানচর্চার নানান ধারায় উল্লিখিত হয়েছে শুধু নয়, এটি বাংলার বাইরে খুব
একটা পরিচিতও পুরানও নয়, অনেক স্থানে এটি স্বীকৃতও বাংলাতেই ষোড়শ শতাব্দীর পরে এটি
সীমাবদ্ধভাবে প্রচলন হয়, বাংলার বাইরে অনেক পরে। সপ্তদশ শতকের পরে এটি বাংলার
বাইরে পরিচিত হতে থাকে। আর সি হাজরার যুক্তি হল, এটি রাজা ভোজের রচনা নয়। হয় তাঁর সময়ের কোনও অনুগামীর রচনা, নয়ত তাঁর সময়ের পরের কোনও অনামা বাঙ্গালী তান্ত্রিকের অমর হওয়ার পরিকল্পনা।
এখানে আরও একটি তথ্য উল্লেখ্য,
রত্নপরীক্ষা অধ্যায়টি কিন্তু শুধু গরুড়পুরাণএর অবদান এমন নয়। রত্নপরীক্ষা প্রথম
রচনা করেন বুদ্ধভট্ট, পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শতাব্দীতে। এর শুরুতেই ত্রিরত্ন এবং জিনএর
প্রতি শ্রদ্ধা জানআনও হয়েছে। গরুড়পুরাণএর রচয়িতা বৌদ্ধ চিহ্নগুলি লুপ্ত করে দিয়ে
পুরো রত্নপরীক্ষাটি গরুড়পুরাণএ টুকেদেন।
যুক্তিতে, চালুক্য রাজা, ভূলোকমল্ল তৃতীয় সোমেশ্বরদেবএর মানসোল্লাস থেকে
নব্বইটি শ্লোক নেওয়া হয়েছে। মানসোল্লাস(বা অভিলাষীতর্থচিন্তামনি নামেও পরিচিত)
রচনার তারিখ নিশ্চিত করা গিয়েছে। সোমেশ্বরদেবএর পিতৃব্য আহভামল্ল প্রথম
সোমেশ্বরদেব ভোজ জয় করেন। এই রচনাটি ১১২৯এর ২২ মার্চ শেষ হয়। ফলে মানসোল্লাস থেকে
ভোজ রাজা এটি নিতে পারেন না। উলটোটাও হওয়া সম্ভব নয়। সোমেশ্বরদেবএর রত্ন সম্বন্ধীয়
রচনা অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ, মেদহীন, লেখকের প্রজ্ঞার সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। অন্য দিকে
যুক্তির ভাষা অনেক শিথিল, একই কথা, তথ্য অনেক বার ঘুরে ফিরে এসেছে। ১০৭ নম্বর
পৃষ্ঠার ৪৩ নম্বর শ্লোকের প্রথম অংশ গরুড়পুরাণএর এবং দ্বিতীয় অংশ মানসোল্লাস থেকে
নেওয়া। এছাড়াও আকরিক হিরের গড়নে বলা হয়েছে, ছটি কোণ, আঁটটি দল বারটি ধারা বিশিষ্ট।
এটিকে চার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে। ৯৮ পাতায় বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ এবনহ
অগ্নিপুরাণ থেকে, ৯৭ পাতার ৫৩ নম্বরটি গরুড়পুরাণ থেকে এবং ৫৪ নম্বরটি মানসোল্লাস
থেকে নেওয়া।
দ্বিতিয়তঃ সোমেশ্বর প্রত্যেক প্রত্যেক
অধ্যায় শেষ করেছেন নিজের নামের ধুয়ো দিয়ে, যেমন এবম দোষা গুনাহ প্রোক্তাবজ্রানম
সোমাভূজ। যুক্তির রচনাকার, একই শ্লোকের সেই ধুয়ায় সোমেসশ্বরএর নামটি তুলতে ভুলেই
গেছেন, পুরো শ্লোকটিই তুলেছেন।
১৯১২তে রাধাকুমুদ মুখার্জী আ হিস্ট্রি
অব ইন্ডিয়ান শিপিং লিখছেন। তিনি যুক্তির নৌযান বিভাগটি অবশ্যই দেখেছেন। তিনি মনেকরছেন
রাজহস্ত শব্দটিতে রাজা শব্দটি ১৬ হাত(কিউবিট = হস্ত) নির্দেশ করে। পরে তিনি, নোট্স
অন হিন্দু শিপিং প্রবন্ধে এটিকে সংশোধন করে ১০ হস্ত পরিমাপ বলছেন।
শেষ পর্যন্ত আমাদের হাজরা মশাইএর তত্ব অবলম্বন করতে হয়। যুক্তির গুহ্য
লেখকটি চতুর্দশ শতকের রচনাকার। তিনি অবশ্যই পূর্ব ভারতের বাসিন্দা। বাংলার
অধিবাসীও হতে পারেন। এছাড়াও যুক্তির রচনাকার বলছেন পাশ্চাত্য দেশের নৌযানগুলি
অপকৃষ্ট বিভাগের। একমাত্র পূর্বা ভারতের বাসিন্দারা এই যুক্তি দিতে পারেন।
প্রত্যেকটি পুঁথি বাংলা অক্ষরে লেখা। এছাড়াও গামারি কাঠ দিয়ে লে কোনও কিছু তৈরির
নিদান আসলে পূর্ব ভারতের কাঠ কর্মীদের প্রিয়। এছাড়াও মাছরাঙ্গা পাখির উল্লেখ পূর্ব
ভারতের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। এছাড়াও যুক্তি বাংলার আরো একটি লুপ্তপ্রায় আয়ুর্বেদ পুঁথি
লৌহপ্রদীপএর উল্লেখ এই ধারনাকে আরো প্রতিষ্ঠা করে।
শেষ প্রশ্ন, যুক্তিতে বারবার ভোজ রাজের
ধুয়া তোলা হয়েছে। কিন্তু রচনাটি কি সত্যি ভোজ রাজের? রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলছেন যুক্তিতে
যে ভোজ রাজার কথা বলা হচ্ছে তিনি হয়ত ধারার রাজা ভোজ। হাজরামশাইও তাই বলছেন। এটি
হয়ত ভোজ রাজের রচনা নয়, কোনও অনামি লেখক যিনি ভোজসহ বহু গ্রন্থের লেখা ধার করে
প্রখ্যাত রাজার নামে চালিয়েছেন। পরের দিকে শাকির আলি দেখিয়েছেন, ভোজের নামে যে
কয়টি পুঁথি প্রচলিত আছে, সেখানে ভোজের নামে কোনও ধুয়া নেই।
No comments:
Post a Comment