তোমার বুকের খুনের চিহ্ন খুজি ঘোর আন্ধারের রাতে
সম্প্রতি লোকফোকের সম্পাদক, বিশ্বেন্দু গিয়েছিল তার মামাবাড়িতে, ১৫ আগস্ট সকালে। সেটি পূর্ব-মেদিনীপুরের রামনগর ব্লকের ঘোল গ্রামে, দক্ষিণ শীতলা মৌজায়। সঙ্গে কলাবতী মুদ্রার প্রধান ডঃ ললিতা ঘোষ। ললিতার প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা গেলাম তাজপুরের সমুদ্র সৈকতে। সঙ্গে ছিলেন মামা দেবীদাস পঞ্চাধ্যায়ী(আমি জানিনা কজন এই পদবিটি শুনেছেন!) এবং বিশ্বেন্দুর মাতা ঠাকুরানী বিশ্বেশ্বরী নন্দ, একদা পঞ্চাধ্যায়ী।
একদা তাজপুর ছিল জলধা খটি। মেদিনীপুরের ভাষায় খটি মানে ছোট মতস্য বন্দর যেখান থেকে জেলেরা সমুদ্রে মাছ শিকারে যান। মনে আছে মামা কালিপদ মিশ্রের সঙ্গে প্রায় তিন দশকেরও আগে গিয়েছিলাম শীতলামঙ্গল পালা দলের এক জন হয়ে। আজ জলধা খটির নাম হয়েছে তাজপুর। প্রচুর থাকার যায়গা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন মাদারমনির(শহুরে ভাষায় মান্দারমনি) অভিজ্ঞতা সম্বল করে তটের কাছে থাকার বাড়ি করতে দেয় নি।
এখানে আমরা তাজপুরের গল্প করতে বসিনি। বহু কাল আগে যখন এই মামাবাড়ির গ্রামে দিদার সঙ্গে থাকতাম। এবং আব্দার-টাব্দার করলে দিদা আমাকে দিঘা নিয়ে যেতেন, রাস্তায় বাঁকশালের কাছে একটি চার মুখ ওয়ালা সিংহের স্তম্ভ দেখতাম। তখন খুব একটা পাত্তা দিই নি। কয়েক মাস আগে যখন দিঘা গেলাম, কি একটা কারনে, সেদিনও সেই স্তম্ভকে এড়িয়ে গিয়েছি শহুরে তাচ্ছিল্যে। যেতে যেতে কথা হচ্ছিল কয়েক বছর আগের জয়া মিত্র দিদির পত্রিকা ভুমধ্যসাগরে লেখা মেদিনীপুরের নুন বিষয়ে বিশ্বেন্দু একটি প্রবন্ধ বিষয়ে। তক্ষনি আমরা সেই স্তম্ভটি পার হচ্ছিলাম। মামা বললেন, এটি লবণ আইন সত্যাগ্রহের স্মৃতি স্তম্ভ। ততক্ষনে আমরা বাঁকশাল পেরিয়ে ঢুকে গিয়েছি জলধার দিকে দিঘার বাঁধ ধরে, স্থানিয় শিক্ষিতেরা যাকে আজও সি ডাইক বলে ডাকেন, আর আম জনতা দিঘার বাঁধ বলেন।
ফেরার সময় সেখানে দাঁড়ালাম। এবং এই দুটো ছবি তুল্লাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে অবাক হওয়ার পালা। এই গ্রামেই লবণ সত্যাগ্রহ চলার সময় পুলিসের সঙ্গে লড়াইতে ১৯৩০এ তালকাঁটালিয়া গ্রামের বিপ্রপ্রসাদ বেরা মশায় শহীদ হয়েছেন। এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার দু বছরের মধ্যেই ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯, তৎকালীন রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজুকে দিয়ে স্থানীয় মানুষ এই স্মৃতি স্তম্ভটি উদ্বোধন করেন। সে সময়ের মানুষ সেই জরুরি কাজটি করে গিয়েছিলেন, ঘটনাটা ঘটার ২০ বছরের মধ্যে।
কিন্তু আমরা যারা আজকের বা একটু আগের প্রজন্ম তারা কি করলাম! বছরে একবার কি দুবার এই স্মৃতি স্তম্ভয় মালা দিয়ে কাজ সারলাম। তলকাঁটালয়ার এই শহীদকে বাইরের মানুষ কে মনে রেখেছেন! সে সময়ের গ্রামের অগ্রণী মানুষেরা এই আন্দোলনে জীবনদাতাদের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে তাদের কাজ করে গিয়েছেন বহু বছর আগে। এই বা আগের প্রজন্মের মানুষেরা কি সেই দায়িত্ব পালন করেছি! বছরে কয়েকটা দিন শুধু সেই স্মৃতিস্তম্ভে মালা দিয়ে দায় সারি। আমাদেরই দোষে আজ পূর্ব- মেদিনীপুরের ইতিহাস তমলুকেই শেষ হয়ে যায়। তার পরে যেন মহা শূন্য।
ঠিক এই ধরনের একটি স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে পিছাবনী হাটে। তারও ছবি দিলাম। তবে উইকি ম্যাপিয়া থেকে। পরের বাড়ে এটির কাছের ছবি দেব, যাতে উৎকীর্ণ লেখাটি পড়া যায়। এক্কেবারে নিচের ছবিটি পিছাবনীর।
এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য পেয়েছি। পরের পোস্টে দেব।
চোখের জলে, বুকে পাথর রেখে অজানা সব শহীদের, আমরা যাদের নাম জানি না, তাদের আভুমি প্রনাম জানালাম।
আমরা যেন মনে রাখি এদের ছোট ছোট লড়াই ছাড়া নেতারা বড় নেতা হতে পারতেন না। এই শহিদেরা বিন্দুমাত্র ভাবেননি কিভাবে বারবার সংবাদের শিরোনামে থাকা যাবে, বা ক্ষমতায় এসে কোন পদ নেওয়া যাবে।
ঠিক সেই জন্যই আজকের টালমাটাল সময়ে এদের আরও বেশি মনে করা প্রয়োজন, যারা বিখ্যাত তাদের থেকে। এদের পথ বেয়ে এগিয়ে চলা অতি প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment