Thursday, November 23, 2017

বীরভূমের লোহা শিল্প এবং চুয়াড় লড়াই১১ - যোগেশ রাম মিশ্র

ইন্দ্রনারায়ণের প্রকল্পে জমিদার আর ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব অনুভূত না হলেও ১৭৭৭ সালের ডেউচ্যায় ফারকুহরের প্রকল্পে তাদের ভূমিকা ছিল। ইন্দ্রনারায়ণের অস্তিত্ব রহস্যে মোড়া থাকলেও জন ফারকুহর কিন্তু সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ পরিচিত ব্যক্তিত্ব। এবারদিনের মারিশ্চাল মেদিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর উপাধি নিয়ে ফারকুহর লন্ডনে যান, বৈদেশিক ব্যবসায় ভাগ্য পরীক্ষা করতে। চিনের দিকে যাওয়া একটি জাহাজে একজন শল্য চিকিতসকের সহকারী হিসেবে জীবন শুরু করে, তিনি শারীর বিদ্যা সংক্রান্ত সেইটুকু জ্ঞান অবলম্বন করে, জাহাজ বদল করে শল্যচিকিতসকরূপে কলকাতায় এসে কোম্পানির কেরানী নিযুক্ত হলেন। রসায়নে উৎসাহ এবং ব্যবসায় সাফল্য তাঁকে ওয়ারেন হেস্টিংসের মত কলকাতার উচ্চকোটির মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করে।

ইন্দ্রনায়ারণ তার প্রকল্পের কথা উচ্চৈঃস্বরে না বললেও জন ফারকুহর কিন্তু তার প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে কলকাতায় যথেষ্ট সরব ছিলেন। ১৭৭৭ সালে জন, কলকাতার প্রভাবশালী হিরে ব্যবসায়ী টমাস মুটিকে নিয়ে পঁচেটের জেরিয়ায় একটা লোহা কারখানা তৈরির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির সামরিক আর ব্যবসায়ী চাহিদা মেটাতে তাঁদের কারখানা খুবই নরম লোহা উৎপাদন করবে। তারা কামান বন্দুক তৈরির পাশাপাশি চিন এবং অন্যান্য বৈদেশিক অঞ্চল থেকে আমদানি করা লোহার পাত্র, ভাজাভুজি হহ অন্যান্য তৈজস তৈরির এবং প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দেন। এছাড়াও তাঁরা চিনি কারখানার জন্য সিলিন্ডার, নুন আর সোরা কারখানার জন্য বয়লার তৈরিরও প্রস্তাব দেন। বাংলার বাড়িগুলির অঙ্গসজ্জা করাতে পেরেক, খুঁটি, দরজা, সিঁড়ি আর ঝুলবারান্দার জন্য বেড়া(rails) তৈরির কথাও বলেন। এছাড়াও তাদের উৎপাদন কোম্পানি বিদেশের অস্ত্র তৈরি কারখানায় রপ্তানিও করতে পারবে জানালেন। তাদের বিশ্বাস এই উতপাদনগুলি নিয়ে তাদের মাতৃভূমি চিরশত্রু ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আরও ভালোভাবে যুদ্ধে তৈরি হয়ে উঠবে। ছোটকরে বললে কোম্পানির সব ধরণের লোহার চাহিদা পূররণ করার প্রস্তাব দিলেন ফারকুহর। এই প্রকল্পের প্রস্তাবে ইন্দ্রনারায়ণের চুয়াড় সংক্রান্ত প্রস্তাবের প্রতিধ্বনি করা হল। বলা হল তারা ‘totally unacquainted with the conveniences and comforts of a settled and civilized state of life’।

কিন্তু ফারকুহর আর মুটির দাবিদাওয়া ইন্দ্রনারায়ণের সমস্ত শর্তের তুলনায় অনেক বেশি হল। তারা পরগণায় কারখানা, কুঠি, শ্রমিক আর কর্মচারীদের জন্য বাসস্থান তৈরির জন্য যথেষ্ট জমি চাইল। বীরভূম জেলায় ইওরোপিয় পদ্ধতিতে লোহা তৈরি করার এবং আগামী ৯৯ বছরের জন্য কোম্পানির রাজত্বের যে কোন অঞ্চলে শুল্ক না দিয়েই উৎপাদন বিক্রির একমাত্র অধিকার দাবি করল। তাদের ইচ্ছে এই প্রকল্পের ওপর বর্ধমান কাউন্সইলের কোন কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবেনা। তাদের কারখানার ইওরোপিয় কর্মচারীরা কোম্পানির কন্ট্রাকটারদের কর্মচারীর মত একই অধিকার পাবে। এর বিনিময়ে তারা নিজেদের পুঁজিতে কারখানা গড়বে এবং প্রয়োজন হলে তারা কামান বা গোলা কোম্পানিকে যে কোন সময়ে ৮০% দামে ফোর্টউইলিয়ামএ পৌঁছে দেবে।

কোম্পানির আমলারা এই প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। রামগড়ের কালেক্টর এম রামুজ স্থানীয়ভাবে শ্রমিকের অভাবের কথা জানালেন। প্রভিনশিয়াল কাউন্সিলের বক্তব্য ছিল স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিবাদ বাধতে পারে, এবং এটা সবথেকে বড় ঝামেলা হবে। আমলারা কোম্পানিকে জানাল বিনিয়োগকারীরা আগে স্থানীয় জমিদার এবং অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলুক।
(চলবে)

No comments: