প্রকল্পের প্রস্তাবে জমিদারদের প্রতিক্রিয়া আমলাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হল। এক দেশি অধস্তন আমিনকে পঁচেটে পাঠানো হল লোহা মহাল নিয়ে সমীক্ষায়। সে দেখল জমিদারের বাড়িঘরদোর সব জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছে। কোম্পানির পরওয়ানা দেখানোয়, জমিদার লোহা ব্যবসায় জানাল সে কোম্পানি সরকারের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে তার জমিতে ঢুকতে দিতে অনিচ্ছুক। বর্ধমান কাউন্সিল কোম্পানির রেসিডেন্টকে তার ক্ষমতা চূড়ান্ত ব্যবহার করে প্রয়োজনে সেনা ব্যহার করে এই জমিকে হাতে নেওয়া সম্ভব কিনা দেখতে বলল। জমিদারের অসহযোগের কারণ পরিষ্কার, কেননা কোম্পানির প্রকল্প হলে ‘would be no farther a prejudice than by obliging those to discontinue the business, who have for many years past been concerned in it, and who have made the necessary advances for a continuation’। এটা শুধু ব্যবসা হারানো বা লাভ না করার প্রশ্ন নয়, তার থেকে অনেক বেশি। লোহা উৎপাদনে কোন এক বক্তির একচেটিয়া অধিকারের কথা জমিদারের ভাবনার বাইরে, এবং তিনি তখনও কোম্পানির রাজস্ব দাবিতে মাথা নত করেন নি।
স্থানীয় জমিদারের বিরোধিতা আঁচ পেয়ে ফারকুহর তার প্রকল্প বীরভূমের ডেউচ্যায় নিয়ে আসার প্রস্তাব দিলেন। তার হাতে পঁচেটের খনি ব্যবহারের কাগজ বর্তমান। তার ধারনা ছিল গত এক দশক ধরে বীরভূমের লোহা মহাল কোম্পানির রাজস্ব খাতায় উঠেছে, ফলে এই অঞ্চলটায় কাজ করা অনেক বেশি সুবিধের হবে হয়ত। তার ধারণা হল পঁচেটে চুয়াড় এবং অন্যান্য জঙ্গুলে সমাজের আক্রমণ হতে পারে, তার থেকে ডেউচ্যায় কোম্পানির সেনার নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি।
তিনি বীরভূমে পৌঁছলেন ১৭৭৮ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি। ‘his peculiarities, his parsimonious habits, his shrewdness, his eye ever watchful over his interests’ বিষয়ে তার শহুরে বন্ধুবান্ধবের গুণমুগ্ধতার থাকলেও, তাঁর চরিত্রের দাঢ্যের পরীক্ষা নিল বীরভূমের স্থানীয়রা। দীর্ঘকাল যুদ্ধে যাওয়ার থেকে, তার কাছে সুবিধের ছিল লোহা মহালের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার। তাঁর বন্ধু গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের থেকে তিনি বাংলার পথ কর আদায়ের অধিকার অর্জন করেছেন। ফলে তার কাছে বর্তমানের সমস্যা হল বিদ্রোহী জমিদার এবং লোহা ব্যপারীদের নিয়ন্ত্রণ।
পথকর নেওয়ায় ফারকুহরের অধিকারের আগে বীরভূমের রাজারা এই কর আদায় করতেন। তার ব্যাপক ক্ষতি হল। তাঁকে দুদিনের মধ্যে ফারকুহরের সঙ্গে দ্যাখা করতে নির্দেশ পৌঁছল। অসুস্থতার অজুহাতে ফারকুহরের চিঠির উত্তর দিলেন না রাজা। তার দপ্তর লোহা মহালের জমা ৭৬৬ থেকে বাড়িয়ে ৩২৬২ করল। ফারকুহর হঠাৎ বুঝলেন যে টাপ্পু লনি আর খাস লোহা উভয়েই রাজনারায়ণ ঘোষকে সাবকন্ট্রাক্ট দেওয়া আছে। ফারকুহর অবাক হয়ে দেখলেন লোহা জমির দাম চারগুণ বাড়লেও টুপ্পা (লেখকের ভাষায় Tuppa was a mid-level political – cultural unit in medieval Northern India, the largest being a pergunnah (a territorial whole governed by a Rajah, also variously called as raj, or ilaqa) and the smallest being a gaon (a territorial parcel, a village). The Company preferred pergunnah level Settlements. See Kashi N. Singh, ‘The Territorial Basis of Medieval Town and Village Settlement in Eastern Utter Pradesh, India’,)র বাৎসরিক শুল্ক কিন্তু যথেষ্ট কম।
কোম্পানি সরকারের আরও তদন্ত করে মহালের ওপর বীরভূমের রাজার বংশগত অধিকার নস্যাৎ করল এবং ফারকুহরকে যে অধিকার দিল, সেটা ইন্দ্রনারায়ণের পক্ষে তিন বছর আগেও ভাবনার অতীত ছিল। বর্ধমান কাউন্সিলের মনে হল লোহা উতপাদকেদের সঙ্গে অবশ্যই রাজার সাঁট রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে যেহেতু কোন লিখিত চুক্তি নেই, এবং বর্তমান কোন আইন তারা ভাঙ্গেনি, আইনগতভাবে কাউন্সিলের পক্ষে মৌখিক ও প্রথাগতভাবে চুক্তিবদ্ধ হওয়া দুইপক্ষকে শাস্তি দেওয়া মুশকিল। রাজার বাৎসরিক রাজস্ব আদায়ের খাতা থেকে লোহা মহাল কেটে নিয়ে অনেক কম শুল্ক, ৭৬৬ টাকায় ফারকুহরকে দিয়ে দেয়, ফারকুহরকে এই অর্থ সোজাসুজি কাউন্সিলকে জমা দিতে বলা হল। জমিদার হিসেবে তার স্বাভাবিক অধিকারও হারাল রাজা। এই পদক্ষেপ আজকের দিনেও যথেষ্ট অস্বাভাবিক গণ্য হবে। সরকার জমিদারের বিরুদ্ধে কোন দেওয়ানি বা ফৌজদারি অভিযোগ না এনেই তাকে তার জমি থেকে উচ্ছেদ করে দিল।
একইসঙ্গে ফারকুহর তার প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চরিত্রও অভূতপূর্ব নজির। শুধু শুল্ক আদায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে, ফারকুহর কোম্পানির কাছে ৫০ জন বন্দুকধারী দাবি করল যারা তার নির্দেশে কাজ করবে। তার বক্তব্য হল এই বন্দুকধারীদের চেহারা এমন হবে যাতে পাহাড়ী দুর্বৃত্তরা শঙ্কিত হয় (their appearance such as to keep the Hill people in awe)। তাদের একই পোষাক পরিয়ে, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারা যাতে টিপ করে গুলি করে মারতে পারে তার জন্যে এদের তৈরি করা দরকার। কাউন্সিল ফারকুহরের এই দাবিও মেনে নিল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment