শ্রীযুত সমাচার পত্রকার মহাশয়। আমি স্ত্রীলোক অনেক দুঃখ পাইয়া এক পত্র
প্রস্তুত করিয়া পাঠাইতেছি আপনারা দয়া করিয়া আপনারদিগের আপন ২ সমাচারপত্রে প্রকাশ
করিবেন শুনিয়াছি ইহা প্রকাশ হইলে দুঃখ নিবারণকর্ত্তারদিগের কর্ণগোচর হইতে পারিবেক
তাহা হইলে আমার মনস্কামনা সিদ্ধ হইবেক অতয়েব আপনারা আমার এই দরখাস্তপত্র দুঃখিনী
স্ত্রীর লেখা জানিয়া হেয়জ্ঞান করিবেন না।
আমি নিতান্ত অভাগিনী আমার দুঃখের কথা তাবৎ লিখিতে হইলে অনেক কথা লিখিতে হয়।
কিন্তু কিছু লিখি যখন আমার সাড়ে পাঁচ গণ্ডা বয়স তখন বিধবা হইয়াছি কেবল তিন কন্যা
সন্তান হইয়াছিল। বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি আর ঐ তিনটি কন্যা প্রতিপালনের কোন উপায় রাখিয়া
স্বামি মরেন নাই তিনি নানা ব্যবসায়ে কাল যাপন করিতেন আমার গায়ে যে অলঙ্কার ছিল তা
বিক্রয় করিয়া তাঁহার শ্রাদ্ধ করিয়াছিলাম শেষে অনাভাবে কএক প্রাণী মারা পড়িবার
প্রকরণ উপস্থিত হইল তখন বিধাতা আমাকে এমত বুদ্ধি দিলেন যে জাহাতে আমারদিগের প্রাণ
রক্ষা হইতে পারে অর্থাৎ আসনা ও চরকায় সুতা কাটিতে আরম্ভ করিলাম প্রাতঃকালে গৃহকর্ম্ম
অর্থাৎ পাটি ঝাট্টি করিয়া চরকা লইয়া বসিতাম বেলা দুই প্রহর পর্য্যন্ত কাটনা
কাটিতাম প্রায় এক তোলা সুতা কাটিয়া স্নানে যাইতাম স্নান করিয়া রন্ধন করিয়া শ্বশুর
শাশুড়ি আর তিন কন্যাকে ভোজন করাইয়া পরে আমি কিছু খাইয়া সরু টেকো লইয়া আসনা সূতা
কাটিতাম তাহাও প্রায় এক তোলা আন্দাজ কাটিয়া উঠিতাম এইপ্রকার সূতা কাটিয়া তাঁতিরা
বাটীতে আসিয়া টাকায় তিন তোলার দরে চরকার সূতা আর দেড় তোলার দরে সরু আসনা সূতা লইয়া যাইত এবং যত টাকা আগামি
চাহিতাম তৎক্ষণাৎ দিত ইহাতে আমাদের অন্ন বস্ত্রের কোন উদবেগ ছিল না পরে ক্রমে ২ ঐ
কর্ম্মে বড়ই নিপুন হইলাম কএক বৎসরের মধ্যে আমার হাতে সাত গণ্ডা টাকা হইল এক কন্যার
বিবাহ দিলাম ঐ প্রকারে তিন কন্যার বিবাহ দিলাম তাহাতে কুটুম্বতার যে ধারা আছে তাহার
কিছু অন্যথা হইল না রাঁড়ের মেয়্যে বলিয়া কেহ ঘৃনা করিতে পারে নাই কেননা ঘটক
কুলীনকে যাহা দিতে হয় সকলি করিয়াছি ততপরে শ্বশুরের কাল হইল তাঁহার শ্রাদ্ধে এগার
গণ্ডা টাকা খরচ করি তাহা তাঁতিরা আমাকে কর্জ্জ দিয়াছিল দেড় বৎসরের মধ্যে তাহা শোধ
দিলাম কেবল চরকার প্রাসাদাৎ এত পর্য্যন্ত
হইয়া ছিল এক্ষনে তিন বৎসরাব্ধি দুই শাশুড়ি বধূর অন্নাভাব হইয়াছে সূতা কিনিতে তাঁতি
বাটীতে আসা দূরে থাকুক হাটে পাঠাইলে পুর্ব্বাপেক্ষা সিকি দরেও লয় না ইহার কারন কি
কিছুই বুঝিতে পারি না অনেক লোককে জিজ্ঞাসা করিয়াছি অনেকে কহে যে বিলাতি সূতা
বিস্তর আমদানি হইতেছে সেই সকল সূতা তাঁতিরা কিনিয়া কাপড় বুনে। আমার মনে অহঙ্কার
ছিল যে আমার যেমন সূতা এমন কখন বিলাতি সূতা হইবেক না পরে বিলাতি সূতা আনাইয়া
দেখিলাম আমার সূতা হইতে ভাল বটে তাঁহার দর শুনিলাম ৩।৪ টাকা করয়া সের আমি কপালে ঘা
মারিয়া কহিলাম হা বিধাতা আমা হইতে দুখিনি আর আছে পুর্ব্বে বিলাতে তাবৎ লোক বড়
মানুষ বাঙ্গালি সব কাঙ্গালী এক্ষণে বুঝিলাম আমা হইতেও সেখানে কাঙ্গালিনী আছে কেননা
তাঁহারা যে দুঃখ করিয়া এই সূতা প্রস্তুত করিয়াছে সে দুঃখ আমি বিলক্ষণ জানিতে পারিয়াছি
এমত দুঃখের সামগ্রী সেখানকার হাটে বাজারে বিক্রয় হইল না একারণ এ দেশে পাঠাইয়াছেন
এখানেও যদি উত্তম দরে বিক্রয় হইত তবে ক্ষতি ছিল না তাহা না হইয়া কেবল আমারদিগের সর্ব্বনাশ
হইয়াছে সে সূতায় যত বস্ত্রাদি হয় তাহা লোকে দুই মাসও ভালরূপে ব্যবহার করিতে পারে
না গলিয়া যায় অতয়েব সেখনাকার কাটনিদিগকে মিনতি করিয়া বলিতেছি যে আমার এই দরখাস্ত
বিবেচনা করিলে এদেশে সূতা পাঠান উচিত কি অনুচিত জানিতে পারিবেন। শান্তিপুর কোন
দুঃখিনী সূতা কাটনির দরখাস্ত। সং চং
(সমাচার চন্দ্রিকা, ৫ জানুয়ারি ১৮২৮, ২২ পৌষ ১২৩৪)
No comments:
Post a Comment