পলাশী-যুদ্ধের চারি বৎসর পূৰ্ব্বে ১৭৫৩ খ্ৰীষ্টাব্দে, এক দরিদ্রের গৃহে প্রীতিরাম দাস জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যে গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় সামান্য বাঙ্গলা ভাষা ও গণিত শিক্ষা করিয়া ১৭৬৭ খ্ৰীষ্টাব্দে চতুর্দশ বৎসর বয়সে, মাতুপিতৃহীন প্রীতিরাম, রামতনু ও কালীপ্রসাদ নামক দুই কনিষ্ঠ সহোদর সহ কলিকাতায় জানবাজারের তদানীন্তন বিখ্যাত জমিদার মান্নাবাবুদিগের পুরস্ত্রী, তাঁহার পিতৃস্বসার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং অল্প ইংরাজি ভাষা শিখিয়া দালালী ও ফোর্টউইলিয়ম দুর্গে ইংরাজসৈন্যের রসদ যোগাইবার কার্য্য করিতে লাগিলেন। এই সূত্রে ফোটের জনৈক পদস্থ ইংরাজ কৰ্ম্মচারীর সহিত বিশেষভাবে পরিচিত হইয়া প্রীতিরাম তাহার সহিত ঢাকায় গমন করেন ও তথায় উক্ত ইংরাজের সহায়তায়, নাটোর রাজসরকারে এক বিশিষ্ট কৰ্ম্মচারীর পদে নিযুক্ত হন। ১৭৭৭ খৃষ্টাব্দে চব্বিশ বৎসর বয়সে, প্রীতিরাম সঞ্চিত অর্থসহ নাটোর হইতে কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিয়া, আশ্রয়দাতা মান্না-পরিবারের, যুগলমান্নার একাদশ বর্ষীয়া কন্যার পাণিগ্রহণ ফলে, জানবাজারের কয়েকখানি বাড়ী ও ষোল বিঘা জমি যৌতুক লাভ করেন। এই বিবাহের ফলস্বরূপ ১৭৭৯ খ্ৰীষ্টাব্দে তাহার প্রথম পুত্র হরচন্দ্র এবং ১৭৮৩ খ্ৰীষ্টাব্দে দ্বিতীয় পুত্র রাজচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন।
কলিকাতায় আসিয়া, প্রীতিরাম আমদানী ও রপ্তানীর কার্য্য করিতেন। পরে ১৭৮৭ খ্ৰীষ্টাব্দে বরণ কোম্পানী নামক তদানীন্তন ইংরাজ-বণিকদলের তদানীন্তন ইংরাজ-বণিকদলের মুৎসুদ্দি পদে নিযুক্ত হন । ১৮০০ খৃষ্টাব্দে, নাটোর রাজের অধিকারস্থ কয়েকটী পরগণা লাটে উঠিলে, দেওয়ান শিবরাম সান্ন্যালের সহায়তায়, প্রীতিরাম উনিশ হাজার টাকায়, মকিমপুর পরগণা খরিদ করিলেন। কনিষ্ঠ সহোদর কালীপ্রসাদ নবক্রীত পরগণার নায়েবী কাৰ্য্যভার গ্রহণ করিয়া এই জমীদারী হইতে কলিকাতার বাটতে বাশ, কাঠ, মৎস্য প্রভৃতি চালান দিতে লাগিলেন। প্রীতিরাম ঐ সকল পণ্য বিক্রয়ের জন্য, বেলেঘাটায় একটি আড়ত স্থাপন করিলেন । সেকালে অনেকগুলি বাঁশ একত্রে বাঁধিয়া নদীতে ভাসাইয়া আনা হইত। ইহাকে চলিত কথায় “বাঁশের মাড়" বলে, বংশ-ব্যবসায়ী প্রীতিরাম এইরূপে “মাড়” নামক ব্যবসায়গত উপাধি লাভ করেন। এই সময়েই বেলেঘাটায় একটি লবণের আড়ত স্থাপিত হয়।
প্রীতিরাম,, পুত্রদ্বয়কে তৎকালসুলভ শিক্ষা প্রদান করিয়া, তাহাদের বিবাহ দিয়াছিলেন। ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে, কনিষ্ঠ রাজচন্দ্রের প্রথম বিবাহ ও সেই বৎসরেই স্ত্রীবিয়োগ হইলে, প্রীতিরাম পরবৎসর পুত্রের পুনৰ্ব্বার বিবাহ দেন। সে স্ত্রীও বিবাহবৎসরেই গতায়ু হন। ঐ বৎসরেই জ্যেষ্ঠপুত্র হরচন্দ্র একমাত্র বিধবা রাখিয়া নিঃসস্থান অবস্থায় পরলোক গমন করেন। ১৮০৩ খ্ৰীষ্টাৰে প্রীতিরাম,, কনিষ্ঠ পুত্র রাজচন্দ্রের তৃতীয়বার বিবাহ দেন। রাজকরে এই সহধৰ্ম্মিণী, উত্তরকালবিখ্যাত রাণী রাসমণি। প্রীতিরামের জীবদ্দশায় রাজচন্দ্র ও রাসমণির দুইটি কন্যা—পদ্মমণি ও কুমারী জন্মগ্রহণ করেন। ১৮০৩ খৃষ্টাব্দে প্রীতিরাম, জানবাজারের বর্তমান সুবৃহৎ পারিবারিক আবাস নিৰ্ম্মাণ আরম্ভ করেন। সাৰ্দ্ধ ছয়লক্ষ মুদ্রা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর যম্পত্তি রাখিয়া ১৮১৭ খ্ৰীষ্টাব্দে চৌষটি বৎসর বয়সে, প্রীতিরাম দাস পরলোক গমন করেন।
No comments:
Post a Comment