এবারে প্রথম ফরিয়াদ। “ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য” আর “বল্লালি কৌলীন্য”তে(১৩২
পৃষ্ঠা)ই কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি গ্রামীণ জ্ঞানচর্চা। আমরা ভুলেযাই বাংলার সভ্যতা
মুলতঃ গ্রাম ভিত্তিক। যদি কিছু “অবনতির গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত হয়” তবে তা কোম্পানি
আমল থেকে স্বাধীনতার পর পর্যন্ত। গ্রামীণ জ্ঞানচর্চার নির্মূলনের ইতিহাস শুরু
হয়েছে শহরের প্রাধান্যে কোম্পানির আমল থেকে। শহুরে প্রাধান্যর মধ্যেই প্রফুল্লচন্দ্র
কলকাতার পাঠ শেষ করে বিদেশে পাঠ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। তখন বাংলার জ্ঞানচর্চার গৌরব
অস্তমিত। বিশ্বের দ্বিতীয় শহর কলকাতায় তখন ইওরোপিয় জ্ঞাণই একমাত্র বিশ্বজ্ঞাণ। দেশিয় জ্ঞান, কুসংস্কার। দেশিয় জ্ঞাণ-বিদ্যাচর্চা
তাচ্ছিল্য করতেন পাশ্চাত্যমতের সংস্কারবাদী শিক্ষিতরা। হিন্দু কালেজে পাঁচটাকা দরে(১৮২০ সালে বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস কলকাতায়
২ টাকা রোজগার করে শহরের খাইখরচা বাদে জমানো অর্থ গ্রামে পাঠাবার পরিকল্পনা
করছিলেন, সুত্রঃ বিনয় ঘোষ) পশ্চিমি জ্ঞাণের আহরণ করাতেই কলকাতার আলাল সমাজ বেতর। দেশি দেখনদারিতে ধোঁয়া দিচ্ছেন সাগরপারের সাহেব পাদ্রি
ডাফ, হেব্বাররা। ধংস
আর লুঠের সুরা পানে মাতাল বিদেশিরা। তাঁর ছিটেফোঁটা সিন্দুকে পুরে, সাম্রাজ্যের
বাতিল মদ্যভাণ্ড শুঁকে মাতলামির ভান করছেন দেশিয় সংস্কারবাদীরা। বিদ্যাসাগরের
নেতৃত্বে বাংলা-বিহারের দেশি পাঠশালা, বিদ্যালয়ের গঙ্গাযাত্রা করিয়ে দিয়েছেন
ইয়ংবেঙ্গলী দল। কোম্পানি
প্রশাসকদের সরাসরি নজরদারিতে, তাদেরই তৈরি করা এজেন্ডা নির্ভর করে সংস্কারকর্ম
চলছে কলকাতায়। শহরের আত্মসমর্পণের বিপরীতে, ১৭৬৩ থেকে রচিত হয়েছে গ্রামীণ বাংলার
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট। গভর্নর হাউস, ফোর্ট উইলিয়মস আর রাইটার্সদের প্রশাসনিক ভবন থেকে, সকৌতুকে
ভারতীয়দের প্রাণপন ইওরোপিয় হয়ে ওঠার, সাম্রাজ্যের বন্ধু হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা দেখছেন
সাম্রাজ্যবাদী বিদ্বান আর প্রশাসকমহল।
এমনই এক সময়ের চার দশক পরে আমাদের আলোচ্য মানুষটির বাল্য
আর যৌবন। সেই আবহে তাঁর মনোজগৎ গড়ে উঠছে। কিভাবে? যৌবনে কোন কোন বইএর প্রভাবে তিনি প্রভাবিত হচ্ছেন, সেই দিকটি জানা
জরুরি। রবীনবাবু লেখনীগুলোতে এই দিকটি উহ্য থেকে গিয়েছে। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর জীবনী, আত্মকথায় বিশদে বলছেন সেই
তথ্য। এমনকি যৌবনে পড়া কোন কোন বই, তাঁকে তাঁর পরিনত বয়সেও মুগ্ধ করে রেখেছিল তাও
তিনি উল্লেখ করেছেন। সেই বিশদ তালিকা তাঁর
মনের কাঠামোকে, তাঁর ভারত বিশ্লেষণ বুঝতে সাহায্য করবে।
প্রফুল্লচন্দ্র ইওরোপে পড়াশোনা সাঙ্গ করে, সেখানে চাকরি
না করে ভারতে ফিরে আসছেন, বাংলায় কিছু করতে। পরিনত
বয়সেও তাঁর মনে ইওরোপিয় ধারার শিক্ষা ব্যাবস্থার আদর্শ গেঁথে গিয়েছিল। যৌবনে তৎকালীন কলকাতার ইওরোপিয় বই পড়ার ফ্যাশনের সঙ্গে তাল রেখে পড়ছেন লেথব্রিজের
সিলেকসান্স ফ্রম মডার্ন ইংলিশ লিটারেচার এবং গোল্ডস্মিথের ভাইকার অব ওয়েকফিল্ড।
জর্জ ইলিয়টের Secenes from Clerical Life তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর দাবি, জনসনের
রাসেলসের প্রথম স্তবক তিনি শেষ বয়সেও অনর্গল আবৃত্তি করতে পারতেন। নাইটের Half-hours
with the Best Authors তাঁকে পথ দেখিয়ে ছিল। যৌবনে জুলিয়াস সীজর,
মারচ্চেন্ট অব ভিনিস এবং হ্যামলেট এর কতগুলি নির্বাচিত অংশ তাঁর সামনে নুতন জগতের
দ্বার খুলে দেয়। প্রিঙ্খিপিয়া ল্যাটিনা “আমার জীবনের গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছিল”। পরে ফ্রেঞ্চ প্রিঙ্খিপিয়াও পড়লেন। কে কে ব্যানার্জীর
এনসাইক্লোপিডিয়া বেঙ্গলেনসিস থেকে Arnold’s Lectures of Roman
History, Rollin’s Ancient History আর Gibbon’s Rome
Empire হইতে নির্বাচিত অংশও পড়েন। রোম সম্রাটের Meditationsও পড়েন। “গিবনের প্রসিদ্ধ রোমক
সম্রাটত্রয়ের চরিত্রচিত্র(হাড্রিয়ান, আন্তনিনাস পিয়াস এবং এবং মার্কাস আরেরলিয়াস –
ইহারা যেন ভগবানের আদেশে পর পর আবির্ভূত হইয়াছিলেন) –
আমার চিন্তাক্লিষ্ট মস্তিস্ককে অনেক সময় শান্ত করিয়াছে। আমার এই পরিণত বয়সেও,
ল্যাবরেটরিতে সমস্ত দিন কাজ করিবার পর আমি লাইব্রেরিতে গিয়া
একঘণ্টা ইতিহাস বা জীবনচরিত পড়িয়া বিশ্রাম লাভ করি, তার
পর ময়দানে ভ্রমণ করিতে যাই”।
তিনি চেম্বারের Biography, মন্ডারের Treasury
of Biographyও পড়লেন। সেখানেই প্রথম রামমোহন রায়ের জীবনী পড়া। প্রফুল্লচন্দ্র বলছেন, “Treasury
of Biographyতে বহু মহৎ লোকের জীবনী আছে, তন্মধ্যে কেবলমাত্র
একজন বাঙ্গালীর জীবনী সন্নিবিষ্ট করিবার যোগ্য বিবেচিত হইয়াছে। ইহা দেখিয়া আমার
মনে বেদনাও হইল”। ...(ছাত্র জীবনে পুরস্কার পাওয়া) “পুস্তকের মধ্যে হ্যাজলিট কর্তৃক সম্পাদিত
সেক্সপিয়রের সমস্ত গ্রন্থাবলী, ইয়ংএর Night Thoughts, ও থ্যাকারের English
Humorists ছিল”। ছাত্রাবস্থায় পড়েছেন মর্লির Burke, আর
বার্কের Reflections on the French Revolution. তাঁর
শিক্ষক কৃষ্ণবিহারী, বায়রন, স্কটকে Apollo’s venal son আখ্যা
দেওয়ায় তিনি দুই কবির লেখা পড়লেন। সঙ্গে আইভানহোও পড়লেন। পড়লেন হোয়াইটের Natural
History of Selborne। পড়ছেন ফ্রুডের
কারলাইলের জীবনচরিত। জনসনের রাসেলাস পড়েছেন। বলছেন ট্রসএর, লাইফ অব ক্রাইষ্ট দ্য
ম্যান, ব্রাহ্মদের খুব প্রিয় ছিল। রেনানের লাইফ অফ জেসাসও পড়েছেন। মারটিনের এন্ডেভার
আফটার দ্য ক্রিশ্চিয়ান লাইফ আর আওয়ারস অব থট, থিওডোর পারকার আর চ্যানিংএর বই তার
খুব প্রিয় ছিল। বিশপ কেলনারের দ্য পেনটাটিউস ক্রিটিক্যালি একজামিনড একমাত্র পড়েন
নি। কিন্তু বিষয়টি কি, তা অন্য বই পড়ে জেনেছেন। কোন কোন বাংলা পত্রিকা বা বই পড়ছেন?
যৌবনে পড়েছেন, বঙ্গদর্শন, সোমপ্রকাশ, অমৃতবাজার পত্রিকা, হিন্দু পেট্রিয়ট, ইন্ডিয়ান
মিরর এবং আর্যদর্শন পত্রিকা। বইগুলোর মধ্যে বিষবৃক্ষ, প্রাফুল্লচন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাল্মীকি ও তাঁহার যুগ, রামদাস সেনের কালিদাসের যুগ। রঘুবংশ, কুমারসম্ভব আর ভট্টিকাব্যের অংশ এছাড়াও রাজেন্দ্রলাল মিত্রের
বিবিধার্থ-সংগ্রহের বাঙ্গালার সেনরাজাগণ, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত ব্যাকরণের
উপক্রমণিকা। হায়রে দুয়োরানী বাংলা। এইটুকুইমাত্র
তাঁর বাংলা আর সংস্কৃতের পাঠ? সময়ের নির্দেশ মেনে পাল্লা ইংরেজির দিকে ভারি।
জীবনীর ওই পাতাগুলো পড়লে মনে হয়, লিখতে লিখতে তাঁর মনে হল ইংরেজি বইগুলোর তালিকা
বড্ড ভারি হয়ে যাচ্ছে, এবার একটু কলম থামিয়ে বাংলা বইগুলোর কথা ভেবেনি। এধরনের
কোনও লেখা যদি কোনও পেছনপাকা ছাত্র, আমার ভাললাগা বই শীর্ষক প্রবন্ধ হিসেবে
মাধ্যমিক শ্রেণীর পরীক্ষায় লিখত, তাহলে অবশ্যই খাতা দেখে বাংলার শিক্ষক তাঁর কান
ধরে বলতেন বাংলায় ফিরে এসো বাবা। বিস্তর যোজন ফাঁক নিয়েই প্রফুল্লচন্দ্ররা প্রফুল্লচন্দ্র
হয়ে উঠেছেন।
নিউটনই যে কলনের জনক, এই সাম্রাজ্যবাদী তত্বে তিনি
যথেষ্ট আস্থা পেশ করছেন। বাবার বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনে জড়িয়ে থেকে
দুর্দশা পোয়ানোও যেমন গভীর গর্বে লিখছেন, তেমনি লিখছেন সাম্রাজ্যের পক্ষে তৈরি করা
নানান মিথ। প্রফুল্লচন্দ্র জন আর জেমস মিলের বড্ড প্রশংসক ছিলেন। বাবা, জেমস মিল
কোম্পানি থেকে অবসরের পর জন মিল ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে প্রবেশ করেন ১৭ বছর বয়সে।
কীভাবে ভারত শাসন-শোষণ করা যাবে তাই নিয়ে তার ভাবনা।
কীভাবে নানান ছলে ভারতীয়দের অধিকার হরণ করা যায়, কতটা লুঠ করা যায়, সে তত্বেরও
পরিচালক তিনি।
তিনি ছিলেন ব্রিটিশ কোম্পানির গোয়োন্দা বাহিনীর মাথা।
১৮২৮এর পর কোম্পানির রাজনৈতিক দপ্তরে স্থান পান – যা আদতে গোয়েন্দাগিরিই। এর পর ১৮৩৬ থেকে ১৮৫৬ তাঁর বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করেই
তৈরি হত রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক কী হবে তার নীতি। ১৮৫৭-৫৮তে
সিপাহি স্বাধীণতা সংগ্রামের পর প্রধাণমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন পার্লামেন্টে
কেম্পানি গুটিয়ে ফেলার আইন আনবেন, তখন তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, কোম্পানির স্বার্থ
রক্ষার জন্য। এমত ভারত কুৎসাকারী মিলেদের ভারত বিশ্লেষণে
প্রফুল্লচন্দ্র যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁর বাঙালির মস্তিষ্ক... রচনায় আর রবীনবাবুর
প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞানবোধ অধ্যায় উজ্জ্বল প্রমান।
No comments:
Post a Comment