এই বইতে এরিক এক সত্যি, রক্তমাংসের আমেরিকার গল্প বলছেন। যে গল্প আমরা, যারা গোগ্রাসে মিডিয়া গিলি, তাদের চোখের সামনে কোনোদিনও ভেসে ওঠেনা। আমরা, যারা সংবাদ মাধ্যমের খেলায় নাচি, তারা মনেকরি আমেরিকা মানে সব পেয়েছির দেশ, আমেরিকা মানে অবাধ বানিজ্য, আমেরিকা মানে অতুল বৈভব, আমেরিকা মানে নিজেদের দেশে ধনতন্ত্রের ঘোমটায় সাম্যবাদ, আর বিদেশে সাম্রাজ্যবাদ। অথচ এরিক বর্ণনা করছেন এমন এক সত্যি আমেরিকার কাহিনী যে আমেরিকার খবর আমাদের দেওয়া হয় চিনির সিরার পরত করে। আমরা বুঝিনা এই আমেরিকার প্রচারিত অতুল বৈভবের নিচে লুকিয়ে রাখা কাহিনীর সুতোটা ধরা রয়েছে কর্পোরেট ব্যবসায়িদের হাতে। খুব শক্ত করেই। সেই খেলায় আমেরিকার সরকার একটি বড় ভুমিকা পালন করে – যেন ক্রিকেট খেলার একচোখো আম্পায়ার, যে শুধুই একটি দলকে জেতাতে চায়। সেই কর্পোরেট বনাম কর্পোরেট খেলায় ক্রেতারা শুধুই দর্শকমাত্র। এরিক তার বইতে বেআবরু করেদিয়েছেন এক অজানা আমেরিকার চেহারাকে। হয়ত ২০০৮এর অর্থনীতির বিপুল ধসের পর, বা অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনের পর অনেকের চোখ খুলেছে, কিন্তু সে অনেকটাই আবার উচ্চ শ্রেণীর। তারা অপেক্ষা করে আছে কাদায় পড়া আমেরিকা কবে আবার স্বমূরতিতে ফিরবে, আবারও চাকরির ভিসা নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়া, গ্রিন কার্ড, ডলার রোজগার, দুবার তিনবার
সুটকেস বোঝাই উপহার নিয়ে গরবই ভঙ্গীতে ভারতের বিমান বন্দরে পা দেওয়া।
অথচ এই বইটি একবারও পড়ার সুযোগ অনেকেরই নাও হতে পারে – অন্ততঃ একমাস আগে
পর্যন্ত আমাদের হয় নি। অনেকেই এই বইটির অস্তিত্ব বিষয়ে জানেন না। পড়ার পর আমাদের
আশেপাশে অনেককে বলেছি। তাদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলন করেন, দেশে-বিদেশের
বইটইও পড়েন। তারা কিন্তু এর অস্ত্বিত্বই জানতেন না, জানার পর
গোগ্রাসে গিলেছেন। অনেকের আবার ইন্টারনেটএর সুযোগ নেই যে ডাউনলোড করে পড়েফেলবেন। অনেকেই কম্পুটার চালাতে জানেন না। থাকলেও সড়গড় নন। অনেকের বই কেনার ক্ষমতা, সুযোগ নেই। অনেকে তেমন ইংরেজি জানেন না। কিনলেও পড়তে ঝামেলা। বহু মানুষের ইংরেজি জানার অবস্থা অনেকটা আমাদের মত।
ইংরেজি নিয়ে আমাদের দলের লুকোছাপা নেই। আমাদের দলের অনেকই ইংরেজি এক্কেবারে জানেন না। আমরা মনে করিনা আমাদের, বাঙ্গালীদের ইংরেজি জানা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। জানি না। তাতে লজ্জার কিছু নেই। আমরা তামিল জানিনা, সাঁওতালি জানিনা, রাজবংশি
ভাষাও জানিনা, ইংরেজিও জানিনা। ব্যাস! শুধু ইংরেজি ভাল করে না জানলেই লজ্জায়
অনেকেই মুখ লুকোই। আমরাও একসময় লুকোতাম। পরে বাংলা ঘুরে
বুঝেছি, এদের মত ইংরেজি আরেকটা ভাষামাত্র। ইংরেজি ভাল জানি না, তাই অনেক শহুরে আমাদের অশিক্ষিত বলেন। আমাদের খেদ নেই। পরে কাজ করতে গিয়ে, বাধ্য হয়ে, জীবনের অন্ততঃ দু-তিন দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর, ঢেঁকি গেলার মত করে, ঘাড় ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, ইংরেজি শিখেছি। শিখেছি বললাম। আসলে চলনসই ইংরেজি শিখতে বাধ্যহয়েছি। ছোটবেলা থেকে বকাঝকা, লাঠিঝাঁটা খেয়ে ল্যাটিন অক্ষরগুলো শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। তাই ওইটুকুই পারলাম বলে এরিকের বই, হিটম্যানেরমত বই পড়লাম। তবে খুব বড় লেখা হলে, যেমন হিটম্যানে, এরিকের বইতে হয়েছে, একবার পড়েই পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারি নি। লেখার অনেক কিছু বোঝার জন্য আরও একবার, হয়ত বেশিবার পড়তে হয়। সেই জন্যই এরিককে এক সপ্তাহে দুবার পড়া। এমন নয় যে পড়ার আনন্দে, সাহিত্য মুল্য জেনে বুঝে, দ্বিতীয়বার পড়লাম। পড়লাম বাধ্য হয়ে।
যাই হোক, দ্বিতীয়বার পড়ে মনে হল, এটির অধ্যায় ধরে ধরে একটি সারমর্ম, এবং সঙ্গে বইটি বিষয়ে আমাদের ভাবনাটি যদি প্রথমে আমাদের ব্লগে তুলে দেওয়া যায়, পরে একবার কয়েকশ ছাপানো যায়, তাহলে অনেকেই, যাদের প্রয়োজন, বইটির অন্ততঃ মর্মার্থ জানতে পারবেন। এই সারাংশ তৈরির জন্য
আরও কয়েকবার পড়লাম এরিকের বইটি।
তবুও হয়ত এই লেখায় কিছু কিছু ভাবনার গোলমাল, বেশকিছু
বোঝাবার ভুল থেকে যাবে। তার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
অনেক বড় বড় উদ্ধৃতি ইংরেজিতে দিয়েছি। কেননা এরিক তার
অননুকরণীয় ইংরেজিতে অনেক কিছু বলতে চেয়েছেন, যা বাঙলায় অনুবাদ করলে হারিয়ে যেতে
পারে বলে আমাদের মনে হয়েছে।
কারোর যদি সুযোগ থাকে তাহলে মূল বইটির সোয়াদ চেখে নিতে পারেন। ঝাল-নুনের স্বাদ যে অন্য কিছু, এমনকি ইলিশে বা আমাদেরমত অপটু হাতের
সারাংশতে পাওয়া যায় না বা যথাবিহিত বর্ণনা করে বোঝানো যায় না, তা হলপ করে বলতে পারি।
No comments:
Post a Comment