বেরা ভাসান বহুকালের সমুদ্রে নৌকো ভাসানোর স্মৃতিকে ধরে রাখা, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভুত্ব এবং সামাজিক সংহতি বজায় রাখা, ভূমি আর আকাশের মধ্যে যে নিরন্তর সৃষ্টিসঙ্ক্রান্ত বাগবিতণ্ডা চলে সেটি বজায় রাখার উৎসব। বেরা ভাসান উতসবের গুরুত্ব হল, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে স্থলের সম্পর্ক তৈরির ইতিহাস মনে রাখা। তাল, কলার বা সাধারণ পাতা বা কাগজের মান্দাস তৈরিকরে নদীতে ভাসিয়ে জলের দেবতাকে তুষ্ট করা হয় বেরা ভাসানে। এই উতসবটি অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর বর্ষার পরে, বাংলার ভাদ্র(আগস্ট সেপ্টেম্বর) মাসে মাসে। এটা বহরমপুরে আজও অনুষ্ঠিত হয়। আমি এই উতসবের কোন পুরোনো ছবি দেখি নি। এবং বেরা নিয়ে কোন বড় কাজ হয়েছে বলে আমার ধারণা নেই।
এই উতসবটি কবে শুরু হয়েছিল আমরা জানি না। তবে মধ্যযুগের বাংলায় এটি রাজনৈতিক গুরুত্ব বিপুল ছিল। হয়ত এই উতসবটা শুরু করেছিল সাধারণ মানুষ, কিন্তু পরে সপ্তদশ শতে ঢাকা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে সেটি মুঘল সুবাদারদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। অষ্টাদশ শতকে বাংলা সুবার রাজধানী মুর্শিদাবাদে নবাব এটিকে তার রাজনৈতিক প্রভুত্ব তৈরি করার অন্যতম বাহন হিসেবে কাজে লাগান। বেরা ভাসান সূত্রে আমাদের মধ্যযুগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি একবার নতুন করে মনে করা যাক।
পশ্চিমের ত্রিহূত(আজকের মিথিলা) থেকে উত্তর-পূর্বের শক্তিশালী ত্রিপুরা(কখোনো স্বাধীন কামরূপও) দক্ষিণ পূর্বের ঢাকা এবং চট্টগ্রাম, দক্ষিণে নদিয়া, হুগলি আর দক্ষিণ পশ্চিমে জাজনগর ছিল ষোড়শ শতে মুঘল আমলের বাংলা সুবার সীমান্ত। সপ্তদশ শতে মুঘল শক্তি ঢাকা ছাড়িয়ে বদ্বীপ অঞ্চলেও বিস্তৃত হয় এবং ঢাকা হয়ে ওঠে বাংলার রাজধানী। এই সময়েই ঢাকার আশেপাশে বেরা ভাসানোর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। অষ্টাদশ শতের প্রথমে মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানী হয়। ঢাকার ছোটে নবাব, শাসক পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যর উপস্থিতিতে সেটি বাংলার দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গণ্য হতে থাকে। দীন মহম্মদের লেখায় ছোটে নবাবের চরিত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, এবং শাসকদের সঙ্গে সমুদ্র যাত্রারও সূত্র পাওয়া যায়।
অষ্টাদশ শতকের শেষের সময়ের বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানতে পারছি, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিন্তু তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে বেরা ভাসানের মত উৎসব আয়োজন করেছে(রীলা মুখার্জীর বই - Merchants and Companies in Bengal: Kasimbazar and Jugdia in the Eighteenth Century এবং Strange Riches: Bengal in the Mercantile Map of South Asia দেখুন)। ব্রিটিশদের বেরা ভাসানোর উদ্দেশ্য ছিল বেরাকে বাঁচিয়ে রাখা নয়, নিজেদের গ্রহণ যোগ্যতাকে তুলে ধরা। এই বাংলায় এটি সামাজিক উতসবে পরিণত হয় এবং এটি হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উৎসব হিসেবে গণ্য হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উতসবের দ্যোতনাও পরিবর্তিত হতে থাকে। আমার জ্ঞান অনুযায়ী, বাংলাদেশে রাষ্ট্র কিন্তু বেরা উৎসবকে পৃষ্ঠপোষণা করত না। এই প্রবন্ধে আমি বেরা উৎসবের উদ্ভব এবং মধ্যযুগের শেষ পর্ব থেকে আজ পর্যন্ত সময় ধরে বাংলার ধর্মীয় এবং আর্থিক প্রেক্ষিতে এটির গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করব। যেহেতু লিখিত তথ্য প্রায় নেইই বলা যায়, তাই আমরা পরিবেশ, ভাষাতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব এবং মানচিত্রবিদ্যার তথ্য ব্যবহার করব।
(চলবে)
(চলবে)
No comments:
Post a Comment