(State and Finance in the Eurasian Continuum in the Early Modern Times: INDIAN MERCHANT/BANKERS TO THE RESCUE OF THE EUROPEAN COMPANIES, EASTERN INDIA, C. 1650 – 1757: SUSHIL CHAUDHURY)
(ইওরোপ বিশেষ করে কেম্ব্রিজ তাত্বিকেরা বলে থাকেন বাংলা তথা উপমহাদেশে ব্রিটিশেরা/ইওরোপিয়েরা উত্তম, কার্যকর, সুবিধের ব্যাঙ্কিং, ঋণ, বীমা ব্যবস্থা চালু করেছিল। ডাহা মিথ্যে কথা। এই অনুবাদের মাধ্যকে সেই তত্ত্বের অন্তঃসার শূন্যতা দেখানো।)
এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হল কিভাবে বাংলার স্থানীয় ব্যাঙ্কিং/ঋণ ব্যবস্থা সপ্তদশ শতের দ্বিতীয়ার্ধে এবং অষ্টদশ শতকের প্রথমার্ধে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলিকে উদ্ধার করেছে। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি, বাংলার পণ্য কিনতে এই সময় নিদারুণ আর্থিক দুর্দশায় পড়ত। ভাগ্যভাল, সে সময়ে বাংলা জুড়ে অসাধারণ উন্নত, কার্যকরী এবং বিস্তৃত আর্থিক ব্যবস্থাপনা ছড়িয়েছিল, যার মাধ্যমে অসাধারণ ঋণ দেওয়ার কাজকর্ম চলত। এই কোম্পানিগুলি স্বাভাবিকভাবে উৎসুক হয়ে ওঠে এই স্থানীয় আর্থব্যবস্থা্র ঋণ ব্যবস্থার সুযোগ নিতে। এবং এইভাবে আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি, সেই সময়ে এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কোম্পানিগুলি তাদের এশিয় ব্যবসার আর্থিক মহাবিপর্যয়গুলি কাটিয়ে ওঠে।
আমরা আজ সকলেই জানি ষোড়শ শতকে পর্তুগিজেদের এস্তাদো দা ইন্দিয়া ভারত ব্যবসায় যে বিপুল লাভ করতে থাকে, সেই নিদর্শন দেখে বহু উত্তর ইওরোপিয় জাতিরাষ্ট্র সপ্তদশ শতের প্রথম দিকে যৌথ কারবারের (joint stock companies) সংগঠন তৈরি করা শুরু করে। পূর্বের সঙ্গে ব্যবসা করার উদ্দেশে যে সব সংগঠন তৈরি হল, তাদের মধ্যে প্রধানতম হয়ে ওঠে ১৬০০ সালের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ১৬০২ সালের ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। যদিও তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পূর্বের দ্বীপপুঞ্জ থেকে মশলা ব্যবসা, কিন্তু তারা পূর্বের দেশগুলিতে এসে অবাক বিষ্ময়ে দেখল, মশলা দ্বীপপুঞ্জে ইওরোপিয় বাজার থেকে বিপুল পরিমানে যে রূপো নিয়ে ইওরোপের অসীম চাহিদাবন্ত বাজারের জন্য মশলা কিনতে এসেছিল, সেই সব এলাকায় তাদের বয়ে আনা রূপোর কোন চাহিদা নেই, বরং ভারতীয় মোটা শস্তা কাপড়ের উত্তুঙ্গ চাহিদা বর্তমান। এবারে তাদের নজর মশলা দ্বীপপুঞ্জ থেকে ভারতের দিকে ঘোরাতে বাধ্য হল, বিশেষ করে পূর্বের করমণ্ডল উপকূলে। সেখানে প্রচুর পরিমানে মোটা শস্তা কাপড়ের উৎপাদন হয়। কিন্তু দক্ষিণে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, মন্বন্তর, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তাদের লাভের গুড়ে কামড় বসাচ্ছে। তারা বিশেষভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠতম সম্পদশালী সুবা বাংলার দিকে নজর দিল।
আমরা বাংলার যে সময়কাল নিয়ে আলোচনা করছি, সেটা শুধু যে সে সময়ের ভারতের তাঁত সহ অন্যান্য শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্র ছিল তাই নয়, সেই অঞ্চলটির আরও নানান সুযোগসুবিধে ছিল। বাংলার (কাশিমবাজারের) রেশম চিনা আর পারসি রেশমের তুলনায় একটু নিচুস্তরের হলেও সেটি এত শস্তায় পাওয়া যেত যে সেই রেশম ইওরোপের রেশম কারখানাগুলিতে ছেয়ে যেতে শুরু করল। এর পাশাপাশি বাংলার পাটনার সরকার সারণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং শস্তাতম সোরা উতপাদন করত। ইওরোপ জুড়ে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ লেগে থাকায় সেই সোরার চাহিদা অন্তত আকার ধারন করল। জাহাজগুলি ভারতীয় পণ্য নিয়ে ইওরোপে যাওয়ার সময়, সোরা জাহাজের খোলে ভার দ্রব্য হিসেবে বয়ে নিয়ে যেত। এর অন্যতম সুবিধে ছিল, অত্যন্ত ভারি সোরা ঝড় ঝঞ্ঝায় মাঝ সমুদ্রে জাহাজগুলিকে স্থিতিশীলতা দেয়, জাহাজ ডুবি কম হতে থাকল তারপরের সময়ে।
মধ্য সপ্তদশ শতকের সময় থেকেই কোপম্পানিগুলি বাংলায় নজর দিতে শুরু করল। বাংলা ক্রমশ হয়ে উঠল কোপম্পানিগুলির মূল বাণিজ্যকেন্দ্র এবং এর পরের দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাই তাদের কর্মকাণ্ডের অক্ষদণ্ড হয়ে উঠতে শুরু করে। বাংলার তিনটি মূল দ্রব্য তাঁত, কোরা রেশম আর সোরা রপ্তানি করতে শুরু করে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি। এখান থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জায়মান হয়ে উঠতে শুরু করে এটা আমাদের লক্ষ্য করা দরকার। শুরুর সময় কোম্পানিগুলির এশিয় বাণিজ্য ছিল ইওরোপ এবং মশলা দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা। সময়ের প্রভাবে এটির চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে। দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা থেকে আস্তে আস্তে এটি ত্রিপাক্ষি ব্যবসাতে পর্যবসিত হয় – ইওরোপ, ভারত(শস্তা কাপড়) এবং মশলা দ্বীপপুঞ্জ(যেখানে ভারতীয় শস্তা মোটা কাপড়ের বিনিময়ে মশলা কেনা হত এবং সেই মশলা ইওরোপে রপ্তানি হত)। শেষ পর্যন্ত এটা আবার দ্বিপাক্ষিক ইওরোপ-বাংলা ব্যবসায় এসে দাঁড়ায় ১৬৮০র পর থেকে; কোম্পানিগুলির এশিয় ব্যবসার মূল ঘাঁটি হয়ে ওঠে বাংলা। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার এই সময়টিতে বাংলা কিন্তু ব্যবসায় উদ্বৃত্ত অর্থনীতি ছিল।
কিন্তু সমস্যা দাঁড়াল বাংলায় ব্যবসা করার অর্থ জোগাড় করা নিয়ে – যাকে ইওরোপিয় কর্পোরেট কাজগপত্রে বলা হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট। তাদের রতানিযোগ্য পণ্য কেনার পুঁজি জোগাড় করাই সমস্যা হয়ে উঠল। পুঁজি জোগাড়ে সমস্যাটা বড় হয়ে দ্যাখা দিল, তার কারণ ইওরোপিয় কম্পানিগুলি বাংলায় বিক্রি করার জন্য যে সব
পুণ্য নিয়ে আসত, সেগুলির বাজার ছিল না বাংলায়। যদিও বাংলায় খুব বড় পরিমান পণ্য তারা বয়ে নিয়ে আসত না, কিন্তু সেই ক্ষুদ্র পরিমাণ পণ্যেরও বাজার বাংলায় ছিল না বললেই চলে। বাংলায় তারা মূলত বিক্রি করত দামি ধাতু আর মশলা। কিন্তু সেগুলির মরশুমি বাজার আর পরিমানে কম হওয়ায় বাংলায় তাদের পুঁজি জোগাড়ে মন দিতে হল। এছাড়াও তাদের আমদানি করা রূপো/সোনা আর মশলায় স্থানীয় বাজারের মুদ্রার সঙ্গে সঙ্ঘাত লাগল।
কিভাবে তারা এই সমস্যা কাটিয়ে উঠল সেটা জানার আগে এই সমস্যাটা নিয়ে একটু দীর্ঘ আলোচনা করা জরুরি।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment