সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও ছিল
মধ্যযুগীয় বাংলার একটি অন্যতম প্রধান বন্দর এবং দক্ষিণবঙ্গের প্রধান নগরী, ব্যান্ডেল থেকে
চার কিলোমিটার দূরে। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতই,ব্রিটিশদের হাতে পড়ে এই অঞ্চলটি
একটি প্রায়-গুরুত্বহীন হাট-অঞ্চলে পরিণত হয়। পলি
জমে সরস্বতী নদী মজে
যাওয়ায় এই বন্দর-নগরীর পতন ঘটেছিল। তবে পরবর্তীকালে কলকাতা নগরীর বিকাশ ও উত্থানে
সপ্তগ্রামেরও একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। এইচ. ই. এ. কটন লিখেছেন, “সেই সময় এই শহরের মধ্যেই হয়ত ভবিষ্যৎ কলকাতা মহানগরীর নিউক্লিয়াস
লুকিয়ে ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাতগাঁওয়ের বিপরীত দিকের নদীতে পলি পড়ে তার
ভাগ্যকেই উজ্জ্বল করে তুলেছিল।”
ব্যুৎপত্তি
‘সপ্তগ্রাম’ শব্দটির অর্থ সাতটি গ্রাম। এই
গ্রামগুলি হল বাঁশবেড়িয়া, কৃষ্টপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সাম্বচোরা ও বলদঘাটি।
‘সপ্তগ্রাম’ নামটির
ব্যুৎপত্তি প্রসঙ্গে একটি পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। কনৌজের রাজা প্রিয়বন্তের সাত
পুত্র ছিল – অগ্নিত্র, মেধাতিথি,
বপুস্মান, জ্যোতিস্মান, দ্যূতিস্মান, সবন ও ভব্য। এই সাত ভাই রাজকীয়
জীবনে বিতৃষ্ণ হয়ে নিভৃতে ধ্যান করার জন্য উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে বের হন। গঙ্গা,
যমুনা ও সরস্বতী নদীর সংগমস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁরা তাঁদের
কাঙ্ক্ষিত স্থানের সন্ধান পান এবং সেখানকার সাতটি গ্রামে নিজ নিজ আশ্রম স্থাপন
করেন। এইভাবে সেই সাতটি গ্রামকে ঘিরে গড়ে ওঠে সপ্তগ্রাম নগরী।
ভূগোল
কলকাতার ৫০
কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ত্রিবেণীতে সরস্বতী
নদী হুগলি নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এরপর হুগলি নদীর পশ্চিম অববাহিকায় উক্ত
নদীর সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে সরস্বতী।[৪] মনে
করা হয়, সুদূর অতীতে সরস্বতী নদী রূপনারায়ণ
নদের খাতে প্রবাহিত হত। এই রূপনারায়ণের তীরেই
অবস্থিত ছিল প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত বন্দর তাম্রলিপ্ত। সপ্তম
শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে সরস্বতী নদী হুগলি নদীর দিকে তার বর্তমান খাতটিতে সরে আসতে
শুরু করে। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরস্বতী নদী এমন একটি অবস্থায় আসে যে
অবস্থায় ত্রিবেণীতে হুগলি নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে পশ্চিমে হুগলির সমান্তরালে
কিছু পথ অতিক্রম করে বর্তমান গার্ডেনরিচের অপর তীরে বেতরে পুনরায় হুগলিতে এসে
পতিত হয়। এইভাবে সরস্বতী একটি চক্রাকার পথের সৃষ্টি করে। সপ্তগ্রাম বন্দর এই পথের
উত্তরভাগের দক্ষিণ তটে অবস্থিত ছিল।[৫] সপ্তদশ
শতাব্দীতে সরস্বতী নদী মজে যেতে শুরু করে এবং ধীরে নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।[৩]
বখতিয়ার খিলজি যখন
বাংলায় আসেন, তখন তখন বাংলা পাঁচটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল – রাঢ়, বাগড়ি, বঙ্গ, বরেন্দ্র
ও মিথিলা। বঙ্গ
আবার বিভক্ত ছিল তিনটি অঞ্চলে – লক্ষ্মণাবতী, সুবর্ণগ্রাম ও সপ্তগ্রাম। মুঘল
আমলে সপ্তগ্রাম অঞ্চলটি তিনটি প্রশাসনিক
অঞ্চলে বিভক্ত হয় – সাতগাঁও সরকার, সেলিমাবাদ
সরকার ও মান্দারন সরকার।
ইতিহাস
প্রাচীন বাংলা
সাহিত্যে সপ্তগ্রামের বারংবার উল্লেখ থেকে এই বন্দরের খ্যাতির কথা জানা যায়।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত বিপ্রদাস
পিপলাইয়েরমনসামঙ্গল কাব্যে বলা
হয়েছে, চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী
সপ্তগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্রের পথে যেত। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দরামলিখেছেন, সপ্তগ্রাম থেকে বণিকেরা কোথায় না যায়?
সপ্তগ্রাম বন্দরের
প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ১২৯৮ সালে দেবকোটের শাসক বাহরম
ইৎগিন জাফর খান সপ্তগ্রাম জয় করেন। তিনি
এই অঞ্চলের প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের উপাদান সংগ্রহ করে একটি মসজিদ
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর থেকে অনুমিত হয় পূর্ববর্তী হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগেও
সপ্তগ্রাম এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল। উক্ত মসজিদটি
বাংলার প্রথম মসজিদ।
১৩৫০ সালে
বাংলায় তুঘলক শাসনকালে (১৩৩৬–১৩৫৮) ইবন
বতুতা সপ্তগ্রামে এসেছিলেন। বিভিন্ন
বর্ণনা থেকে জানা যায়, সপ্তগ্রামের স্থানীয় বণিকেরা বিদেশে বাণিজ্য
করতে যেতেন না। কিন্তু আরব, পারস্য ও তুরস্ক থেকে
বণিকেরা এখানে বাণিজ্য করতে আসতেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পর্তুগিজ বণিকেরা
সপ্তগ্রামে আসাযাওয়া করতে শুরু করেন।
সপ্তগ্রামে ইউরোপীয়েরা
১৫৩৩ সালে আলফেনসো
ডে মেলো নামে এক পর্তুগিজ পাঁচটি জাহাজ ও একশো
লোক নিয়ে সপ্তগ্রামে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা সুলতানকে প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই সব উপহারসামগ্রী আসলে ছিল চোরাই মাল। সেকথা বুঝতে পেরে খুশি হওয়ার
পরিবর্তে সুলতান তাঁদের বন্দী করেন। এর পরে সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। গোয়ায় পর্তুগিজ
গভর্নরের কাছে খবর পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে
অগ্নিসংযোগ করা হয়। ডায়ানো রেবেলো সসৈন্যে
সপ্তগ্রামে উপস্থিত হন। সুলতান গিয়াসুদ্দিন
মাহমুদ শাহ অবশ্য বিরোধের পথে না গিয়ে বন্দী
পর্তুগিজদের মুক্তি দেন এবং তাঁদের সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রামে বাণিজ্য করার অনুমতি
প্রদান করেন। এর পিছনে অবশ্য সুলতানের অন্য উদ্দেশ্য ছিল। তিনি আসন্ন গৃহবিবাদে
পর্তুগিজদের সমর্থন পেতে চাইছিলেন।
১৫৩৫ সালের
মধ্যেই পর্তুগিজরা সপ্তগ্রামে বসতি স্থাপন করে ফেলেন। শেরশাহ সপ্তগ্রাম
আক্রমণ করলে পর্তুগিজরা সুলতানের পক্ষ নেন। তিনি ১৫৩৮ সালে তাঁরা সৈন্য প্রত্যাহার
করে নেন। এই বছরই সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ পরাজিত হন। শেরশাহের মৃত্যু ও আফগান
প্রাধান্যের অন্ত ঘটলে ১৫৫০ সাল নাগাদ পর্তুগিজরা আবার সপ্তগ্রামে ফিরে আসেন।
পর্যটকদের বিবরণ
থেকে সপ্তগ্রাম নগরীর বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। ভেনিসীয়
পর্যটক সিজার ফ্রেডেরিক ১৫৬৩
থেকে ১৫৮১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রাচ্য ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণ বিবরণী থেকে ভারত
ও বাংলার অনেক শহর ও বন্দরের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, সপ্তগ্রাম বন্দরে ৩০-৩৫টি জাহাজে মাল তোলা হত। পর্তুগিজ পর্যটক টোমে
পাইরেস বাংলায় না এলেও, তাঁর মহান কীর্তি সুমা
ওরিয়েন্টাল গ্রন্থটি তাঁর ভারত ও মালাক্কা ভ্রমণের
(১৫১২-১৫১৫) সময় রচিত হয়। এই গ্রন্থে সমসাময়িক বাংলার কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়।
তিনি লিখেছেন, “এটি (সপ্তগ্রাম) ছিল একটি বড় শহর। এখানে অনেক
বণিক আছেন। এই শহরে নিশ্চয়ই দশ হাজার লোক বাস করেন।” ইংরেজ
পর্যটক-বণিক রালফ ফিচ লেখেন, “উত্তর আফ্রিকার শহরগুলির
তুলনায় সপ্তগ্রাম রূপকথার নগরী।” ১৫৯১ সালে তিনি লন্ডনে
প্রাচ্যবাণিজ্যের সম্ভাবনার কথা শুনিয়ে ঝড় তুলেছিলেন।
পর্তুগিজরা
সপ্তগ্রামকে বলত Porto Pequeno বা
ছোটো পোতাশ্রয় এবং চট্টগ্রামকে বলত Porto Grande মহাপোতাশ্রয়।
নদীতে পলি জমে সপ্তগ্রাম প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একমাত্র আদিগঙ্গার পথ
ধরেই সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচল করতে থাকে। তার উত্তরের জলপথে ছোটো নৌকা ছাড়া আর
কিছুই চলাচল করতে পারে না। নদীর পশ্চিম পাড়ে বেতর গ্রামটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে
খ্যাতি অর্জন করে। অনেক বণিকই সপ্তগ্রাম ছেড়ে হুগলিতে চলে
আসেন। শেঠ ও বসাকেরা চলে আসেন বেতরের অপর পাড়ে গোবিন্দপুর গ্রামে।
অনেক পরে সপ্তগ্রাম
বন্দরের সম্পূর্ণ পতন হলে উত্থান ঘটে কলকাতা মহানগরীর।
প্যারেডের মাঠ(parade ground)
চুঁচুড়ার ডাচ ফাক্টরি(গুদাম)এর মানচিত্র, ১৭২১ (Plan of the Dutch factory at Hooghly-Chinsura in 1721; an engraving)
জেমস মোফাতের আঁকা, কলকাতা থেকে ১৮০৯ সালে প্রকাশিত ছবি, চুঁচুড়ার দক্ষিণ দিক (South view of Chinsura'; quatint with etching by and after James Moffat, published Calcutta 1809)
হুগলীর ব্যারাক, ফিবিগ, ১৮৫১ (The barracks at Hooghly Fiebig 1851)
No comments:
Post a Comment