বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিজ এন্ড দ্য ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন(১৭৬৭-১৮৫৭) থেকে
ঔপনিবেশিক পূর্ব সময়ে সামরিক এবং সওদাগরি, দু ধরণের জাহাজ বাংলায় তৈরি হত। মুঘল আমলে পূর্বভারতে জলদস্যু এবং বহুঃশক্তির আক্রমণ রুখতে নৌবাহিনী বিশাল নৌবহর(আইনিআকবরির ইংরেজি অনুবাদে এডমিরালিটি এবং বাহিনীর নাম ফ্লোটিলা) তৈরি করেছিল। ঢাকা তখন বাংলার রাজধানী – রূপনারায়ণ এবং দামোদরের সংযোগস্থল মন্ডলঘাট থেকে আজকের ওডিসার বালেশ্বর বন্দরের পর্যন্ত উপকূল এলাকা টহল দিত এই নৌবাহিনীর সুসজ্জিত জাহাজ। পাদশাহ আকবরের সময় ৩০০০ নৌকোর নৌবহরের বাৎসরিক খরচ ছিল ৮৫০০০০ স্টার্লিং রুপি(এখন থেকে টাকা), এর মধ্যে সাড়ে তিন লক্ষ বরাদ্দ ছিল কর্মচারীদের (৯২৩ জন পর্তুগিজ নাবিকের মাইনে ধরে) মাইনে হিসেবে। ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল নতুন জাহাজ কেনা আর পুরনো জাহাজ সারাবার খরচ হিসেবে। যেহেতু নৌবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল জাহাজ এবং নৌকোর বরাত দেওয়া, তাই ঢাকায় বিপুল সংখ্যায় জাহাজ তৈরির উদ্যম দ্যাখা দেয়। এই উল্লেখ থেকে বুঝতে পারি আকবরের রাজত্বে, কাশ্মীর এবং সিন্ধুর সঙ্গে কেন বাংলা, ভারতের নৌবহর মানচিত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আবুলফজল লিখছেন, মহামহিমের রাজত্বে প্রত্যেক অঞ্চলে প্রচুর জাহাজের সমারোহ কিন্তু বাংলা, কাশ্মীর আর তাথা(সিন্ধু) হল ব্যবসার অতুলনীয় কেন্দ্র। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত মুঘল নৌবহর, নৌবাহিনী বানাত না, ব্যক্তিগত উদ্যোগীদের বরাত দিয়ে বানানো হত। ফলে ঢাকার আশেপাশে বিশাল নৌকো বানাবার কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ঢাকা, হুগলি, বালেশ্বর, মৌরাং এবং করিবাড়ি থেকে মুঘল প্রশাসন বরাত দিয়ে জাহাজ কিনত। সুজা বাংলার নবাব থাকাকালীন সময়ে নৌবহরের পরিমান বাড়ানোর কাজ তেমনভাবে ঘটে নি, কিন্তু শায়েস্তা খা বাংলার দায়িত্বে আসার পরে খুব কম সময়ে ৩০০ জাহাজ তৈরির বরাত দেন, তারজন্য তিনি করও আরোপ করেন। হুগলি, যশোর, পিপলি এবং বালেশ্বররের নৌকো কারবারিদের থেকে বাংলার সুবাদার (চলতিভাষায় নবাব) নৌকো কিনেছিলেন বাংলাজোড়া কর আরোপ করে, প্রত্যেকটা ছিল ৪০০-৬০০ টনের।
টোডোরমল্লের সময়ে রাজস্ব ব্যবস্থা আদায় থেকে বিপুল বরাদ্দ দেওয়া হতে থাকে নৌবহর বানাতে। তিনি ঢাকাকে ১১২টি পরগনায় বিভিন্ন জমিদারিতে বিভক্ত করেন, জমিদারেরা শুধুই ওমেল নাওয়ারা নামে সরকারি নৌকো তৈরি আর সারানোর জন্য কর দিতেন। এই সব এলাকায় জমি এতই উর্বর ছিল যে নৌবাহিনীর মোট বরাদ্দের ৮০ শতাংশ আসত এই ব্যবস্থা থেকে, বাকি ২০ শতাংশ আসত সিলেট থেকে একই ধরণের ব্যবস্থাপনায়। ঢাকার আশেপাশের যে সব জমিদারেরা থাকতেন তারা নগদ রাজস্ব দেওয়ার বদলে জায়গির বরাদ্দ পেতেন এবং তাদের নৌবহর রাখতে হত। এই ব্যবস্থায় সরকারি বিপুল বরাদ্দে বিপুল পরিমানে জাহাজ তৈরি হওয়ায়, জাহাজ তৈরি শিল্প বিরাটভাবে বিকাশলাভ করে। এছাড়াও শ্রীপুর, বাকলা, সাগর দ্বীপ, দুধালি, জাহাজঘাটা এবং চাকারশির মত প্রচুর হিন্দু জমিদার জাহাজ তৈরিতে মদত দেন। এইকটি সুত্রে জানা যাচ্ছে যে সপ্তদশ শতকে বাংলার নৌবহরের ব্যাপ্তি ছিল ৪০০০-৫০০০ জাহাজ এবং সেগুলির প্রত্যেকটি ৪০০-৫০০ টনের চিনা আরবি জাঙ্কগুলির সমতুল ছিল।
শুধু নৌবহর নয়, বৈদেশিক বাজারে বাংলার পণ্যের বিপুল চাহিদার দরুণ, সওদাগরি জাহাজের বিপুল চাহিদা ছিল। পাইরাদ বলছেন বাংলার চাল ভারতের গোয়া, মালাবার, মোলাকাস এবং সুনাদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলার তৈরির বিভিন্ন ধরণের জাহাজ তৈরি হত। এইসব অঞ্চলে বাংলাকে পুষ্টিদাত্রী মা হিসেবে গণ্য করা হত। তিনি লিখছেন বাংলার জাহাজগুলি নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছত বা হয়ত পৌঁছতই না, হারিয়ে ডুবে যেত, সে সময় সেখানকার চালের দাম আকাশ ছুঁত এবং মন্বন্তরের পরিবেশ তৈরি এবং গণহারে কান্নাকাটির অবস্থা তৈরি হত। র্যা লফ ফিচও তার ২৫ বছর আগে হিজলি বন্দর বন্দরের বিদেশী জাহাজ ভিড়ে বিপুল ব্যবসার কথা বলছেন, To this haven of Angeli [Hijli] come every yere many ships out of India, Nagapatam, Sumatra, Malaca, and diverse other places; and lade from thence great store of rice, and much cloth of cotton wool, much sugar, and long pepper, great store of butter, and other victuals for India.।
সেই বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজ সারানোর কাজ নিশ্চই স্থানীয় নৌ উদ্যমীরাই করত। আশাকরা যায় একই ধরণের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল হুগলির সাতগাঁ, ঢাকার বাখরগঞ্জে।
(চলছে)
No comments:
Post a Comment