লেখাটা বেশ বড় হবে - যাঁদের তাড়া আছে নাও পড়তে পারেন - ছবিগুলোয় বর্ণনা আছে - সেগুলি পড়েও বেরিয়ে যেতে পারেন - সমস্যা হবে না - গাঁইয়ারা শহুরেদের ঠাণ্ডা নিরাসক্তিতে খুব একটা বড় মাথা ঘামান না।
--
গোপভূম মেদিনীপুরে মাত্র একটা গ্রাম বেলিয়ায় দুবছর আগে দেখলাম -
হাঁড়ি তৈরির প্রযুক্তি।
পোড়ামাটির তুলসিমঞ্চ।
মেদিনীপুরের কুম্ভকর বাড়ির আলপনা।
পচাই তৈরির পাতন পাত্র।
**এগুলি চারটি আলাদা আলাদা প্রকাশনীতে দেব**
গোপভূম মেদিনীপুরে মাত্র একটা গ্রাম বেলিয়ায় দুবছর আগে দেখলাম -
হাঁড়ি তৈরির প্রযুক্তি।
পোড়ামাটির তুলসিমঞ্চ।
মেদিনীপুরের কুম্ভকর বাড়ির আলপনা।
পচাই তৈরির পাতন পাত্র।
**এগুলি চারটি আলাদা আলাদা প্রকাশনীতে দেব**
প্রথম যেটা আলোচনা করব, সেটা হল হাঁড়ি তৈরির প্রযুক্তি, আরও কিছু বিষয়।
কুম্ভকার পেটাচ্ছেন হাড়িটি। হাঁড়ির ভেতরের হাতে রয়েছে একটি পাথর, আর বাইরের হাতে রয়েছে কাঠের চ্যাপটা হাতুড়ি। মাঝে মাঝে তিনি হাতুড়িকে পাথে রাখা জলে ভিজিয়ে নিচ্ছেন, যাতে কলসির মাটি ফেটে না যায়। |
পেটানো চলছে। হাঁড়িটি মসৃন না হওয়া পর্যন্ত পেটানো চলবে। |
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেটানো চলছে। পাশে রাখা শেষ না হওয়া কিছু হাঁড়ি |
সার দেওয়া মাটির হাঁড়ি শুকোতে দেওয়া |
পেটানো চলছে পাশে রাখা হাঁড়িতে কাজ হবে |
চ্যাপটা হাতুড়িতে জল নিচ্ছেন |
কাজ বন্ধ রেখে এক অকৃতজ্ঞ, অনুতপাদক সমাজের প্রতিনিধির নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সস্নেহে। অসাধারণ মনোযোগ। না দেখলে বিশ্বাস হত না। বাংলায় জন্ম নেওয়া সার্থক। |
পাথর, সেটার ওপরে নির্মিয়মান কলসির মাটি বাইরে থেকে চ্যাপটা হাতুড়ির ঘা পড়ে |
অসাধারণ মনোযোগ। পেটানো চলছে। পাশেই ন্যাতানো দরজার সামনেই, ঘরে ঢোকার মুখেই কুম্ভকর বাড়ির আলপনা। কি যত্ন, কি অনুচ্চ ভালবাসা, অনুচ্চ মাটির টান। শ্রীর দেবী লক্ষ্মীর আহ্বান। |
অখণ্ড মনোযোগে পালিশ চলছে! এর একাংশও যদি পাওয়া যেত। |
বাড়ির পিছনে ভাটি বা পোণ। এখানেই পোড়ানো হবে |
লাল মাটির ওপরে সার দিয়ে রাখা মাটির কলসির সারি। |
কুমোরী বনক(পোড়াবার আগের রং) লাগাচ্ছেন |
বনক লাগানোর কাজ |
বনক লাগানো হাঁড়ি |
বনক লাগাচ্ছেন |
আজকের পশ্চিম মেদিনীপুর - যেখানে একদা চোয়ড়, পাইকেরা লুঠেরা ব্রিটিশ লালমুখোদের সেনাবাহিনী সহ অবরুদ্ধ করে রেখেছিল বহু দিন। গত বছর মাটির পুতুল খুঁজতে Somaর সঙ্গে বেরিয়েছিলাম পশ্চিম মেদিনীপুর - বাংলার গ্রাম উৎপাদন পরম্পরার অন্যতম ধাত্রীভূমি। প্রথমে ঐতিহাসিক মেদিনীপুর শহরে পেলাম দেওয়ালি পুতুল। তারপরে গেলাম বেলিয়া। সেখানে অসাধারণ সব নিদর্শন পেলাম।
এই প্রকাশনীতে পর পর দেওয়া ২০টির কাছাকাছি ছবিতে আপনারা ধারাবাহিকভাবে দেখবেন কিভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে হাঁড়ি তৈরি করেন বাংলার কুম্ভকার সম্প্রদায়। প্রথমে মাটির মুখ/কাণা তৈরি করে নেন চাকে - সেটি অসম্ভব ভার বহনের ক্ষমতা রাখে - মনে রাখুন এই কলসির কানা দিয়েই কিন্তু নিমাইকে পিটিয়েছিল জগাই মাধাই - যারা গ্রামে এই অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তারা জানবেন এই কানা নামক অস্ত্রটার ধার আর ভার। তাকে তৈরি করা হয় অন্তত ২০ সের জল ধরার ক্ষমতার মত করে।
বিশেষ একটা যায়গার মাটি(সাধারণত উইঢিবির হয় বা গ্রামের বিশেষ কোন মাঠের জমিও হতে পারে) চেলে মাটি থেকে বালি, পাথর কুচির মত বর্জ্যকে বার করে দিতে হয়। না হলে পোড়ানোর সময় এই বর্জ্য পদার্থ তাপের প্রভাবে সম্প্রসারিত হয়ে, হাঁড়িটিকে ফাটিয়ে দিতে পারে। তারপর আটা মখার মত চালা মাটিকে মাখতে হয়।
এই প্রক্রিয়া কৃত মাটির দলা নিয়ে এক হাতে কাঠের চ্যাপটা হাতুড়ি ও অন্যহাতে অসম্ভব মসৃণ একটি চ্যাপটা অর্ধ গোলাকৃতি পাথরের মাঝখানে সেই মাটির দলাটিকে রেখে ধরে ধীরে ধীরে পেটানো শুরু হয়। সেই তালটাকে সাধারণ মনযোগে, অর্জিত সামাজিক দক্ষতায় আর নিজস্ব প্রযুক্তিতে পিটিয়ে পিটিয়ে হাঁড়ির আকার ধারন করান।
এবারে কুম্ভকর বাড়ির মেয়েরা কাঁচা তৈরি হাঁড়িতে রং মাখান - যার নাম বনক। এই বনক তৈরি হয় আবার সেই কোন এক বিশেষ মাঠের মাটিকে চেলে তারপর সাতবার পাতন করে। কোথাও কোথাও পুরোনো খড়ের চাল থেকে ঝরে পড়া লাল জল ধরে রেখেও বনক তৈরি করেন - যাতে পোড়াবার পর মাটির হাঁড়িতে লাল রং আসে।
এ অসাধারন প্রযুক্তি শুধু নয়, গঠনের দিক থেকে ব্যাপার - এবং তার আঙ্গিক, গড়ন কয়েক হাজার বছর পাল্টাতে হয় নি - মানুষ পাল্টেছে, মানুষের সময় পাল্টেছে, মানুষের মনুষ্যত্ব পালতেছে কিন্তু হাঁড়ির মত কিছু তৈজস যেমন ছিল কয়েক হাজার বছর আগে ঠিক তেমনি থেকে গিয়েছে আজও - যার প্রমান মেদিনীপুরের এই কুম্ভকার। যে আকারে মাটির হাঁড়ি হয়, তা মেয়েদের কোমরে কেমন আটকে যায়। আর খুব বেশি হাঁড়ি আমি কিন্তু কানা থেকে ছেড়ে যেতে দেখিনি। অসাধারন সেই অঙ্ক, অসাধারন সেই গড়ন বিদ্যা, যা আজও অজর অমর - কোন পেশাদার ডিজাইনারদের সাহস হয় নি এই গড়ন বদলাবার।
এরাও বাঙ্গালি। বড় পুঁজি এদের অনুদ্যমী বলে দাগিয়ে দিয়েছে। যে কলসিতে জল ঠাণ্ডা হত সাধারণভাবেই গরমকালে, আজ তাকে বিসর্জন দিয়ে নিয়ে এসেছি হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে শরীর খারাপের, বিদ্যুৎ শক্তি নির্ভর নানান ধরণের রাসায়নিক জল পরিস্রবন যন্ত্র। অথচ এই পরিশ্রিমীরা তাঁদের জ্ঞান, তাঁদের অনুশীলন, তাঁদের দক্ষতার, তাঁদের নিজেদের প্রযুক্তির কোন শহুরে স্বীকৃতি পেলেন না।
হয়ত আগামী কোন দিন বিখ্যাত ইওরো-আমেরিকিয় বিশেষজ্ঞ বলবেন বা কোন গবেষণাগারে প্রমাণিত হবে পেটানো মাটির কলসিতে জল খাওয়া পরিবেশের পক্ষে আর স্বাস্থ্যের পক্ষেও উপযোগী, সেদিন শিক্ষিত বাঙ্গালি ঝাঁপিয়ে পড়বেন ইওরোপিয় পিঠ চাপড়ানি পাওয়া কলসির জল খেতে।
তত দিন ভদ্র-ইংরেজি শিক্ষিত বাঙ্গালির বাড়িতে মাটির কলসির প্রবেশ নিষেধ! গাঁইয়ারা কিন্তু আজও রাসায়নিক ফিল্টার করা জল খাননা। তারা এই অশিক্ষিতদের পাশে তাঁদের যথাসর্বস্ব নিয়ে দাঁড়াবার অঙ্গীকার করেন!
No comments:
Post a Comment