তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চুয়াড়দের পক্ষ নিয়ে বিতর্ক করেছে নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা। এঁরা এই লড়াইকে দেখেছেন কৃষক এবং কারিগরদের মিলিত যুদ্ধ হিসেবে। কিন্তু যেভাবে তাঁরা তাদের পক্ষ নিয়েছেন তাতে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকেরা বলছেন জমি আর অন্যান্য সম্পদের ওপর লোভ ছিল কোম্পানি আমলা, ব্যবসায়ী আর মহাজনদের, ঠিক তেমনি আকর্ষণ ছিল চুয়াড়দের।
কিন্তু চুয়াড়েরা কখোনো স্থায়ী অধিবাসী ছিল না। তাদের ধারণায় জমি আর জঙ্গলের অধিকার সামুহিক, এমন কি গ্রামের অধিকারেও নয়। তারা নতুন অবস্থায় মানিয়ে নিতে পারছিল না। তারা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়, একটা জমিতে যখন কিছু দিন বাস করে, তখন তারা তাদের নেতা মাঝি নির্বাচন করে, মাঝিই সমাজের হয়ে সামাজিক সম্পর্ক, এবং যে জমিতে তারা বাস করে সেটির সঙ্গে তাদের সমাজের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। এই সম্পর্কটা হিন্দু বা মুঘলদের সম্পত্তির ধারনা থেকে আলাদা। চুড়ায়দের বিশ্বে কোন জমি কোনভাবে স্থায়ী দখলের ধারনাটিই নেই। তাই কোন এলাকায় তারা যখন বেশি দিন বাস করে এবং যখন কোন জমিদার যখন তাদের থেকে কর চায় তখন তারা অন্য জমিতে গিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করে। তারা যে সম্পদ ব্যবহার করে তার ব্যবহারের অনুপাতের ওপর কর দেয়। কিন্তু কোন সরকার যদি স্থানয়ীভাবে কোন জমির ওপর কর বসায় সেটা তাদের দর্শন বিরোধী।
চুয়াড়েরা আরও একটা কারণে উপনিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। অতীতে জমিদার এবং লোহা উৎপাদকেরা তাদের খনির অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে নি। তারা চুয়াড়দের খনি কারগর হিসেবে লোহা শিল্পে মেনে নিয়েছে। নন্দিতা সহায় যাকে বলছেন পরম্পরা-নির্দেশিত প্রথা, সে ধরণের প্রথা তারা মেনে চলত। কিন্তু কোম্পানি মহালে এল রাজস্ব ব্যবস্থাপক হিসেবে, তার চরিত্র আলাদা। তারা শুধু যে প্রচলিত প্রথা এবং সম্পর্ক ভাঙল তাই নয়, তারা তাদের মত করে নতুন আইন প্রবর্তন করার উদ্যম নিল। জমিদার আর স্থানীয় অভিজাত যারা কোম্পানির আমলাদের মত করে সম্পদের ব্যবহার ভাবত, তারা কিছুটা সমঝোতা করে কোম্পানির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়েছিল। চুয়াড়েরা মেনে নিতে পারে নি।
বীরভূমের উপনিবেশপূর্ব সময়ে লোহা শিল্প তৈরিতে চুয়াড়দের অক্ষদণ্ডসম ভূমিকায় আমরা একটা বিষয় বুঝতে পারি যে সীমান্ত জেলায় কোম্পানি কতটা দুর্বলতম ছিল। কলকাতা এবং বর্ধমানে সরকারি পরিকল্পনা বীরভূমে বার বার দিশা হারিয়েছে কেননা সরকার এই কাজটি অন্য সংস্থাকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল। ক্রিস্টোফার এলেন বেইলি যাকে বলছেন প্রান্তিকভাবে থাকা ‘Indian agency’গুলি, ঔপনিবেশিক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ রূপায়নে তারা একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। স্থানীয় সংগঠনগুলির বহু ভাগে বিভক্ত হয়। এই হাইড্রা সম সঙ্গঠন ঔপনিবেশিক পৃষ্ঠভূমিতে উপনিবেশ ছড়ানোর কাজে যে প্রচুর বাধা দিয়েছিল তা চুয়াড় হাঙ্গামায় স্পষ্ট।
এটা পরিষ্কার যে চুয়াড়েরা এলাকার লোহা সম্পদ দখলে বহিরাগত শক্তি, কোম্পানির বিরোধিতা করে। তারা রাজার কর্মচারীকে বহুকাল ধরে কর দিয়ে আসছিল। কিন্তু ১৭৭০ সালে যখন রাজার হাত থেকে কোম্পানি সাল, আড়ং, খনির দখল নিয়ে রাজাকে একজন সাধারণ চাষীতে পরিণত করল তখনই চুয়াড়েরা হাঙ্গামা শুরু করে দিল। রাজারা যতদিন চুয়াড়দের খনি তৈরি করার প্রাকৃতক সম্পদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের অধিকার কেড়ে নেয় নি, রাজাকে তারা কর দিয়েই খুশি ছিল। কিন্তু যখন একচ্ছত্র একচেটিয়া একাধিপত্যের মুখোশে সাবকন্ট্রাক্ট ব্যবস্থা ঢুকে এল, যা দেখতে পেলাম ফারকুহরের ক্ষেত্রে, চুয়াড়েরা অস্থির হয়ে উঠল। নতুন সময়ে খাপ খাওয়ানোর দুটো পথ ছিল, হয় আলাদা এলাকায় চলে গিয়ে সেখানে খনির কাজ শুরু করা না হয় সরাসরি লড়াই দেওয়া। তারা দ্বিতীয়পথটা বেছে নিয়েছিল। তারা দলবেঁধে এই এলাকায় ঢুকে বাস্তবিকই লোহা কোম্পানি দুটিকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল। তারা চেষ্টা করেছিল একচেটিয়াদের হাত থেকে এই সম্পদশালী জমিকে যতটা পারা যায় একচেটিয়া লোভের হাত মুক্ত রাখার।
(শেষ)
No comments:
Post a Comment