Friday, November 24, 2017

বাংলার জাহাজ শিল্প ধ্বংসঃ ঔপনিবেশিক বৈষম্যের নিকষ খতিয়ান২ - ইন্দ্রজিত রায়

বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিজ এন্ড দ্য ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন(১৭৬৭-১৮৫৭) থেকে

বাংলায় সওদাগরি জাহাজের চাহিদার একটা হাল্কা আভাষ পাওয়া যায় সপ্তদশ অষ্টদশ শতকে বাংলার বন্দরগুলিতে ভ্রমণকারীদের সূত্র।

এই হিসেব কষতে আমাদের কয়েকটা উপপাদ্য তৈরি করতে হবে। প্রথমতঃ এই হিসেবে আমরা ধরে নিচ্ছি পরস্পরের থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত সাতগাঁ আর হুগলি বন্দর এক সঙ্গে চালু ছিল না, কেননা সরস্বতী নদীর নাব্যতা কমার ফলে ক্রমশঃ বিশাল পণ্যবাহীজাহাজগুলি সাতগাঁ থেকে হুগলিতে চলে আসতে থাকে। আমাদের হিসেব বলছে সাতগাঁ থেকে বিদেশপানে যাওয়া জাহাজগুলি হুগলি থেকে ছাড়ত আর উপকূল এলাকায় যাওয়া হাজাহগুলি সাতগাঁ থেকে ছাড়ত।

তালিকা১
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে বাংলায় বাৎসরিক টনেজের চাহিদা
বর্ণনা জাহাজের সংখ্যা বহন ক্ষমতা(টনেজ)
হুগলি থেকে বিদেশের বন্দর ৫৫ ২৭৫০০
সাতগা৬ও আগ্রা ১৮০ ৯০০০০
গৌড়-উপকূল এবং বৈদেশিক বন্দর ৫০ ২৫০০০
সন্দ্বীপ থেকে অসম ৪০ ২০০০০
ঢাকা, বালেশ্বর পিপ্লি থেকে শ্রীলঙ্কা টেনাসরি ২০ ১০,০০০
বেঙ্গালা থেকে কোচিন ৩৫ ১৭৫০০
বেঙ্গালা থেকে মালদ্বীপ ৩৫ ১৭৫০০
মোট ৪১৫ ২০৭৫০০

দ্বিতীয়ত, র‍্যালফ ফিচ বলছেন সাতগাঁ থেজে আগ্রার মধ্যে নৌকো করে পণ্য পরিবহন হত, কিন্তু তার পরিমান দেখে আমাদের মনে হয়েছে এটা জাহাজ হওয়াই সম্ভব, কেননা প্রত্যেকটা ৪০০-৫০০ টনের ওজনের মধ্যে ছিল। তৃতীয়ত, প্রাচীন মানচিত্র অনুযায়ী বেঙ্গালাকে আমরা আলাদা বন্দর হিসেবেই গণ্য করব, যদিও ম্যানসেল ডামেজ বলেছেন এটি কয়েকটি বন্দরের সমাহার। চতুর্থতঃ বাংলার জাহাজের সঙ্গে যেহেতু বারংবার চিনা বা আরবিয় জাহাজের তুলনা করা হয়েছে, সেই তুলনা ধরে প্রত্যেক জাহাজের পণ্য ছাড়া গড় ওজন ধরা হয়েছে ৫০০ টন। এই বহন ক্ষমতা কিছুটা কমবে যেহেতু উপকূলীয় বাণিজ্য খুব বেশি এখানে আলোচিত হয় নি। আবার অষ্টাদশ শতকে বিপুল ইওরোপিয় বাণিজ্যের ফলে জাহাজগুলির মোট বহন ক্ষমতা বেড়েছিল।

ওপরের তালিকা আমাদের বলছে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে মোট বহন ক্ষমতা ছিল ২০৭৫০০ টন, এবং একই সঙ্গে সামরিক প্রয়োজনে যে ৪০০০ জাহাজ লাগত। সব মিলিয়ে মোট ২২৩২৫০০ টন বহন ক্ষমতা। ১৬৩০ সনে ডাচ সওদাগরি বহন ক্ষমতা ছিল ৪৫০০০০ থেকে ৫৫০০০ টন, অন্যদিকে ১৬৮৬ সালে ব্রিটিশ জাহাজের বহন ক্ষমতা ছিল ৩৪০০০ টন। বাংলার বন্দরে আসা জাহাজের মাত্র ১০ শতাংশ জাহাজ বাংলার জাহাজ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হত তাহলে বাংলার বহন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়ায় ২২৩২৫০ টন, আমরা যদি ধরে নিচ্ছি ১৭৬৯-৭১ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকার ১৯টি উপনিবেশ থেকে মাত্র ২৩০৬২ টন নিয়ে বাংলায় আসত জাহাজগুলি। এবং আমরা দেখেছি সে সময় জাহাজ সারানোর কারগরি বাংলায় খুব উচ্চমানে পৌঁছেছিল। এর থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হয় যে বাংলায় এসে ইওরোপিরা জাহাজগুলি সারাই করত। উইলসন লিখছেন, of the ships sent out •from England, the Beaufort was the next to arrive after the Rochester; but she was so leaky, that Admiral Nicholson had to take her in the Hijli river to be careened।

জাহাজ তৈরির পরিকাঠামো ছাড়াও, নৌকো তৈরির শিল্পও বিশাল ছিল। গঙ্গা অববাহিকার বারমেসে নদী পরিবহন ব্যবস্থা থাকার ফলে স্থলপথে পণ্য পরিবহনের খুব ভাল পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি তা বলাই বাহুল্য, রেনেল মেমোয়ার ম্যাপ অব হিন্দোস্তানে লিখছেন, দক্ষিণ বঙ্গের শুখা মরশুমে সাধারণত কোন স্থান থেকে পঁচিশ মাইল দূরত্বের মধ্যে নদী পরিবহনের ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশে সাধারণত আট মাইলের মধ্যে নদী পাওয়া যায়। যদিও বছরভর পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ পেত না উত্তর মুর্শিদাবাদ। সম্বৎসর জল থাকার জন্য প্রয়োজন ছিল বড় নদী যেমন ব্রহ্মপুত্র, মহানন্দা, করতোয়া বা আত্রায়ি। এরফলে বাংলায় দ্বিস্তরীয় বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। নিচের স্তরে ছিল সাপ্তাহিক বা দ্বিসাপ্তাহিক বাজার গ্রামের লব্জে হাট যেখানে ক্রেতাবিক্রেতারা তাদের পশ্চাদভূমি থেকে আসত। ওপরের স্তরে ছিল স্বচ্ছল ব্যবসায়ি আর চাষীদের তৈরি বিশাল বিশাল পাইকারি দোকান, জাহাজ আর নৌকো সহ, অধিকাংশই নদীর ধারে অবস্থিত। ওপরের স্তরে নৌকো আর জাহাজ সারানো একটা বড় চাহিদা ছিল, কিন্তু হাটে সেই চাহিদা খুব যে বড় ছিল তা বলা যাবে না।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় পাদে দক্ষিণ বাংলায় অন্তত ৩০০০০ মাঝি ছিল, তারা দিন রাত কাজ করত। এবং আন্দাজ করা যায় এটা ঘটত বর্ষার সময়, যখন নদী জলে ভরে উঠে পণ্য পরিবহনের আরও বেশি উপযোগী হত, সে সময় মাঝিদের এই সংখ্যাটা হয়ত দ্বিগুণ হয়ে যেত। হেজেস বলছেন, In July and August, during the time of great rains, these eastern districts are more than half submerged, the familiar landmarks disappear, the rivers become tempestuous seas over which the boatmen labour, often in doubt, sometimes in danger'। এই পরিবেশ সারা দক্ষিণ বাংলা নৌকো তৈরির উদ্যমে সহায়ক হয়েছিল, বিশেষ করে স্থানীয় গতায়াতের জন্য ছোট নৌকো এবং ছোট সময়ের ব্যধানের পণ্য পরিবহনের জন্য মাঝারি নৌকো। ভট্টাচার্য সূত্র জানতে পারছি, [T]he building of smaller vessels must have been more dispersed [in Bengal]. Medium-sized boats between 30 and 50 tons were favoured as best for transporting merchandise by river, although boats going up to 180 tons were also in use'। বাওরে বাংলায় নানান ধরণের আঙ্গিকের নৌকো দেখেছেন বিশেষ করে পাটেলাগুলির প্রত্যেকটি ৪০০০, ৫০০০, ৬০০০ বাংলা মন ওজন বহন করতে পারত। পারগুজ নৌকোর কাজ ছিল জাহাজে মাল নামানো আর ভরা, বুয়ারের কাজ ছিল জাহাজ টেনে নিয়ে যাওয়া এবং হুগলি থেকে নুন, গোলমরিচ ইত্যাদি নিম্নবঙ্গে নিয়ে যাওয়া আর ঢাকার সঙ্গে নুনের ব্যবসা করা।
(চলবে)

No comments: