ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি অধিকার পাওয়ার পর ১৭৬৭ সালে বীরভূমের জঙ্গলমহলে দেওয়ান হিসেবে যে কজনকে এই অঞ্চলের রাজস্ব কাঠামো দেখার জন্য পাঠানো হল লেফটানেন্ট ফারগুসন এবং তাঁর বাহিনী অন্যতম(Suchibrata Sen, The Santhals of Jungle Mahals: An Agrarian History 1793-1861 আর ফারগুসনের যাওয়ার উদ্দেশ্য এবং স্থানীয়দের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে পড়ুন Binod Das, Changing Profile of the Frontier Bengal)। আমলারা স্থানীয় ফসল উৎপাদন, পুকুর, খনি, খাদান এবং জঙ্গলের তথ্য সংগ্রহ করেন। স্থানীয় রাজা এবং গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হয় এবং স্থানীয় অভিজাতরা কোম্পানিকে নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায়ের(জমা) সম্মতি জানান। বদলে দাবি ছিল খেলাতের এবং সেই রাজস্বের ভাগের। ব্রিটিশ প্রশাসনিক ইতিহাসে এই ধরণের পদ্ধতির নাম সেটলমেন্ট এবং এটিই এই অঞ্চলে কোম্পানির সার্বভৌমত্ব রক্ষার একটি ধাপ। দীর্ঘদিনের চলে আসা ক্ষমতার সমীকরণ বদলানোর অবস্থা তৈরি হল।
আরও রাজনৈতিক বিভাগ গড়ে উঠল ১৭৭৩-৭৪ সালে ছয়টা প্রভিন্সিয়াল রেভিনিউ কাউন্সিল তৈরি হওয়ায়। এত দিন বীরভূমের রাজা বাংলার সীমান্তে নিজের বলে কর আরোপ, নিজের পাঞ্জায় জমির দলিল দেওয়া ইত্যাদির অধিকারী ছিলেন। অঞ্চলের যে কোন অর্থনৈতিক কাজে তার নাম আর দেওয়া পাঞ্জার ছাপ প্রয়োজন ছিল। বীরভূমের জনগনের কাছে তিনি রাজা, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। যদিও তিনি বাংলার নবাবের করদ রাজা ছিলেন, কিন্তু তিনি এত কম কর দিতেন যে তাঁকে নবাবের অধীন না বলে খুশিতেই তিনি নবাবের বশ্যতা মেনে নিয়েছেন বলা চলত।
মুশকিল হল, সেটেলমেন্টের পরে রাজা সাধারণ করদ রায়তে পরিণত হলেন। তিনি যদি নির্দিষ্ট সময়ে কোম্পানির ইচ্ছে মত রাজস্ব জমা দিতে পারেন তাহলে তার ভাগটুকু তিনি পাবেন, এবং তার বসতবাড়িটা রক্ষা করতে পারবেন মাত্র। তাঁর কোন নির্দিষ্ট রোজগার রইল না। তিনি কোম্পানির বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন। নিজের সেনার অভাবে কোম্পানির সেনা নিয়ে তার বিদ্রোহী প্রতিবেশীদের ধমকাতে সুরু করলেন। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে তিনি যদি রাজস্ব বাকি রাখেন তাহলে, তার জমিদারি নিলামে তুলে দেওয়া হবে এবং তাঁর প্রজাদের কাছে তিনি যতটুকু সম্মান আদায় করছেন, সেটাও অবলুপ্ত হয়ে যাবে।
তবুও রাজার রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মুখোশটা রইল ঔপনিবেশপূর্বের। তার জমিদারিটা এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের কেন্দ্র। চাষের জমি, লোহা-মহাল, জঙ্গল মহলের রেশম বা কাঠ থেকে রাজস্ব আসত। প্রত্যেক অঞ্চলে থাকতে রাজস্ব আদায়কারী(কুতকিনাদার)। তারা এলাকায় দালাল ছড়িয়ে রেখে রাজাকে রাজস্ব তুলে দিত। দালালেরা ছিল রাজস্ব আদায়ের মুখ। কোম্পানির আমলারা(নায়েব) এবং সেনাপতি(ফৌজদার) রাজার রাজস্ব আদায়ের তথ্য(হাসিল) বিশ্লেষণ করে, আদায়ে কোন ঘাটতি আছে কিনা দেখতেন। কোন ছোট্ট ‘বিফলতা’য় বা দাবি প্রতিষ্ঠা করতে রাজাকে চিঠির পর চিঠির বন্যা বইয়ে দিত কোম্পানির কর্মচারীরা(রাজ পরিবারের ইতিহাস জানতে O’Malleyর Bengal District Gazetteers, Birbhum দেখুন)। যদিও রায়তেরা তাদের উৎপাদনের অংশ রাজাকে রাজস্ব হিসেবে দিচ্ছেন, কিন্তু তারাও বুঝতে পারছেন যে, রাজা তার সার্বভৌমত্ব শুধু হারান নি, যে কোন বিরোধের একমাত্র মিমাংসার অধিকার আর তার হাতে নেই।
(চলবে)
Iron and Salt Production Experiments in the East Indies,
1765 – 1858 Yogesh Ram Mishra থেকে
No comments:
Post a Comment