আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, অষ্টাদশ শতক থেকে দক্ষিণ বঙ্গের ঢাকা অঞ্চল জাতি গঠনের আন্দোলনে বিপুল ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। নবাবি আমলের পরে প্রথম বঙ্গভাগ হয় ১৯০৫ সালের ব্রিটিশ শাসনে, তারপরেরটি ১৯৪৭ সালে পূর্বাঞ্চলটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হল এবং ১৯৭১ সালের পরে এই ভূখণ্ডের নাম হল বাংলাদেশ। এই কারণের অবিভক্ত বাংলার উৎসব বেরা ভাসান সীমান্তের দুইপারের বাঙালির একটি যোগসূত্র।
বাংলার ঐতিহাসিক ভূগোলে বেরা ভাসান উৎসবের নানান তাৎপর্য
অবিভক্ত বাংলার তিনটি আলাদা আলাদা ভৌগোলিক এলাকা দক্ষিণ এবং পুর্বে বদ্বীপ, উত্তরে ও পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমি এবং বিহারের পাহাড়ি অঞ্চল আর উত্তরপূর্বে পূর্বহিমালয়। যদিও তার উপকূলিয় ভূমি (littoral) খুবই দীর্ঘ - তেমনি বাংলায় পাহাড় আছে, গিরিখাত আছে সমতল জমিও আছে, এই তিনিটি ভৌগোলিক ক্ষেত্র জুড়লে যেন মনে হয় সে সমুদ্র থেকে দূরের(inland) একটি রাজ্য। কৃষি খুব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যম, তারপরেই আসে মাছ চাষ।
তাহলে বেরা উৎসবকে আমরা কিভাবে দেখব –সমুদ্র থেকে দূরে থাকা একটি উপকূলিয় ভূমির রাজনৈতিক পঞ্চাঙ্ক হিসেবে? না এই উতসবটা সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় চরিত্রের? আজকে কি একে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের নজরে দেখব? না কি একে নবাবদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিবৃতি হিসেবে দেখব? ড্রিক কফ (Dirk Kolff, verbal communication, Leiden, September 2006) আমাদের জানিয়েছেন bhashan underscores the fact that capital (either social or material) was seen by nawabi Bengal as becoming fluid। তাহলে কি ধরে নিতে হবে বেরা ভাসান এক সময়ের বাংলার অসাধারণ উতপাদকতা এবং বাণিজ্য প্রচেষ্টার প্রতীক? এটাকে কি আমরা দেখব একটি উৎসব হিসেবে, যেটি সাধারণ জলদেবতাকে সন্তুষ্ট করার উৎসব থেকে শুরু হয়ে বাংলার নবাবদের হাতে পড়ে এটি to create a universal cosmic sphere of power – their own mandala, as it were – by asserting control over natural elements? পরের দিকে বেরার সঙ্গে আলেকজান্ডারের পুরাকথা(myth) নিয়েও আলোচনা করব।
আজও বাংলা সৌর পঞ্জিকার ভাদ্র মাসে বেরা ভাসান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমার ধারণা এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয় সমুদ্র যাত্রা করে ফিরে আসার মধ্যিখানের সময়টিতে। সামাজিক, ধার্মিক উৎসব এবং বায়ু এবং স্রোত চলাচলের তথ্য থেকে আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি, পূর্ব উপকূলের বাংলা এবং ওডিসা থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দিকে বাণিজ্য যাত্রা শুরু হত নভেম্বর ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং সেই যাত্রা ফিরে আসত জুন আর সেপ্টেম্বরে(শ্রীলা ত্রিপাঠি, এল এন রাউতের Monsoon Wind and Maritime Trade: a Case Study of Historical Evidence from Orissa, India প্রবন্ধ দেখুন। একই সঙ্গে পরম পত্রিকার নৌকো সংখ্যায় প্রকাশিত শ্রীলা ত্রিপাঠির একটি লেখাও জুড়ে দেওয়া গেল)। ফলে ভাদ্র, আগস্ট সেপ্টেম্বর বাণিজ্য থেকে ফিরে আসা এবং আবার যাওয়ার মধ্যের মাস হিসেবে গণ্য হয়।
এই সময়টা আদতে বর্ষা মরশুমের শেষের সময় – জল ঝরার মাস – ‘the sending away of the waters’ (Anthony Reid, South East Asia in an Age of Commerce 1450-1680, V.1, The Lands Below the Winds, New Haven and London, দেখুন)। এটি নতুন একটি কৃষি চক্র শুরুর উদ্যমের সময়। নতুন কৃষিচক্র শুরু হওয়ার সময় এই উৎসবের অর্থ, বেরা উৎসব দিয়ে নতুন ফসলি(রাজস্ব) বছর শুরু। তাহলে আমরা দেখলাম বেরা ভাসান সামুদ্রিক বাণিজ্য চক্র আর কৃষি চক্র শেষে অনুষ্ঠিত হওয়ার উৎসব। এর থেকে আমরা ইঙ্গিত পাচ্ছি, এই সাধারণ উৎসবকে বাংলার নবাবেরা কৃষি আর বাণিজ্যযাত্রার ওপরে মণ্ডল (mandala)ভিত্তিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের উতসবে পরিণত করেছিলেন।
কিন্তু সাধারণ জল উৎসব বহু সময়ে রাজনৈতিক আগ্রাসন এবং সামরিক বিজয়ের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে (Reid, Anthonyর ওপরের প্রবন্ধটি দেখুন, তার সঙ্গে দেখুন তাঁর Les Immigrés Intha, La Transhumance des Buffles et la Circumnavigation Bouddhique du Lac Inle: Etat Shan de Birmanie’ in Etudes Birmanes en Hommage à Denise Bernot, Réunis par Pierre Richard et Francois Robine প্রবন্ধটিও)। আমরা জানি বাংলার নবাবি আমল আরাকান, পর্তুগিজ, আফগান এবং মারাঠাদের মত বহিঃশক্তির আক্রমণকে বিফল করেছিল। বাংলার উপকূলে নৌবাহিনী বা নাওয়ারাকে সবসময় যুদ্ধের জন্য তৈরি রাখা হত, এবং সারাক্ষণ উপকূল টহল দিত। আলিবর্দির খাঁয়ের সারা জীবনটাই গিয়েছে বিজিত অবিভক্ত বাংলা বিহার ওডিসার সীমান্তকে রক্ষা করতে।
No comments:
Post a Comment