বঙ্কিমচন্দ্র কৈবর্ত সফলরাম গুড়ের সন্তান মুচিরাম গুড়কে নিয়ে যে অশ্লীল বার্তা নামিয়েছেন, তা নিয়ে বাংলার ভদ্রসমাজ কোনদিন বিন্দুমাত্র বিব্রত হয়েছে এমন বার্তা পাওয়া যায় নি। ফলে তারা যে জমিদার হলেও প্রীতিরাম মাড়ের কথা শুনবেন না, তা বলাই বাহুল্য।
জানবাজারের কৈবর্ত জমিদারনী রাণী রাসমণির নাম জানি, কিন্তু তাঁর শ্বশুরের নাম কেউ জানি - প্রীতিরাম মাড় - জাতিতে কৈবর্ত? নাহ, আমি অন্তত জানতাম না।রানী রাসমণি ভদ্রদের সম্মান পেয়েছেন, কেননা তিনি রামকৃষ্ণের পালক, এবং রামকৃষ্ণ মিশন, মঠ তাঁর পৃষ্ঠপোষক হয়েছে। তাই কৈবর্ত কন্যার নামটি জলচল হয়েছে। Dipankarদা রাসমণির ইতিহাস ঘাঁটতে না বললে আর এই বইটা না কিনলে জানতে পারতাম না তাঁর শ্বশুরের নাম।
খুললাম কলকাতা হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের কলকাতার ইতিহাস - কলকাতা সেকালের একালের। হ্যাঁ সেখানে ৯৯৯ পাতায় জানবাজারের মাড়বাবুগণ (রানী রাসমণি) নিয়ে দুপাতার লেখা আছে। সেই লেখাটি আপনাদের জন্য তুলে দেব পরে - কি করে ব্রিটিশদের সহায়তায় অসহায় অবস্থা থেকে প্রীতিরাম জানবাজারে সে যুগে ৬ লক্ষ টাকা ব্যয় করে আজকের যেটি দ্যাখা যায়, সেই প্রাসাদটি বানালেন, তার গল্প - তিনি কলকাতার অন্যান্য জমিদারদের মত লবণ ব্যবসায়ও করেছেন।
কিন্তু আমরা যারা আম জনতা একটু আধটু কলকাতার জমিদারির ইতিহাস নানান কারণে জেনেছি, তারা জানি কলকাতার লবণ সাম্রাজ্যে লাহা, দত্ত, ঠাকুর, দে, মতিলাল, এমন কি রানাঘাটের পালচৌধুরীদের নাম লেখা আছে। কিন্তু আমরা কি কোনদিন জমিদার প্রীতিরাম মাড়ের কথা শুনেছি? তাঁর কাছে দ্বারকানাথ ২ লক্ষ টাকা ধার করেছিলেন - সে কথা? নাহ!
দাদারা আমি বলতে পারি আমি বেশ মন দিয়ে কলকাতার লবণ ব্যবসা, তার জাতি চরিত্র, সেই ব্যবসায় দল পাকানোর ইতিহাস নিয়ে জাপ গবেষক, নিম্নবর্ণের ইতিহাস কিছুটা বাংলায় লেখা ব্যতিক্রমী বিখ্যাত গবেষকের বয়ানে, এমন কি ছোটলোক বাইওয়ালা বিনয় ঘোষের লেখায় কলকাতার জমিদার আর লবণ ব্যবসা নিয়ে বেশ পড়াশোনা করেছি, শ্রীপান্থও পড়েছি, দ্বারকানাথ সম্বন্ধে বাংলা ইংরেজিভাষায় যতটুকু পড়ার আছে তাও পড়েছি - লিখেছি, ঔপনিবেশিক কলকাতা গড়ে ওঠার সময় জানবাজারের ইতিহাস কি ছিল তাও কিছুটা জানি, কিন্তু কোনদিন জানবাজারের জমিদার প্রীতিরাম মাড়ের কথা শুনিনি। যে ইতিহাস পড়ে আমরা আমাদের মন মানসিকতা তৈরি করি, সে ইতিহাস মাড়, মান্না("কলিকাতায় জানবাজারের তদানীন্তন বিখ্যাত জমিদার মান্নাবাবু"), গুড়বাবুদের সাফল্যের কথা আমাদের জানায় না।
হায়! দেখুন কিভাবে বাংলার ইতিহাস তৈরি হয়েছে! কিভাবে চিহ্নিত করে ছোটলোকেদের প্রান্ত বাংলার নয়, খোদ কলকাতার ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে! সে মুছে দেওয়ার কাজে আমাদের সক্কলের হাতে রক্ত লেগে আছে। সে ইতিহাস আমাদের নতুন করে লিখতে হবে।
অবশ্যই, যারা ইংরেজদের অবলম্বন করে জমিদার হয়েছেন তাদের সক্কলের প্রতি আমাদের ছোটলোকেদের ঘেন্না ছিল আছে থাকবেও। কিন্তু ইতিহাস কিভাবে পরিকল্পনা করে অবস্থাপন্ন ইংরেজপন্থী ছোটলোকেদেরও ক্ষমতার আলোচনার বাইরে বার করে দেয় সে ইতিহাস প্রীতিরাম মাড়কে দিয়ে আমরা অনুভব করছি।
No comments:
Post a Comment