Saturday, November 18, 2017

বেরা ভাসান উৎসব১০ - সমুদ্র যাত্রার পাঁচালি - রীলা মুখার্জী


গ্রামীন হিন্দু মানসিকতায় খিজর

(সঙ্গে ওডিসার খুদুরকুনি ওশার দুটি ছবি দেওয়া গেল)

স্থানীয় প্রেক্ষিত আর কৃষ্টিগত চলকের জেরে বহু সময় দ্যাখা যায় মূলের প্রেক্ষিত আর উদ্দেশ্য পাল্টে যেতে থাকে। বেরাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। ব্লকম্যান এবং আশুবাবু দুজনের বেরার স্থানীয় উদ্ভব দেখেছেন। হিন্দু চাষীরা, মূলত চাষীণীরা পৌষ সঙ্ক্রান্তিতে সেদো নামক একটা আচার পালন করেন। এই আচারে তাঁরা জলে ছোট ছোট নৌকো ভাসিয়ে জল আর বর্ষার দেবতাকে সন্তুষ্ট করেন। পরের বছর ভাল চাষের জন্য এই ছল নৌকো গুলোতে তারা ফুল, আলো আর মিষ্টি ভরে ভাসিয়ে দেন। বহরমপুরের গঙ্গা পুজো একই ধরণের আচার প্রায়। আমরা কি বলতে পারি বেরা ভাসান হল হিন্দু সেদো আর গঙ্গাপুজোর সঙ্গে মুসলমান আচারগুলির সংশ্লেষের উৎসব?

বেরা
তবে বেরা সেদো বা খিজর উৎসবের থেকে চরিত্রগতভাবে আলাদা। সেই বিশেষ চরিত্রটা আমরা এখন আলোচনা করব। সেদো জানু্যারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। নাবিকেরা মানুষ যখন সমুদ্র যাত্রায় যায় তখনই সে খিজরের উপাসনা করে (তবে সময়ের টানে আমরা এর আগে স্থানীয় লিখিত উপাদান সূত্রে জেনে গিয়েছি যে ক্রমশঃ এটা বাৎসরিক উতসবে রূপান্তরিত হয়েছে)। হিন্দুদের এটা ফসল/নদী/বর্ষা উৎসব, অন্যদিকে মুসলমানের কাছে এটা সমুদ্রযাত্রার উৎসব।

উল্লেখ্য, যৌথভাবে দুটি ধারনাকে মিলিয়ে বেরা ভাসান উৎসব তৈরি হয়েছে। এটি আগস্ট সেপ্টেম্বরে আয়োজিত হয়। এখন প্রশ্ন এই সময়টা বাছা হল কেন? কারণ এক সময় বাংলা ছিল সমুদ্রযাত্রা/উপকূলবর্তী ভৌগোলিক অঞ্চল, এবং তার জন্য সমুদ্রে যাওয়ার নানা উপকরণ – মৌসুমী বায়ু, সামুদ্রিক স্রোত ইত্যাদিগুলির ধারণ বোঝা খুব জরুরি ছিল। আরব আর গ্রিকে নাবিকেরা গ্রীষ্ম বাতাস বেয়ে সমুদ্র যাত্রা করতেন আর ফিরে আসতেন শীতের সময়ে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব উপকূলের নাবিকেরা শীতের সময় সমুদ্র যাত্রা করে গ্রীষ্মের বাতাস বয়ে ফিরে আসতেন। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে উত্তরপূর্বর বাতাস আর সমুদ্র স্রোত জাহাজকে দক্ষিন এশিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার দিকে বয়ে যেতে সাহায্য করত। যাওয়ার সময়ে উত্তরপূর্ব বায়ু দ্যাখা গেলেই কার্তিক পূর্ণিমা পালিত হত, এবং বাড়ির মানুষেরা প্রবাসের দিকে যাওয়া তাদের আত্মীয় স্বজনদের সুরক্ষার জন্য এই উৎসব পালন করতেন। জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ূ অর্ণবপোতগুলিকে আবার পূর্বের উপকূলে ফিরিয়ে আনার কাজ করে। দূরে গিয়ে ভায়েদের বাণিজ্য করে নিরাপদে ফিরে আসা কামনার ঐতিহাসিক স্মৃতি আজও ওডিসার অনুঢা কন্যারা সেপ্টেম্বর মাসে পালন করেন খুদুরুকুনি ওশা(Khudurukuni Osha (ভায়ের সুরক্ষায় মঙ্গল দেবীকে পুজা করা হয় খুদ দিয়ে)) উৎসবের মধ্যে দিয়ে।

Goiten S.D. 1968, Studies in Islamic History and Institutions পাঠে আমরা আরও একটা কারণ খুঁজে পাচ্ছি। বেরা ভাসান হয় এমন সময় যখন বাংলায় দেওয়া নেওয়ার পালা শুরু হত। আদতে ভাদ্র মাসের বুধ আর বৃহস্পতিবার বাংলায় নবাবী thanksgivingএর পালা চলে। বেরার সঙ্গে যদি রমজান মাস পড়ে যায় তাহলে বেরার তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। বাংলার নবাবেরা বেরার আগেই ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবারে পুণ্যাহের আয়োজন করতেন মুর্শিদাবাদের দরবারে। সেই দিন সারা বাংলার আভ্যাগতরা আসতেন এবং তাদের দরবারিস্তরেই আপ্যায়িত করা হত। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন বুধ আর বৃহস্পতি এই দুদিন? অন্য দিনগুলো নয় কেন?

Goiten বলছেন এই দুই বারের সঙ্গে রামজানের আত্মিক যোগ আছে। বৃহস্পতিবার বাজার হবে আর শুক্রবার ঈশ্বর আরাধনা। এই প্রথাটাকে আমরা বিস্তার ঘটাতে পারি বাংলার বেরা ভাসানের সূত্রেও। রামজান হল স্বর্গের দ্বার, এই এই সময়ে দৈত্যদের শিকলিতে বেঁধে রাখা হয়। এই সময়ে কোরাণকে বিশ্বে পাঠানো হয়েছিল এবং সেই কৃতি স্মরণে এই দীর্ঘ সময় ধরে আত্মপীড়নের উৎসব করেন বিশ্বজোড়া মুসলমানেরা। ফলে আমরা যদি কৃষি আর সমুদ্র যাত্রার বিষয়টা সরিয়েও রাখি, আগস্ট সেপ্টেম্বর মুসলমান সমাজের জন্য পবিত্রতম সময়। এবং বেরা ভাসান উৎসব এই সময়ের পরেই আয়োজন করা হয়। খ্রিষ্টিয় পঞ্জিকায় এটা লেন্টএর সময়, এবং আগামী দিনগুলি আরও সখময়তায় ভরার সময়।
(চলবে)

No comments: