এরই মধ্যে, সেই শূন্যতা
প্রতিস্থাপন করতে, উন্নয়নের সঙ্গে থাকতে, মধ্যবিত্তের রান্না ঘরে জ্বালানি হিসেবে, নীরবে চলে এল সরবজনমান্য গ্যাস সিলিন্ডার আর দুই চুল্লিওয়ালা গ্যাসের উনুন। হালে ইন্ডাকসন, রাইস কুকার, ওটিজ়ি, ইনফ্রারেড অভেন। ব্যস। পুরোটাই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত রান্নাঘর। তাই গ্যাস সিলিন্ডারের, বিদ্যুতের দাম বাড়লে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সরকার পড় পড় হয়। গ্যাস নির্ভর চুল্লিতে যে ধরণের খাবার রান্না করা যায়, ক্রমশঃ সে ধরণের প্রায় তৈরি খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কৌটো আর নানান মোড়কে ভারতের বাজারে মিলতে শুরু করেছে। মা-পিসি-দিদিমাদের পুরনো সব খাবার সব প্রায় বিলুপ্ত। শহরের সঙ্গে লাগোয়া গ্রামেও একই ঘটনা ঘটছে। ছুতো সময়ের অভাব।
আমেরিকার নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাসে একই ঘটনা ঘটে চলেছে, প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে। রান্নাঘরের খাদ্যাভ্যাসের করপোরেটাইজেসন ঘটিয়ে ফেলেছে আমেরিকা রাষ্ট্র এবং
কর্পোরেট যৌথ উদ্যোগে। এরিক বলছেন কি ভাবে ব্যক্তি ব্যবসায়ীদের চালানো আমেরিকাজোড়া হাজারো ছোট ছোট গরু পোষার র্যাঞ্চ, মুরগির খামার, ছোট রেস্তোরাঁ কর্পোরেটরা উদ্দেশ্যপুরনভাবে ভেঙে দিয়ে কয়েকটামাত্র বিশালকায় জবাই কারখানাভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস তৈরি করিয়েছে। মাংসসহ নানান বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে পয়সা ছড়িয়ে, ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ফলে ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের পুরনো ব্যবসা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন একের পর এক।
আমেরিকার মানুষ বিশ্বাস করে মুরগির সব পুষ্টি তার বুকের মধ্যে। ভারতে আমরা আবার টেংরিতে রয়েছি – রেস্তরাঁয় টেঙরি জুস, লেগ পিসের অর্ডারের রমরমা। ম্যাকডোনাল্ড তাই এমন এক মুরগির প্রজন্ম তৈরি করেছে, যাদের বুক খুব চওড়া, পা বেশ ছোট। আমেরিকার
গবেষণাগারে তৈরি সেই মুরগি সাধারনভাবে, পোষাও যায় না, খোলা বাজারে বিক্রিও হয় না। এখন প্যাকেট ছাড়া সাধারণ মুরগির কোনও অংশ বা পুরো মুরগি পাওয়া যায় না দোকানে। ফলে মোড়ক ছাড়া, খোলা বাজারের সাধারণ মুরগি বা গরুর মাংস খুব কম বাড়িতে রান্না হয়। বাজারে টিনের খাবার সস্তা, পাওয়া যায় হাতের কাছে। রান্নাঘরে খাটনি, হ্যাপা কম। তাই বাড়িতে দোকান থেকে কিনে আনা টিন বা কাগজের মোড়কে মোড়া ঠাণ্ডা খাবার গরম করে খাওয়া। ব্যস। খাওয়া একটি দেশের সংস্কৃতির বিশাল এক অঙ্গ, এই বোধটাই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ কর্পোরেটতন্ত্রের দাপে। আমেরিকায় সে লীলা প্রায় সমাপ্ত। ভারতের হেঁসেলে ইয়োরোপ বা আমেরিকানাইজেসন ক্রমশঃ পূর্ণ হতে খুব বেশি দিন আর বোধহয় বাকি নেই।
এই জন্যই এই বইটি খুব মন দিয়ে পড়া দরকার, কেননা এটি
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে করপোরেটতন্ত্রের জালকে ভীষণভাবে জরুরি আঘাত করে চিনিয়ে দেয়। যদি কেউ আমাদের বলেন
বইটি কি আমেরিকার চটজলদি খাবারের বিষয়ে লেখা! আমরা বলব হ্যাঁ, আবার নাওবটে। হ্যাঁ, বইটির নাম তো
তাই! সত্যিইতো তিনি চটজলদি খাবারের বড় ব্যবসাদারদের রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন শিশুদের
কিভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে খাবারগুলো খাওয়ানো হচ্ছে, তাই বাচ্চারা রোগেভুগছে ইত্যাদি
ইত্যাদি। এসব মেনেও বলছি, নাও বটে! কেন! এই বইটি, হিটম্যানএর মতই
আমাদের চিনিয়েদেয় কর্পোরেটের কাজ করার চাতুরিকে। কর্পোরেটরা কয়েক
হাজার বছরের বিকশিত সরল জীবনকে
রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে গিলেফেলে এক অপচয়ী, অসাশ্রয়ী, লুঠেরা, পকেট কাটা,
কর্মীদের বেতন চুরি করার অর্থনীতির সংস্কৃতি বিকাশ করতে পারল উচ্চমধ্যবিত্তের
সাহায্যে, সেই বিষয়টি আমাদের সামনে অসম্ভব জেদি মানসিকতায়, ফাস্ট ফুডকে সামনে ঢাল
করে রেখে তুলে ধরে চিনিয়ে দিতে পারলেন। আদতে বইটিতে পরোক্ষভাবে কর্পোরেটএর ঘোমটা সরানোর
কাজ করেছেন এরিক। অনমনীয় কিন্তু সাহিত্যিক দক্ষতায়। যে গল্প ১১০ বছর আগে
বলেগিয়েছিলেন দ্য জাঙ্গলে, আপ্টন সিনক্লেয়ার অনমনীয় ঋজুতায়, সাহিত্যিক সততায়, সেই
গল্পকে অতুলনিয়ভাবে নিজের মত করে পাঠককে প্রবন্ধ আকারে উপহার দেন এরিক, দ্য ফাস্ট
ফুড নেশন বইতে।
No comments:
Post a Comment