এবারে দ্বিতিয় ফরিয়াদ। সবুজ ও স্থিতিশীল রসায়ন শিল্পের
অগ্রদূত অধ্যায়টিতে বেঙ্গল কেমিক্যাল গড়ে তোলার তাত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করেছেন
রবীনবাবু। সেই
বিতর্কে যাওয়ার আগে একলপ্তে বাঙলায় পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসটা সংক্ষেপে
বুঝে নেওয়া যাক। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা মাধব মল্লিকের
জোড়াসাঁকো বাড়িতে ডেভিড হেয়ারের সম্বর্ধনার আয়োজন করেন ১৮৩১ খৃঃ ৬ ফেব্রুয়ারী,
তাঁর জন্মদিনে। সেখানে হেয়ার ভারতের
তথাকথিত অনুন্নতির নিদান দেন পশ্চিমি শিক্ষা প্রসারের। প্যারীচাঁদ মিত্রের ডেভিড হেয়ারের জীবনী থেকে হেয়াররের বক্তব্যের
সারমর্ম্ম তুলে দেওয়া গেল- এদেশে আসিয়া
দেখিলাম যে, এখানে নানানপ্রকার দ্রব্যাদি উত্পন্ন হইতেছে, ভূমির উত্পাদিকা ও
অর্থপ্রদ শক্তি অক্ষয়, লোক সকলও বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী এবং অন্যান্য সভ্যদেশের
লোকদিগের ন্যায় ক্ষমতাবান কিন্তু বহুকালাবিধি কু-শাসন ও প্রজাপীড়ন হেতু এদেশ
একেবারে অজ্ঞানতার আবৃত হইয়াছে।
এদেশের অবস্থা সংশোধন জন্য ইওরোপীয় বিদ্যা ও বিজ্ঞানশাস্ত্র প্রচার আবশ্যক বোধ
হইতেছে। যে বীজ আমা কর্তৃক উপ্ত
হইয়াছে, তাহা এখন বৃক্ষরূপে স্বপ্রকাশ – উত্কৃষ্ট
ফল প্রদান করিতেছে এবং তাহার লক্ষী আমার চতুষ্পার্শে রহিয়াছে। এর তিন দশক পরেই রাণীর
অভয়হস্ত মাথায় নিয়ে অক্ষয় কুমার দত্ত(ভারত ত বহুদিন হইতেই পরহস্তগত হইয়েছে,
কিন্তু নরপিশাচ নাদের শাহ ও উচ্ছৃঙ্খল আরঙ্গজেবের ন্যায় শাসকগণ ও সর্ব্বগ্রাসী
বণিকদিগের হস্ত হইতে যে নিস্কৃতি পাইয়া মহারাণীর হস্তে আসিয়াছে, ইহা ভারতবাসী অল্প
সৌভাগ্যের বিষয় নয়। মহারাণীর কালে আমাদিগের কোন কোন বিষয়ে যে প্রভূত উন্নতি হইয়াছে, তাহার
সন্দেহ নাই – অক্ষয় কুমার দত্ত,
প্রাচীণ হিন্দুগণের সমুদ্র যাত্রা) ভারত সাম্রাজ্যে বেকনিয় মানসিকতা(স্পিরিট)র
মানুষ চাইলেন।
শিল্পবিপ্লবীয়
বিজ্ঞাণের প্রবক্তা বেকনের রচনায় মানবসমাজ অথবা প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রবল হিংসারভাব
প্রকাশ পেয়েছে। বেকনিয়
তত্ব চারিয়ে গিয়েছিল নবজাগরণের প্রবক্তাদের মধ্যে। পশ্চিমি বিজ্ঞাণচর্চার আচরণের মধ্যেই রয়েছে হিংসার মূলশর্ত। তথাকথিত কুসংস্কারের সুতিকাগার ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চাকে
সরিয়ে রাখা হল। ব্যাঙ অথবা খরগোশ জ্যান্ত প্রস্থচ্ছেদ করে জ্ঞাণ আহরণের চেষ্টা
অথবা মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে ওযুধের কার্যকারিতার প্রমাণ সংগ্রহ অথবা সামরিক
মারণবিজ্ঞাণ-প্রযুক্তির বলে বলীয়ান ভোপাল, নাগাসাকি অথবা চেরনোবিল তৈরি করে লাখো
মানুষের শ্মশান সৃষ্টিকরার পথ দেখিয়েছে বেকনিয় বিজ্ঞান।
অথচ ভারতের জ্ঞানচর্চার পথ ছিল অহিংস। সে পথ হেকিমি, জৈন অথবা বৌদ্ধ অথবা অন্যকোনও দেশি
পদ্ধতি হোক না কেন। নবজাগরণের শুরুর সময় থেকের
মানবমুখীন, পৃথিবী বাঁচানো, পরস্পরকে শ্রদ্ধা করার জ্ঞাণচর্চার প্রমাণিত প্রচেষ্টাগুলোকে
আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলা হল, হয় কুসংস্কারের নাম করে, নয়ত প্রাচীণ, অনাধুনিক ছাপ
দিয়ে। পশ্চিমি মানবতাহীন
বৈজ্ঞাণিক জ্ঞাণচর্চার বিকাশের দর্শণের দিকে ভারতীয় জ্ঞাণচর্চাকে সবলে হিঁচড়ে
টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মের অর্ধশতক আগে থেকে। রেনেসাঁর জয়গানের মধ্যে দিয়ে শুরু হল প্রকৃতি ধংসকারী
বেকনীয়তত্বে শিল্পবিপ্লব আপন করার পথ।
ছোট গ্রামীণ উৎপাদন ব্যাবস্থা থেকে দৈত্যসম কারখানা স্থাপনের প্রচেষ্টার দর্শন
পথের বদল ঘটল শহুরে বাঙালির মনোজগতে।
অক্ষয় কুমারের উদ্দেশ্য তিনটি। প্রথম ভারতীয় অহিংস জ্ঞাণচর্চায় পশ্চিমি
জ্ঞাণচর্চার হিংসাশ্রয়ী প্রযুক্তি বিকাশের পথের অনুপ্রবেশ, দ্বিতীয় ভারতীয়
জ্ঞাণচর্চার প্রমাণিত ইতিহাসের মূল উত্পাটন করে পশ্চিমি পথের বৈধতা দেওন, তৃতীয়
দুর্দম প্রকৃতিকে সবলে নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতিকে, প্রাকৃতিক সম্পদ ছাপ্পাদিয়ে অবাধ
লুন্ঠনের দর্শনকে মান্যতা দেওয়া।
ব্রিটেনের রয়েল সোসাইটির হনুকরণে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন
অব কাল্টিভেশন অব সায়েন্সএর প্রতিষ্ঠা করলেন মহেন্দ্রলাল সরকার। এই প্রথম বিদেশিয় প্রথায় সংঘ তৈরি করে দেশিয় বিজ্ঞান
চর্চার পরম্পরাকে মুছে ফেলার কাজের শুরু। এর অনেক আগে থেকেই ইওরোপে পশ্চিমি প্রযুক্তি, পশ্চিমী উপায়ে শিল্প স্থাপন
প্রকৃতি ধংসের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
ভারতে সে উদ্যমের মুখড়া দেখা গিয়েছে দ্বারকানাথের খনি আর রেল লাইন পাতার উদ্যমের
মধ্যে। সমস্তটাই ইওরোপের
জ্ঞাণচর্চার ইতিহাসকে বিশ্বজ্ঞাণচর্চার ইতিহাসরূপে বৈধতা দিতে সাম্রাজ্যের
জ্ঞাণাঞ্জণ লাঠ্যৌষধি প্রকল্প। এই
প্রকল্পেই সমাধি ঘটবে দেশজ বিজ্ঞাণচর্চার দীর্ঘ ইতিহাসের ধারা। এঙ্গেলস বলেছেন ভারতের সভ্যতার তুলনায় পশ্চিম উন্নত ছিল
তাই ভারতের ওপর ব্রিটেন রাজত্ব করেছে।
এতবড় অনৃতভাষণ ভারত আজও সোনামুখে গিলছে। মহেন্দ্রলাল কালিকে নগ্ন সাঁওতালি রমণী বললেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সগর্বে সেই তথ্য উপন্যাসে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করে
পশ্চিমধন্য হলেন। আজও বাঙলায় তাত্বিক
নিরাপত্তার কাঁটাবেড়ার সংরক্ষণ আর নিরাপত্তা পেয়ে আসছেন সাম্রাজ্যেরবন্ধু
রামমোহন, দ্বারকানাথ, বিদ্যাসাগর, মহেন্দ্রলালবেয়ে সুনীল গাঙ্গুলিও। দেশজ রসায়ণচর্চারপ্রতি নিবেদিতপ্রাণ প্রফুল্ল রায়মশাই
শিল্পবিপ্লবের মহত বেকনিয় মনোভাবের স্বপ্নে গড়ে তুললেন বিশালতম বেঙ্গল কেমিক্যাল। বহিরাঙ্গে দেশজ কিন্তু অন্তরে পশ্চিমের অনুকরণপ্রিয়তায়
আত্মগর্বী। ১৯১৬তে জগদীশচন্দ্রের
নাইটহুডের সম্বর্ধনায় রায়মশাই বললেন, If he had taken
out patents for the apparatus and instruments which he had invented, he could
have made millions by their sale. (J.C. BOSE: The Inventor Who Wouldn’t Patent -Prof Rajesh Kochhar, http://www.qsl.net/vu2msy/JCBOSE1.htm)। এর তিন বছর পরে তিনি এই
উপাধিটি পাবেন। তিনি অন্তত নাইটহুডের সরাসরি বিরোধিতা করছেন না। তাঁর মনে যে ঝড়ই
চলুক। বরং তিনি জগদীশ্চন্দ্রকে বলছেন পেটেন্ট করলে রোজগার হবে। অবশ্যই চরম হতাশা
থেকে এই মন্তব্য করছেন। কিন্তু তিনি প্রফুল্লচন্দ্র। তিনি গান্ধী পথ অনুগামী। সেখানেই
ধাক্কা লাগে। মহেন্দ্রলালএর হাত ধরে ভারতের বিজ্ঞান চর্চায় গ্রামীণদের কৃতি আর
দীর্ঘ ইতিহাসকে অস্বীকার করার চেষ্টা হল। এমন অনেক মিথ তৈরির চেষ্টা চলল যাতে
প্রমানিত হয় ততকালীন ভারতে প্রযুক্তিচর্চার রেশ ছিল না। অথচ পাঁচশো বছর আগেও
জেসুইট পাদরিরা অংকবিদ্যা, পর্তুগিজরা চিকিত্সা বিদ্যাসহ ভারতের নানান
জ্ঞাণ-প্রযুক্তি নথিবদ্ধ করে নিয়ে গিয়েছে নিজেদের দেশে।
এ প্রসঙ্গে হয়ত প্রফুল্লচন্দ্রের সমসাময়িক, জগদীশচন্দ্র
বসুর বিজ্ঞানচর্চার পথ খোঁজার ক্ষুদ্র বিবরন আলোচনা বোধহয় খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক
হবে না। প্রথম জীবনে পশ্চিমি বিজ্ঞাণচর্চায় অনুপ্রাণিত জগদীশচন্দ্র, দেশিয়
ইংরেজদের গবেষণা বিরোধিতায় বিরক্ত হয়ে সমস্ত কাজের আর্থিক সম্মতি আদায় করতেন
বিদেশি বন্ধুদের সাহায্যে।
হয়ত ভারতে শাসক ইংরেজরা বুঝতে পারছিল জগদীশ্চন্দ্রের গবেষণা মননটি সেনা প্রস্তুতি
অথবা বড় ব্যবসার অনুকূল নয়। নানান ছোট বড় ধাক্কায় বেসামাল হতে হতে, শুরুর পশ্চিমি
মুগ্ধতায় দেশজ জ্ঞাণের সঙ্গে পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চাকে মেলাবার ভাবনা থেকে সরতে সরতে,
শেষ বয়সে তিনি দেশজ বিজ্ঞাণ ভাবনায় আশ্রয় নিতে চাইছিলেন। তাঁর রচনাগুলি এই পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে। শেষ বয়সে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে আতঙ্কিত হয়ে রেডিও তরঙ্গ গবেষণার ভাবনাটিই
ত্যাগ করেছিলেন। একজনও ছাত্র তৈরি করেননি,
যিনি রোডিও তরঙ্গের আবিষ্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন (More importantly, he would perhaps have become an Indian role-model for
production of wealth through science - J.C.
BOSE: The Inventor Who Wouldn’t Patent - Prof Rajesh Kochhar, http://www.qsl.net/vu2msy/JCBOSE1.htm)।
এই “অবিমৃষ্য” কাজের জন্য রাজেশ কোছার জগদীশচন্দ্রকে
যথেষ্ট অভিশাপমন্দ করেছেন। ঋষি
বলে গালি দিয়েছেন। জগদীশচন্দ্র বড় পুঁজি নির্ভর ব্যবসা বা সেনা উদ্যমের সঙ্গে প্রযুক্তি বা
বিজ্ঞানচর্চা মেলাতে পারতেন না। তিনি হয়ত বুঝেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁর উদ্ভাবনীটি সেনাবাহিনীর খপ্পরে পড়বে,
অথবা বড় পুঁজি সেটিকে নিয়ে যথেচ্ছ মুনাফা কামানোর পরিকাঠামো তৈরি করবে। রাজেশ
কোছারের আফসোস, জগদীশচন্দ্র সেই গবেষণার সুযোগ নিলে ভারত তরঙ্গ গবেষণায় আজ অনেক
দূর এগিয়ে থাকতে পারত। আজকে বুঝতে পারাযাচ্ছে, জগদীশচন্দ্র তাঁর শিকড়ে দাঁড়িয়ে থাকার
দূরদৃষ্টিতে বুঝেছিলেন, উপনিবেশের বিনিয়োগে বিজ্ঞাণ-প্রযুক্তির সাধনার দুটি ফল- ১)
হয় জাতি রাষ্ট্রের যুদ্ধপ্রস্তুতিতে সাহায্য করা, ২) নয়ত প্রকৃতিকে প্রাকৃতিক
সম্পদ হিসেবে ছাপ্পা মেরে তাকে কর্পোরেটদের জন্য আরও বেশিকরে লুঠ, মুনাফার বাজার
তৈরি করা। জগদীশচন্দ্রের
দেশজ শিকড় বোঝার আরও একটা দিক হল, তিনি একটাও আবিষ্কারকে কুক্ষিগত করেননি। সেই আবিস্কার পেটেন্টযোগ্য করে ধনী হতে চাননি। তার প্রযুক্তি ব্যাবহার করে বিশাল বিশাল শিল্প কারখানা
করতে চান নি।
জগদীশচন্দ্রের দুই বান্ধবী সিস্টার নিবেদেতা আর সারা
বুল, আমেরিকায় জগদীশচন্দ্রের বিশেষ এক আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়েছেন।
কিন্তু জগদীশচন্দ্র তার লভ্যাংশ নিতে অস্বীকার করেন (Exasperated by Bose's "quixotic"
approach towards money, two of his lady friends, British-born Margaret Noble
(better known as Sister Nivedita) and American-born Mrs Sara Bull on their own
initiative obtained in 1904 an American patent in Bose's name (for his "
galena single contact-point receiver"). Bose, however, remained unmoved
and refused to encash the patent. The irony of the situation seems to have gone
unnoticed. Here in Nivedita we have a spiritualist advocating the cause of
patents and royalties and a physics professor dismissing the idea. The reason
must be sought in their backgrounds: Nivedita was a product of industrial
Europe while Bose was a child of the orientalised East - J.C. BOSE: The Inventor Who Wouldn’t Patent -Prof Rajesh Kochhar, http://www.qsl.net/vu2msy/JCBOSE1.htm)।
No comments:
Post a Comment