যেহেতু শুক্রবার ভজনা আর বিশ্রামের বার, অন্যভাষায় ছুটির বার, ফলে বেরা উৎসবের
দিন বুধ আর বৃহস্পতিবার ঠিক করা হল। বৃহস্পতিবার গুরুত্বপূর্ণ পূণ্যাহের অথবা
বাজারের দিন আর পরের দিন শুক্রবার সারা ইসলামিক বিশ্বে দুপুরে নামাজ পড়া। বৃহস্পতিবার
বাজার দিবস, নবাবেরা জনগণকে দর্শন দিতেন, তাদের দুঃখ দুর্দশা শুনতেন, এবং এ দিন
তিনি নিজের আদালতে কাজি হয়ে বসাতেন।
Goiten বুধবার আর শুক্রবার, এই দুটি দিন বাছার একটা সামাজিক
কারন দেখছেন(তিনি এটিকে ইসলামপূর্ব এবং জুডাপন্থীদের সমাজ থেকে ভাবছেন)একটি বিচারের
অন্যটি প্রার্থনা দিয়ে শুরু হচ্ছে এবং আস্তে আস্তে সেটি ধার্মিক চরিত্র গ্রহণ করছে।
আরবিতে যাকে বলা হচ্ছে, yawm
al-jum’a বা জমায়েতের
দিন, সেটি বেরা ভাসানের সময়ে এসে বুধবার থেকে এক দিন সরে গিয়েছে বৃহস্পতিবার – যে দিন
বাংলার নবাবেরা জনগনকে দর্শন দিতেন, নজর গ্রহণ করতেন এবং আদালত বসাতেন এবং জনগণের
ওপর তাঁদের সার্বভৌমত্ব আরোপ করতেন। বৃহস্পতিবারের রাত উৎসবের জন্য নিবেদিত। কেন
এটা হল সেটাই আমি আমার গবেষণায় তুলে ধরব।
বাজার না উৎসব?
সেদিন উৎসবের শুরু, বুধবার, সেদিন সাধারণত পরম্পরার ইসলামিক সমাজে বাজার দিবস,
সেদিন নবাবি সাড়া(procession) শুরু হত মাহিনগর থেকে, দ্বিতীয় দিন ভাগীরথীর
অন্যপাশের মুর্শিবাবাদ থেকে। এই সাড়ায় আমলা এবং সভাসদেরদের বিপুল ভিড় হত।
সাধারণেরা গোটা সাড়ার শেষের দিকে থাকতেন স্বাভাবিকভাবেই। নদীর ধারে পৌঁছে নবাব
নদীতে একটি সোনার দীপের বেরা, জগতশেঠ রূপোর দীপের বেরা এবং অন্যান্য অভিজাত এবং
অন্যান্যরা সাধারণ কাগজের নৌকো ভাসিয়ে নদীকে নজর দিতেন।
কারা কি ধরণের বেরা ভাসাবেন তার আকার পরিমাণ
নির্দিষ্ট ছিল। প্রথমে ভাসত নবাবের সোনার বেরা তার পরে জগত শেঠের রূপোর বেরার।
এবারে একে একে আসত সাধারণ মানুষের সাধারণ কিন্তু সুসজ্জিত বেরা। মূল বেরাটি হত ৩০
স্কোয়ার ফুট আকারে চৌকাকৃতি কলার মান্দাস করে তারোপরে বাঁশের কঞ্চির চারটি নৌকো
বসানো হত। এই গোটা বেরাটিকে কালো কাগজে মুড়ে সামনে মকরের আর পিছনে হাতির মুখ বসানো
হত। এটাই ছিল নবাবী বজরার পরম্পরার চেহারা(Anon.এর Voyage
dans les Deltas du Gange et l’Irraouaddy;, 1521, উপস্থপনা এবং সম্পাদনা প্যারিসের Genevieve Bouchon and Luis Filipe Thomaz,
Fondation Calouste Gulbenkian)। প্রত্যেক বড়
বেরাতে ছোট মাটির গড় তৈরি করা হত। প্রত্যেক বেরাকে রঙিন কাগজের, পুঁতি, মালা, ফুল,
পতাকা, নিশান, সোনার মোমবাতি এবং মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হত যাতে এটিকে মনে হয়
মুর্শিদাবাদের ছলন প্রাসাদ। এই ছলন প্রাসাদের গায়ে নানান ধরণের বাজি লাগিয়ে দেওয়া
হত। বেরা ভাসানের সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজিগুলিতে আগুণ ধরানো হত। তারিখিমানিকুড়ি আর
স্টুয়ার্ট সূত্রে পাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে চলত কামানের গর্জন এবং সানাইয়ের সুর।
প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা বলছেন চার দিকে মোমবাতি
লাগানো সুসজ্জিত বেরার দল সানাইয়ের সুরে যখন ভাগীরথীর ওপর দিয়ে ভেসে যেত বর্ষার
গুমোট রাতে, তখন জনগনের মধ্যে অপূর্ব অচিন্ত্যনীয় ভাব উদায় হত। উৎসবের শেষে গোটা
সাড়া আবার প্রাসদাদে ফিরে আসত এবং সেখানে বিপুল আকারে খাওয়াদাওয়ার সমারোহ চলত। এটাই
হল রাজ্যের প্রাথগত ধন্যবাদ দেওয়ার দিন। এই উৎসবের রেশটি শুক্রবার, ছুটির দিনেও
গড়িয়ে চলত।
No comments:
Post a Comment