ভারতে এখনো পঙ্গপালের মত ছড়িয়ে পড়েনি ফাস্ট ফুড চেনেরা। কিন্তু শুরু যা হয়েছে, তা আগামী দিনে যে একশ্রেণীর মানুষের জীবন ধারনের নানান ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারন করতে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে অন্ততঃ আমাদের মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।
যদিও ছোটবেলায় মেদিনীপুরের গ্রামীণদের মুখ থেকে
শোনা একটি আপ্তবাক্য এ প্রসঙ্গে মনে পড়েযাচ্ছে –
কাঠ খেলে আংরা হাগবে। এর শহুরে সংস্করণ, যে(এক্ষেত্রে উচ্চমধ্যবিত্তরা)
ফাস্ট ফুড খাবে সে আমেরিকানদেরমত মোটা হবে, অসুস্থ হবে। কার কি বলার আছে
ভাই!
বিশেষ করে যে দেশগুলোয়
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হবার প্রবণতা বাড়ছে, বাড়তে থাকা মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত
পরিবারে ইংরেজিপনার আদেখলেমো আকাশ ছুঁচ্ছে(সে সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে গরিব
পরিবারের সংখ্যাও) সেদেশের এক শ্রেণীর পরিবারের কাছে ম্যাকডোনাল্ডেরা যেন স্বর্গের
দূত। বইটি ভালভাবে পড়ার পর খুব হতাশও লাগল, আবার আনন্দও। হতাশ এইজন্য যে
মধ্যবিত্ত আমলারা (আজ আর তারা মধ্যবিত্ত নেই। সরাসরি উচ্চবিত্ত
হয়ে গিয়েছে। আমরা মনে করি আজ আর মানসিকভাবে মধ্যবিত্ত, এই
কথাটির কোনও মানে হয় না। এক শ্রেণীর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের, বিশায়নের
সেবাদাস। তাদের এক একজনের মাসে আইনি আয় দেড়লাখ টাকার বেশি। যদি পরিবারে আরও
একজন বা দুজন রোজগেরে হয়, তাহলে বছরে পরিবারের রোজগার ৫০ লাখ ছুঁই ছুঁই। এর মধ্যে সংবাদ জগতে
না ফাঁস হওয়া, বেপরোয়া আয়ের কথা ধরছি না। এর পরে আপনি যদি আমাকে
বকুনি দিয়ে বলেন, তুমি কেন আমলাদের মধ্যবিত্ত বললে, তখন সত্যিই কিছু বলার নেই) এমন
ধরনের খাদ্য নীতি বানাচ্ছেন যাতে দেশে এধরনের অপচয়ী, অসাশ্রয়ী, লুঠেরা, পকেট কাটা,
কর্মীদের বেতন চুরি করার অর্থনীতির সংস্কৃতি আরও বিকাশ হওয়ার সুযোগ পায়।
আনন্দ লাগছে, আমরা এ আন্দোলনে বইটি পড়ার বহু আগে থেকে
ছিলাম ভেবে। আবার মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নও দেখছি। কেন নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে
হবে না। সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের খাদ্য, পুষ্টি, ভাল থাকা, স্বাস্থ্য কর্পোরেটের হাতে চলে গেলে কি হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমেরিকার ফাস্ট ফুড ক্ষেত্র। তাকে অসম্ভব বাস্তবজনোচিতভাবে তুলে ধরেছেন এরিক তার বইতে।
বইটা আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে অন্ততঃ দুবার পড়ে বুঝলাম, প্রকাশের পর থেকেই এটি কেন প্রচুর বিক্রি হয়েছে। এটি যে কর্পোরেট চাতুরী প্রয়োগ করে, প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে বিজ্ঞাপন আর মারকেটিংয়ের ঠেলায় বিক্রি হয়েছে এমনতো নয়ই। এরিকের অবস্থানটাই কর্পোরেট সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিরোধী – তায় তিনি আমেরিকার সর্বক্ষমতাময় চটজলদি খাবারের কোম্পানির বিরুদ্ধে লিখছেন। আসলে এরিক অনেকের মনের কথা লিখে ফেলেছেন সাহস করে, অনেক পরিশ্রম করে, অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে। বিশেষ করে যে সব মানুষ রাস্তার নানান আন্দোলনে থাকেন না, অফিসে ইউনিয়ন করেন না, যারা খুব একটা কর্পোরেট বিরোধী নন, যারা কর্পোরেট ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত মানে দেশের ব্যবসার উন্নয়ন বোঝেন, যারা দেশে-বিদেশে আমেরিকা রাষ্ট্রের পেশি ফোলানোতে মনে মনে কিছুটা আহ্লাদিত হন, তারাই কখন যেন আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন, যে খাওয়ারটা তাদের বিজ্ঞাপনের মোড়কে পুরে রোজ গেলানো হচ্ছে, তাতে সস্তায় পেট ভরলেও, শরীরের সব দায় মেটেনা। এই ভাবনাটা যখন মাথায় ঘোরাফেরা করে রোজ রোজএর জীবন ধারণে, তখনই চিত্তির ঘটে। কেননা এই মানুষদের কথা শোনা যায় না, এদের মুখ টিভিতে, বা মিছিলে দেখা যায় না। এরা যখন সিদ্ধান্ত নেন তখন সেটি ঘটতে থাকে খুব নীরবে, নিভৃতে কিন্তু দৃঢভাবে।
এদের মনে চটজলদি খাবার নিয়ে কি খুঁতখুঁতোমি নেই? খুব সোনা মুখে, কোনও প্রশ্ন না করে কয়েক প্রজন্ম (চারের দশক থেকে ধরলে অন্তত তিনটেতো বটেই) খেয়েই যাচ্ছে! এটা বিশ্বাস করতে হবে? তাদের উদ্বেগের কথা হয়ত এরিক পথভাঙ্গা বইটিতে তুলে ধরেছেন। আন্দোলনকারীরা উদবুদ্ধ হলে
কিন্তু পরিবর্তন আসে না, সমাজজুড়ে প্রতিবাদ হয় মাত্র। তারা গুটি কয়েক। সেই প্রতিবাদের ভাষা
মাজে মধ্যে সমাজের গভীরে চারিয়ে যায়। এরা,
মুখাবয়বহীনরা তখন যদি মনে করেন, সমাজে পরিবর্তন দরকার, তবেই পরিবর্তন আসে।
হয়ত এরিকের নিশানা কর্পোরেটতন্ত্র। কিন্তু গড় আমেরিকার নাগরিকের ভাবনা দৈনন্দিন পুষ্টির। সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। নিজেদের মত করে কিন্তু এই
ভাবনাটাই ভাবে প্রতিটি মধ্যবিত্ত আমেরিকান পরিবার। সস্তায় কি করে আরেকটু বেশি ভাল খাওয়ার পাওয়া যায় তারই চিন্তা অহরহ কুরে কুরে খায়। এবং এই বইয়ের প্রভাবে আমেরিকায় খওয়ার জগতে যে বিপুল পরিবর্তন এসেছে, সেই নমুনায় কর্পোরেটদের গায়ে জ্বর এসে গিয়েছে।
রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট নাগরিকের সামনে থাকা, তাদের জীবন ধারনের জন্য, কয়েক হাজার বছর ধরে বিকশিত, প্রয়োজনীয় নানান বৈচিত্র ধংস করতে করতে, বিশেষ একটি মনোলিথকে নানান ধরণের মোড়ক করে বাজারে ছেড়ে তাকে বহুত্ববাদ বলে চালাতে চায়। যেমন ভারতের শহুরেদের রান্নাঘরের জ্বালানিতে ঘটেছে। কয়েক দশক আগেও মধ্যবিত্তের হেঁসেলে ছিল কাঠ, কয়লা, কেরোসিন স্টোভ, গুল, ঘুঁটে, কাঠকয়লা, ইলেকট্রিক হিটার, ইকমিক কুকার, ধোঁয়ার উনুন এরকম হয়ত আরও কিছু রান্নার উপায়। এরা যে কখন সব প্রায় বাদ হয়ে গিয়েছে দূষণের
দায়ভার মাথায় নিয়ে, উন্নয়নের কাজে বলি প্রদত্ত হয়ে। সে সামাজিক শূন্যতার
হিসেব আজ পর্যন্ত করা হয় নি। এ বিলুপ্তির দায় আমার আপনার সকলের। দোকানের কেরসিন তেলের
লাইন ছোট হয়েছে। পাড়ার একটার পর একটা কয়লার দোকান উঠে গিয়েছে। কয়লার এখন ঠাঁই হয়েছে
কর্পোরেটদের পণ্য তৈরির হেঁসেলে আর সংবাদ মাধ্যমে কোলগেট শিরোনামে।
No comments:
Post a Comment