ফ্রন্টিয়ার বা সীমান্ত শব্দটা ব্যবহার করে
কোম্পানি আধিকারিকরা এই জঙ্গুলে ভূমির দূরত্ব আর প্রান্তিকতা বোঝাতে চাইলেন। এই
মানসিক দূরত্বে পরিষ্কার তারা যে নতুন সভ্যতা বসাতে চাইলেন বীরভূমে সেটি কত
অকার্যকর। তারা মনে করলেন নতুন ভূমির জনগন পরিবর্তনের পক্ষে নয়। এর উদাহরণ হল উনবিংশ
শতকের শুরুতে জনৈক কোম্পানি আমলা বললেন এই অঞ্চলটা এক সময়ের সীমান্ত ছিল। এই সময়ের
এক জাতিতত্ত্ববিদ জানালেন, ‘the most unimprovable...who finding the old country becoming
too civilized for them, fly from the clearances they have made, hide themselves in the hill forests,
and relapse into their conditions of savages(এই উল্লেখটা পেয়েছি K. Sivaramakrishnan, Modern Forests: State-making
and Environmental Change in Colonial Eastern Indiaতে)’। বলা দরকার জঙ্গলে
আর পাহাড়ি অঞ্চলে থাকা চুয়াড়েরা কোমপানি আমলাদের এই অদ্ভুত মন-মানসিকতা বুঝত না।
কলকাতা বা বর্ধমানে বসে আমলাদের দূর প্রান্ত শাসনের মানসিকতা আসলে সীমান্ত শব্দে
প্রতিফলিত।
১৭৭০সালের বীরভূমের লোহা উৎপাদন আর ব্যবসা
যখন কোম্পানির বিভিন্ন দপ্তর বীরভূমের মত
সীমান্ত প্রদেশে পোঁছতে শুরু করল, তারা তখন ঐতিহ্যবাহী লোহা কারখানা আর তার
ব্যবসার ক্ষমতার সম্পর্কগুলি বদলাতে চাইছিল। বিশেষ করে আমি দেখাতে চাইব লোহা ব্যবসা
দখল করতে কিভাবে বীরভূমের রাজা, ব্যক্তিগত লোহা ব্যবসায়ী আর কোম্পানি আমলাদের
মধ্যে ত্রিপাক্ষিক লড়াই শুরু হয়েছিল। দাদন, ধার এবং খণিগুলির ওপরে দৈনন্দিনভাবে
নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য লড়াই লাগল। এই তিন প্রভাবশালী দলে স্থানীয় খেলোয়াড়েরা হল লোহা-মহালের
জমির মালিকেরা, বীরভূমের প্রাসাদের আমলারা আর সরকারিভাবে নিযুক্ত কলকাতার লোহা
কেনার দালাল। এই ত্রিপাক্ষিক লড়াইতে ক্রমশঃ ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে পক্ষ বদল হতে
থাকল। লোহার বাজারের রাজনীতি কিভাবে বাজারে ক্ষমতার ভারসাম্যকে বদল করছে জানার আগে
আমাদের জানান প্রয়োজন লোহা উৎপাদন এবং লোহা উতপাদকেদের বিষয়ে।
ঔপনিবেশিক লোহা উৎপাদন ব্যবস্থার ইতিহাসে লোহাচুর
যারা তুলতেন, যারা লোহা গলাতেন এবং সেগুলো বিক্রি করতেন স্থানীয় এলাকায় তাদের বিশদে
বর্ণনা নেই। তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তির বর্ণনা ছড়িয়ে আছে উনবিংশ
শতকের নানা বর্ণনায়। সেই সময়ের কিছু নৃতাত্ত্বিক কাজে লোহাকমদের প্রযুক্তি এবং
লোহাকম আদিবাসীদের বিষয়ে লেখাপত্র আছে। পরবর্তী দুই শতকে লোহা তৈরির প্রযুক্তি এবং
তার উৎপাদন ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়ে যাবে ক্রমশঃ, কিন্তু এই ব্যবস্থার সঙ্গে জুড়ে
থাকা বেশকিছু পবিত্র আচার আচরণ সহজে পরিবর্তিত হয় নি।
কোম্পানির সার্ভেয়ার ফ্রান্সিস বুকানন ভাগলপুর
সমীক্ষার সময় বহুবার বীরভূমের পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত টহল দিয়েছেন। তিনি
১৮১০ সালে পশ্চিম বীরভূমে কোল নামে একটি আদিবাসী সমাজের দ্যাখা পান, তার মতে এরাই
বীরভূমের লোহা তৈরির আদি মানব(C. E. A.
W. Oldham (ed.) Journal of Francis
Buchanan Kept During the Survey of the District of Bhagalpur in 1810-1811)। তার মন্তব্য ছিল পরিযায়ী এই সমাজে লোহাকাম
একটি পারিবারিক উদ্যম। ‘stick pointed with
iron like a chisel’ দিয়ে তারা লোহাচুর উদ্ধার করে, বাতাস বইয়ে
বিভিন্ন মাটি আর পাথর বাদ দিয়ে তারা কাঠকয়লা গুঁড়ো মেশায়। চুল্লিগুলি অস্থায়ীভাবে
তৈরি হয়, প্রত্যেকটা চুল্লি প্রত্যেক পারিবারের অস্থায়ী চালাঘরে থাকে(Martin, Histories,
Antiquities and Topographies)। অন্যান্য
যায়গায় তারা নদীর তীর থেকে লোহাচুর বার করে। হাপর তৈরি করে চামড়া আর বাঁশের কঞ্চি
দিয়ে(Oldham, Journal of Francis Buchanan)। উনবিংশ শতকে
প্রযুক্তিবিদেরা বুকাননের সমীক্ষা ধরে বললেন, কোলেদের খোঁড়ার প্রযুক্তি যা ছিল
সেটি খুব গভীরে যেত না বইলেই তারা অন্য খনি এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হত। তারা খনির
কাছেই লোহা গলাত। এগুলো ভ্রাম্যমান কর্মশালা। এই প্রযুক্তি তাদের ভ্রাম্যমান
চরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যেত(T.
Oldham, Report of the
Examination of the Districts in the Damoodah Valley and Beerbhoom, Producing Iron Ore (Calcutta: Military Orphan Press, 1852). Buchanan saw that miners in
Kukoriya ‘lived’ 2 miles away from the mines. In
Pahiridihi, mines extended ‘from thence to Chandan, distance about eight coses’ (Oldham, Journal of Francis Buchanan, p. 14). At Nuni, he was told that ‘most of the miners had retired to Dumka’, while at Dumka, he was told
that ‘the last spring all the miners had retired to some other places’ (p. 46). All these entries suggest a high
degree of mobility of the miners and not, as Buchanan suspected an effort to conceal their vocation.)। তারা সেপ্টেম্বর থেকে তিন মাস কাজ করত।
বাঁকাতে বুকানন চাষের পরে তাদের পাঁচ মাস লোহার কাজ করতে দেখেছেন।
No comments:
Post a Comment