Wednesday, November 22, 2017

বীরভূমের লোহা শিল্প এবং চুয়াড় লড়াই৭ - যোগেশ রাম মিশ্র

১৭৭৮ সালের সমীক্ষা-তালিকা বলছে এই অঞ্চলের লোহা ব্যবসা অতীব উন্নত পরিকল্পনামাফিক ছিল। স্থানীয় চুয়াড় আর বহিরাগত(সমতলের বাঙ্গালি) একসঙ্গে পাশের জেলা, রামগড়ের খণিগুলিতে কাজ করত। কলকাতার সওদাগরেদের দালালেরা এই খনি এলাকায় বর্ষার মরশুম বাদ দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করত। স্থানীয় গ্রামগুলি থেকে অতীব সস্তায় লোহার পণ্য কেননা এদের কাজ। রাজা বা কোম্পানির আমলাদের ঘুষ দিয়ে এইসব অঞ্চলে কাজের অনুমতি আর নিরাপত্তা নেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। ভুল মানুষের আশ্রয় নিলে ক্ষতিও হত ব্যাপারীদের।
(৩৭ পাতায় বিশদে একটা তালিকায় লোহার উতপাদন আর তার রাজস্ব আদায় ইত্যাদির বর্ননা দেওয়া হয়েছে। যেমন তালিকা ১এ বলা হচ্ছে Particulars of the Jumma of Tuppa Looney & the Iron Mehal rented & Khas from 1770 to 1777। সেটা দেওয়া ফেবুতে মুশকিল দিলাম না।)

এই তালিকার তথ্য থেকে পরিষ্কার যে এলাকার দক্ষিণপূর্ব অঞ্চল ছাড়া গোটা জেলাজুড়ে লোহা ব্যবসা চলত। উত্তরে টুপ্পা লুনি লোহা ছিল রাজস্বের মূল উৎস। এছাড়াও ছিল খাস লোহা এস্টেট। টুপ্পার রাজস্ব আদায়ের ভার দালালদের ওপরে দেওয়া থাকলেও খাস এলাকার উৎপাদনের শুল্ক সরাসরি রাজা আদায় করাতেন। তালিকায় শুল্ককে মাল আর সায়েরে ভাগ করা অর্থপূর্ণ। মাল হল জমি আর তার উৎপাদনের ওপর শুল্ক আর সায়ের হল পথ কর। ১৮০০ সালে মধ্য এবং উত্তরপূর্ব এলাকায় ১০০টা খনি চালু ছিল। খাস এলাকার উৎপাদন রপ্তানি হত।

১৭৭০এ এলাকায় কি ধরণের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ছিল সেটা আন্দাজ করতে সাহায্য করে। স্থানিক এবং ব্যস্থাপনা সংক্রান্ত ব্যাপারে উৎসাহ দ্যাখা যাচ্ছিল এই সময় থেকে। কয়েক বছরের মধ্যে গোটা এলাকার রাজস্ব ব্যবস্থাপনা একজন মানুষের নিয়ন্ত্রনে চলে গেল, তিনি রায়জয় রায়। সায়ের জমা নিয়ে উৎপাদক বিক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ এবং স্থানীয় এলাকায় গন্ডগোলে মোট কারখানার সংখ্যা সাত বছরে কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়।

১৭৭০ সালের বীরভূমের লোহা বাজারের গতিশীলতা নির্ভর করত উৎপাদনের সম্পর্কের ওপরে। লোহা সরবরাহ ব্যবসার একটা বিপুল অংশ নির্ভর করত দাদনের ওপর – সওদাগর আর তার অধস্তন দালালেরা ব্যাপারীদের অগ্রিম করতেন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যে, ব্যাপারীরা হকারদের (itinerant peddlers) দাদনটা দিতেন আর শেষে দিতেন খনির কারিগর(মাইনার), লোহা গলানোর পরিবার আর কামারদের। ঔপনিবেশিক বাংলায় দাদন একটা স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এর ফলে উৎপাদকেরা ঋণে জরজরিত হয়ে পড়ত। বহু সময় এক জায়গায় লোহাচুর না পাওয়া গেলে অন্য জায়গায় যেতে হত উতপাদকেদের, সেখানেও চাহিদামত লোহা পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তারা হয়ত অনেক সময় পণ্য উৎপাদনে নজর দিত। তবে ধারে ডুবে যাওয়ার একটা বড় কারন ছিল দিনের পর দিন একের পর এক নতুন প্রতিযোগী ব্যাপারী, কোম্পানির দালালের দাদনের বাজারে ঢোকা। দাদনের পরিমান বাড়লেও, কাঁচামালের দাম তুলনামূলকভাবে বাড়ত স্বাভাবিকভাবে। ফলে বহুসময় উৎপাদকেরা ঠিকভাবে তাদের চুক্তিমত কাজ দিতে পারত না।
(চলবে)

No comments: