স্বাধীনতার আগে থেকেই ভারতের মেয়েরা পর্দানশীন ছিলেন, পড়াশোনা জানতেন না, এমন একটা ধারণা, ভারত সম্বন্ধে অনেক ধারনার মতই তৈরি করা হতে থাকে। এবং নবজাগরণের উদ্গাতাদের সৌজন্যে, এবং ব্রিটিশ প্রচারযন্ত্রের প্রভাবে সেই ধারনাটি থানা গেড়ে বসে, বিশেষ করে ব্রিটিশ পথানুগামী, পদানুগামী, উন্নয়ণকামী শহুরেদের মানসিকতায়। সেই ধারণাটি এতই গভীরে পৌঁছে যায় যে আমরা একবারও দেখলাম না যে, বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নানান প্রান্তেও ব্রিটিশ শাসনের আগেও নারীদের জন্যই বিদ্যালয় ছিল। এমনকি যে সমাজ, তাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা নিয়ে নিন্দিত, সেই ইসলামিক শিক্ষা ব্যাবস্থায়, যৌথ পড়াশুনো এবং শুধুই মেয়েদের পড়াশুনো(বিদ্যালয়ভিত্তিক)র ব্যবস্থা ছিল। এ প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোগল যুগে স্ত্রী শিক্ষা এবং মোগল বিদুষী বৈ দুটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। ভারত পথিক ধরমপালজি মধ্যবিত্ত ভারতের অজ্ঞতা কাটানোর জন্য পাঞ্জাব, মাদ্রাজ এবং বাংলার শিক্ষা সমীক্ষা নিয়ে "বিউটিফুল ট্রি" পুস্তকে বিশদে আলোচনা করবেন স্বাধীনতার অনেক পরে। এই সমীক্ষা তিনটি, বিশেষ করে বাংলার অ্যাডামের সমীক্ষায় বহুদিন ধুলো জমছিল। ভারতের পারম্পরিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে স্বাধীনোত্তর আমলে যে সব মিথ্যে ধারণা ছিল, যে সব অদ্ভুত শূন্যতার বোধছিল তাকে ভেঙে দেওয়ার কাজ করলেন তিনি। এমনকি বিদ্যাসাগর মশাই, রামমোহন রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, উইলিয়ম এডামের ১৮৩৬এর সমীক্ষা বা তার আগে ১৮১৮র ওয়ার্ডের শিক্ষা সমীক্ষাও পড়ে দেখেছেন, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আভাস নেই নিজের লেখায় অথবা তাঁর সম্বন্ধীয় রচনাগুলোতেও। ফলে বইদিক যুগের পর থেকে ভারতে মেয়েরা অশিক্ষিত, এই ধারনাটির বোঝা আজও মেয়েরা টেনে চলেছেন।
দীনেশ্চন্দ্র বাংলার গীতিকা সংকলনে, বৃহতবঙ্গে বাংলার মহিলা কেন্দ্রিক সমাজের কথা, মহিলাদের নানান অবদানের কথা বহুভাবে আলোচনা করবেন, বিগত কয়েক দশক ধরে জয়া মিত্র তাঁর নানান রচনায় মহিলাদের সৃষ্টির কথা আলোচনা করে চলেছেন। তবুও আজও এই নতুন সহস্রাব্দের এক দশক পেরিয়ে গিয়ে ২০১৩ সালেও, গ্রামের মহিলারা জ্ঞানী, সৃষ্টিশীল, বাংলার সংস্কৃতির একটি বড় অংশ এই পারম্পরিক মহিলাদের সচেতন সৃষ্টি, এমন ধারণার বীজ বেড়ে উঠছে, অথবা সাম্রাজ্যের তৈরি করা, সযত্নে লালিত পারম্পরিক মহিলাদের তত্ব-তথ্য বিষয়ে, শিক্ষিত, সচেতন, পড়াশুনোকরা মধ্যবিত্ত সমাজে খুব একটা ধারণা পাল্টেছে, চার বছর বাংলার নানান সম্পদের জ্ঞানের প্রচারের ব্লগ চালিয়ে, এমন কথা কিন্তু হলপ করে বলতে পারব না। ভারতের নানান বিষয় নিয়ে কাজ করা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ আমলে মহিলাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা নয়ে বলছে, By the late 1800's, education began to be available to at least some women; it was sponsored by educated reformers, missionaries, or the government। এবং এও বলা হল, Women were thought to be especially inclined to favor amulets, talismans, charms, spells, and other practices disdained by the educated। "গরীব" মেয়েদের উপায় নেই(তখনও তথাকথিত ধনীদেশগুলোর ব্রেটনউড সঙ্ঘের বা মিলেনিয়াম উদ্দেশ্য পুরনের উন্নয়নযজ্ঞ শুরু হয় নি, গুরনার মিরডাল এশিয়ান ড্রামা লেখেন নি, তখনও ম্যাকনামারা গরীবকেন্দ্রিক স্লোগান দিয়ে উন্নয়নের তত্বে বিশ্বকে ঋণ দিয়ে ঘেরার কাজ শুরু করেন নি), তাই ব্যঙ্গ করে বলা হল Poorer women, and female servants in richer homes, had no choice but to move about-- especially to wells and riverbanks, for water। (http://www.columbia.edu/itc/mealac/pritchett/00routesdata/1800_1899/women/women.html)।
ব্রিটিশ আমলে খুব উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে পড়াশোনা করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে এই তত্বটি শিশু পাঠ্য করে দেওয়া হয়। এটি শহরে বিপুল প্রচার এবং মান্যতা অর্জন করে। আমরা মধ্যবিত্তরা ভুলে যাই এটি একটি আদ্যোপান্ত সাম্রাজ্যবাদী সূত্র। এবং তাঁর মধ্যবিত্ত মান্যতা তৈরি করা হয়েছে এই রচনাটিকে শিশু পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়েই। এই সঙ্গেই, বেদের কাল বাদ দিলে, ভারতের পারম্পরিক মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার কোনও ধারণা মধ্যবিত্তদের তৈরি করা হয়নি। এই সাম্রাজ্যবাদী ধারণা আর মিথ্যে তত্ব মিলে, নারী মুক্তি হয়ে উঠল, মধ্যবিত্ত পুরুষ, এবং পুরুষতন্ত্র চালানোর এক মসৃণ ককটেল। সাম্রাজ্যবাদ, ধনতন্ত্র, বিশ্বায়ন বলে বিদ্যা অর্জনের সঙ্গে কাজ পাওয়ার সুযোগ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ফলে শহুরে বিদ্যা এবং কাজের জগতে পুরুষদেরই প্রাধান্য। মধ্যবিত্তের মনোজগতে যেহেতু পারম্পরিক নারীদের বিদ্যালয়ে গিয়ে সরকারি সিলমোহরওয়ালা পড়াশুনোর ধারণা নেই, সেহেতু তাদের কাজেরও সুযোগ নেই, এমন এক সমীকরণ রচনা হয়ে গিয়েছিল নবজাগরণের প্রবক্তাদের মধ্যে। ফলে নিয়মিত বিদ্যালয় খোলা এবং তারও বহু পরে শহুরে মহিলাদের কাজ খোঁজাটা বেশ একটি কাজের কাজ হয়ে উঠছিল।
১৯৪৭এর পর ভারতে নারীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে বড্ড বেশ তোড়জোড় আরম্ভ হয়ে যায়। মহিলাদের কাজের সুযোগ বাড়াবার জন্য নানান প্রকল্প গ্রহণও করা হয়। নারিমুক্তি তখন ব্যাপক অঙ্কের প্রকল্প। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকস্তরের কেরিয়ার এবং পুরস্কার পাওয়ার সিঁড়ি। আসল তত্ব খতিয়ে দেখছে কে? ক্ষমতায়নের(মানে কি? ) প্রকল্প তখন নোবেল পর্যন্ত ধাওয়া করেছে। ক্ষমতায়নের চক্করে পড়ে নারীরা বিশ্বায়নের সঙ্গী। ক্ষমতায়নের নামে গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট দল তৈরি করে ছোট ছোট পুঁজি ব্যাঙ্কে জমা করার নোবেলিয় চক্করে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে গ্রামের মেয়েদের। সেই পুঁজিকে বড় পুঁজি খেয়ে ফেলে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে বহু ব্যাঙ্ক, ২০০৮এর বিশ্ব মন্দায় সে তথ্যও খুব দুর্লভ নয়।
কিন্তু আমরা যারা ছোটবেলা থেকেই গ্রামে বড় হয়েছি, বহুদূর গ্রামেই পড়েছি(জেলা শহরেও নয়), এবং বড় হয়ে বেশ কিছু গ্রামের মানুষের তৈরি সংগঠনে যুক্ত হয়ে গ্রামে ঘুরেছি, থেকেছি, সংগঠন করেছি, দেখেছি আসলে, ঐতিহাসিকভাবে বাংলার গ্রামের মহিলারাই কাজ করেন। ৯৩-৯৪ সালে তেহট্টতে শুনেছিলাম, যে মেয়ে বুনতে পারে না, চাষ করতে পারে না, তার বিয়ে হয় না। উত্তরবংগতে এর প্রাসঙ্গিকতা আরও ব্যাপক। আজ যখন গ্রামীণদের এক সংগঠনে থেকে কারু, অভিকর ও বস্ত্র শিল্পীদের সঙ্গে মিলে কাজ করি, দেখি, পরিবারের মেয়েরা কি সচেতনভাবে, দক্ষভাবে, সুচারুভাবে প্রযুক্তি প্রয়োগ করে কাজ করেন, শিল্প সৃষ্টি করেন, সারা দিনের সংসারএর অতুলভার সামলানোর সঙ্গে সঙ্গেই।
তো মোটামুটি এই হল আমাদের কথা। আসলে কাজ খুঁজতে হয় শহরের মানুষকেই, কেননা তারা গ্রামের উৎপাদনের ওপর বসেই তাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিরসন করেন। সেই পারম্পরিক মহিলাদের কাজের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানালাম কয়েকটি ছবি প্রকাশ করে। সূত্র ভারতীয় মেয়েদের পরোক্ষে গালাগালি করা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট।
No comments:
Post a Comment