এই পর্বের অনুবাদক সৌরভ রায়(Sourav Roy)।
বেরা-কে 'সঞ্চার' হিসেবে দেখা
ভিক্টর টার্নারের ভাষ্যে 'সঞ্চারের বৈশিষ্ট্য হল যে তা সবসময়েই দোরোখা...সঞ্চারী অস্তিত্বের আঁটো শাঁস কিছু নেই ('লিমিনালিটি অ্যান্ড কমিউনিটি')।'
কিন্তু বেরা-ভাসান নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি রিচুয়াল- সংক্রান্ত 'সঞ্চার'-তত্ব টেনে আনছি কেন? কারণ আমার মনে হয়, 'বেরা'-র চিহ্ন এমন এক দশা-বদলের দিকে ইঙ্গিত করে, যা অন্তর-বাহির আর ব্যক্তিগত-ব্যষ্টিগত-র মধ্যে এক মানস-সেতু।
বেরা এই সম্ভাব্য দশা-বদলের বা সঞ্চারী অস্তিত্বের অনুপান। সেই সঞ্চারী অস্তিত্বের আঁটো শাঁস না থাকলে-ও তা কিন্তু ফাঁপা নয়, কারণ ফাঁপা হলে তাতে নতুন দশার অঙ্কুর আসবে না। খোজা খিজির , যাঁকে বেরা ভাসানের একরকম অধিদেবতা বা এই দশা-বদলের এক আলকেমিস্ট বলা যায়, তিনিও কিন্তু দুই মানসিক দশার এবং জল-স্থলের এক সেতু, যেখানে স্থল যা কিছু ভূত-গত তার, আর জল যা কিছু আধ্যাত্মিক তার, চিহ্ন। অতএব বেরা সঞ্চারের এক অনুপান, তাকে ভাসান দেওয়া এক সঞ্চারী ক্রিয়া। যে মুহুর্তে বেরা জল স্পর্শ করে, তৎক্ষণাত জল-স্থল ও ভৌতিক-আধ্যাত্মিক জুড়ে দিয়ে এক জীবন-সেতু রচনা হয়, যাতে অধিষ্ঠান করেন খিজির।
পল গিলরয় আফ্রো-আমেরিকীয় মানস নিয়ে আলোচনায় দাসবাহী জাহাজ-কে 'মাঝপথ' বলেন। ণীশে-র উদ্ধৃতি তুলে দেন: ' ডাঙ্গা ছেড়ে ভেসে চলেছি। সব পিছুটান কাটিয়ে - মন থেকে ডাঙ্গার সব স্মৃতি রগড়ে মুছে দিয়েছি। এবার মাঝদরিয়ায় এই মোচার খোলের মত 'ছোট্ট নৌকো'-ই ভরসা ! এই দরিয়া কখনও খেপে উঠে গর্জায়, কখনও সোনা-বোনা চীনাংশুকের মত মৃদু লহর দেয়। কিন্তু ভাসতে ভাসতে এক সময় মনে হবে নিঃসীম, আর সীমাহীনতার থেকে ভয়ঙ্কর- সুন্দর আর কিছু-ই নেই।'
ণীশে-র ঐ 'ছোট্ট নৌকো'-ই আমাদের বেরা, যা দুই জগতের মাঝের সেতুচিহ্ন: বাংলার সুফলা জমিন আর সুজলা নদীজাল – যার ওপর ভরসা করে বাংলার মানুষ আজ-ও বেঁচে আছে। এই 'মাঝপথ' তাই এক বানিজ্যপথ যা বেয়ে জমির ও জমির মানুষের উৎপন্ন ধনভার মধ্যগাঙ্গেয় এলাকা আর বঙ্গোপসাগর পারের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও উপার্জন হয়ে ফিরে আসে। বেরা-ভাসান বাংলার বিভিন্ন জাতের মধ্যেও এক 'মাঝপথ' , যারা বেঁচে থাকে জমি ও দরিয়ার ফসলের ভরসায় । বেরা-ভাসান তাই এমন দরজার চৌকাঠ যাতে সব জাতের পায়ের ধুলো সমান ভাবে পড়ে। এ দরজা সবার জন্য খোলা রাখতেই হয়, কারণ সমাজের সবার রুজিরুটি এই দরজা পেরিয়েই আসে। আর আমরা যদি বেরা-র পারসি-আরবী চিহ্নতন্ত্র কে মানি, তাহলে এই জলযান দুই দরিয়ার 'মাঝপথ', ভৌতিক-আধ্যাত্মিকের যোগ, টার্নারের 'সঞ্চারী'।
বেরা-র এত অর্থ আর এত গুরুত্বের মধ্যে বাছ-বিছার করতে গেলে কি খুঁজতে হবে এর উৎসমুখ ? একে শুরু করেছিল কি জেলেরা না মধ্যযুগের বাংলার জাহাজীরা? 'আরব'-দের কি নিজেদের আলাদা বেরা-ভাসান ছিল, যা পরে এতে মিশে যায়? বাংলার সুলতানি আর মোগল শাসন কি এই প্রথা-কে দাবাতে চেয়েছিল না চাগাতে? এখনো অব্দি এসব প্রশ্নের উত্তর অধরা-ই।
বেরা অতএব শুধু এক নিরুদ্দেশ যাত্রার অনুপান নয়, এর ভাসান-ও নয় এক ফাঁপা আচার। বেরা-ভাসান দুই ভুবনের, দুই ভূগোলের, দুই বাণিজ্যের সেতুসম্ভব।
বেরা-কে 'সঞ্চার' হিসেবে দেখা
ভিক্টর টার্নারের ভাষ্যে 'সঞ্চারের বৈশিষ্ট্য হল যে তা সবসময়েই দোরোখা...সঞ্চারী অস্তিত্বের আঁটো শাঁস কিছু নেই ('লিমিনালিটি অ্যান্ড কমিউনিটি')।'
কিন্তু বেরা-ভাসান নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি রিচুয়াল- সংক্রান্ত 'সঞ্চার'-তত্ব টেনে আনছি কেন? কারণ আমার মনে হয়, 'বেরা'-র চিহ্ন এমন এক দশা-বদলের দিকে ইঙ্গিত করে, যা অন্তর-বাহির আর ব্যক্তিগত-ব্যষ্টিগত-র মধ্যে এক মানস-সেতু।
বেরা এই সম্ভাব্য দশা-বদলের বা সঞ্চারী অস্তিত্বের অনুপান। সেই সঞ্চারী অস্তিত্বের আঁটো শাঁস না থাকলে-ও তা কিন্তু ফাঁপা নয়, কারণ ফাঁপা হলে তাতে নতুন দশার অঙ্কুর আসবে না। খোজা খিজির , যাঁকে বেরা ভাসানের একরকম অধিদেবতা বা এই দশা-বদলের এক আলকেমিস্ট বলা যায়, তিনিও কিন্তু দুই মানসিক দশার এবং জল-স্থলের এক সেতু, যেখানে স্থল যা কিছু ভূত-গত তার, আর জল যা কিছু আধ্যাত্মিক তার, চিহ্ন। অতএব বেরা সঞ্চারের এক অনুপান, তাকে ভাসান দেওয়া এক সঞ্চারী ক্রিয়া। যে মুহুর্তে বেরা জল স্পর্শ করে, তৎক্ষণাত জল-স্থল ও ভৌতিক-আধ্যাত্মিক জুড়ে দিয়ে এক জীবন-সেতু রচনা হয়, যাতে অধিষ্ঠান করেন খিজির।
পল গিলরয় আফ্রো-আমেরিকীয় মানস নিয়ে আলোচনায় দাসবাহী জাহাজ-কে 'মাঝপথ' বলেন। ণীশে-র উদ্ধৃতি তুলে দেন: ' ডাঙ্গা ছেড়ে ভেসে চলেছি। সব পিছুটান কাটিয়ে - মন থেকে ডাঙ্গার সব স্মৃতি রগড়ে মুছে দিয়েছি। এবার মাঝদরিয়ায় এই মোচার খোলের মত 'ছোট্ট নৌকো'-ই ভরসা ! এই দরিয়া কখনও খেপে উঠে গর্জায়, কখনও সোনা-বোনা চীনাংশুকের মত মৃদু লহর দেয়। কিন্তু ভাসতে ভাসতে এক সময় মনে হবে নিঃসীম, আর সীমাহীনতার থেকে ভয়ঙ্কর- সুন্দর আর কিছু-ই নেই।'
ণীশে-র ঐ 'ছোট্ট নৌকো'-ই আমাদের বেরা, যা দুই জগতের মাঝের সেতুচিহ্ন: বাংলার সুফলা জমিন আর সুজলা নদীজাল – যার ওপর ভরসা করে বাংলার মানুষ আজ-ও বেঁচে আছে। এই 'মাঝপথ' তাই এক বানিজ্যপথ যা বেয়ে জমির ও জমির মানুষের উৎপন্ন ধনভার মধ্যগাঙ্গেয় এলাকা আর বঙ্গোপসাগর পারের দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও উপার্জন হয়ে ফিরে আসে। বেরা-ভাসান বাংলার বিভিন্ন জাতের মধ্যেও এক 'মাঝপথ' , যারা বেঁচে থাকে জমি ও দরিয়ার ফসলের ভরসায় । বেরা-ভাসান তাই এমন দরজার চৌকাঠ যাতে সব জাতের পায়ের ধুলো সমান ভাবে পড়ে। এ দরজা সবার জন্য খোলা রাখতেই হয়, কারণ সমাজের সবার রুজিরুটি এই দরজা পেরিয়েই আসে। আর আমরা যদি বেরা-র পারসি-আরবী চিহ্নতন্ত্র কে মানি, তাহলে এই জলযান দুই দরিয়ার 'মাঝপথ', ভৌতিক-আধ্যাত্মিকের যোগ, টার্নারের 'সঞ্চারী'।
বেরা-র এত অর্থ আর এত গুরুত্বের মধ্যে বাছ-বিছার করতে গেলে কি খুঁজতে হবে এর উৎসমুখ ? একে শুরু করেছিল কি জেলেরা না মধ্যযুগের বাংলার জাহাজীরা? 'আরব'-দের কি নিজেদের আলাদা বেরা-ভাসান ছিল, যা পরে এতে মিশে যায়? বাংলার সুলতানি আর মোগল শাসন কি এই প্রথা-কে দাবাতে চেয়েছিল না চাগাতে? এখনো অব্দি এসব প্রশ্নের উত্তর অধরা-ই।
বেরা অতএব শুধু এক নিরুদ্দেশ যাত্রার অনুপান নয়, এর ভাসান-ও নয় এক ফাঁপা আচার। বেরা-ভাসান দুই ভুবনের, দুই ভূগোলের, দুই বাণিজ্যের সেতুসম্ভব।
No comments:
Post a Comment