মুঘলদের দরবারে খেলাত দেওয়ার প্রথার জন্যে
পরিধেয় সূক্ষ্ম এবং কারিগরিপূর্ণ পরিধেয় তৈরির ব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজন দ্যাখা দেয়।
অভিজাতদের খেলাত দিয়ে মুঘলেরা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বজায় রাখত। বাবরের সময়
প্রখ্যাত ধার্মিক, আত্মীয়, অনুগামী এবং প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারেন এমন মানুষকে
খেলাত এবং উপহার দিয়ে সম্মান জানানো হত। হুমায়ুনের সময়েও এই প্রথা চলতে থাকে।
হুমায়ুননামায় বলা হচ্ছে তিনি ১২০০০ জনকে খেলাত দেন, তাদের মধ্যে আছেন সুলতান
খ্বাজা গুলবদনের cicerone মানে পথপ্রদর্শক। এই জন্যই হুমায়ুনের সময়
নানান ধরণের পরিধেয় আঙ্গিক তৈরির উদ্যম নেওয়া হয় যেমন, উলবাগছা (Ulbagcha was a
waist-coat, which was opening in front, hanging
down to the waist over the coat or qaba)। তারার চলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হুমায়ুন তার
পরিধেয়র রং বাছার প্রথা শুরু করেন, যার সঙ্গে হিন্দুদের মরশুম অনুযায়ী রং বাছার একটা
সাদৃশ্য আছে। কিন্তু সে সময়ের খুব বেশি আঁকা ছবি পাওয়া যায় না, সেগুলির অধিকাংশ
নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলে কি কি ধরণের আঙ্গিকের পরিধেয় তিনি পরতেন বা কি কি রং পরতেন
তা আজ জানা যায় না, তবে আস্তে আসতে যে ভারতীয় প্রভাব পড়ছিল মুঘল পাদশাহদের ওপর এটা
পরিষ্কার।
আলোচ্য দুই পাদশাহের সময় দরবারি পরিধেয় ছিল
কাবা, জামা আর পিরহান – এগুলি তুর্ক মঙ্গোল শিকড় থেকে উৎপন্ন। পাল্টে যেতে থাকল
আকবরের সময় থেকে, পারসি কৃষ্টির সঙ্গে ভারতীয় কৃষ্টির মিলন ঘটল। আকবর তার
পারিবারিক পরিধেয় পরার প্রথা বদলালেন। তিনি মনে করতেন মোটা তুলোয়/চামড়ায় তৈরি পরিধেয়
ভারতীয় পরিবেশের পক্ষে অনুকূল নয়। অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে আকবরের পরিধেয়
পরিবর্তনের কারণ সমকালীন রাজনীতির মধ্যে নিহিত আছে। শাসনের স্বার্থে তার প্রয়োজন
ছিল হিন্দু আভিজাতদের সেবা। ফলে তিনি পরিধেয়র চরিত্র এবং নাম উভয়েই কিছুটা
পরিবর্তন করলেন।
আকবর মূলত তার পার্সি আঙ্গিকের পরিধেয়র সঙ্গে
কিছুটা রাজপুত আঙ্গিক মেলালেন। নামও পরিবর্তন করলেন ইরানি-তুর্ক-পারসি আভিজাতদের
সঙ্গে ভারতীয় পরিধেয় পরিচিত করাতে এবং ভারতীয়দের মুঘল রাজসভায় স্বচ্ছন্দ করাতে এবং
স্বাভিমান বোধ দিতে। আকবরের এই উদ্যমে মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে নতুন ধরণের পরিধেয়
কৃষ্টি বিকাশ লাভ করল। মহম্মদ হাসান আজাদ তার আবেহায়াতে বলছেন, দুই সম্প্রদায়ের
মধ্যে মেলবন্ধন এমনি হল যে ইরানিরা তাদের দাড়ি আর লম্বা জোব্বার মত আলখাল্লা,
পারসিক উষ্ণিষ ছেড়ে ভারতীয় পরিধেয় পরলেন আর ভারতীয়রা ইরানি আঙ্গিকের পরিধেয় পরতে
দ্বিধা করলেন না।
বিভিন্ন ধরণের দামি পরিধেয় তৈরি হতে শুরু করল তাদের
পদের সম্মানানুসারে। প্রত্যেক মরশুমে হাজারো শিরোপা(পা থেকে মাথা পর্যন্ত) পরিধান
রাষ্ট্র তৈরি করাত এবং বিভিন্ন স্তরের অভিজাতকে সেগুলি দেওয়া হল। আইনিআকবরি সূত্রে
জানতে পারছি হাজারো বিভিন্ন ধরণের দামি পরিধেয় তৈরি হত কারখানায়, আর সব সময়ে ১২০টা
তৈরি রাখা হত। যে সব কাপড় ব্যবহার হত এইসব পরিধেয় প্রস্তুত করতে সেগুলি হল রেশম,
ডুরিয়া(ডুরে কাপড়), জারবাফত(বিভিন্ন ধরণের কাপড় সোনার সুতোড় বোনা), কামখাব(সোনার
কাপড়), তিলাদোজ, কলাবত্তু এবং মসলিন ছিল। আইনিআকবরি সূত্রে জানাযাচ্ছে, মালবের
মসলিনের এক সময় খুব চাহিদা ছিল। নির্দেশ ছিল মসলিন একমাত্র দরবারি অভিজাতদের
পরিধেয় হবে। পাদশাহের পরিবারের সদস্য, অভিজাত এবং ভদ্রমিধ্যবিত্তদের পরিধেয়র মধ্যে
পার্থক্য হত উপাদান, আঙ্গিক, গুণাগুন, দামে।
বিভিন্ন সমাজের পরিধেয় আঙ্গিক মিশ্রনের বর্ণনা
দেওয়া যায় নানাভাবে। মুঘল সাম্রাজ্যে চাকরি করা ভারতীয় অভিজাতদের দায় ছিল শাসকেরা
যে ধরণের পরিধেয় পরতেন, সেই ধরণের পরিধেয় পরে দরবারে যোগ দেওয়া। এটা তাদের চাকরির অঙ্গ
ছিল। তারা যখন বাড়ি ফিরতেন, সেগুলি বাতিল করে, তাদের সমাজের নিজস্ব পরিধেয় পরতেন। আকবরের
সময় বিদ্রোহী আমলাদের ইরাণী পরিধেয় পরিয়ে শাস্তি মকুব করা হত। আকবর রাজা মানসিংহের
পুত্রের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে খেলাত পাঠিয়েছিলেন। আইনিআকবরি সূত্রে বিভিন্ন
ধরণের অনুষ্ঠানে দেয় খেলাতের উদাহরণ পাচ্ছি। আবুজফজলের আকবরনামায় পাচ্ছি, পারস্যের
সুলতান শাহ তাহামাসপ সাফাভির পাঠানো দূত সৈয়দ বেগ আগ্রায় আসলে তাকে ঘোড়া আর বিশেষ
খেলাত দিয়ে সম্মান জানানো হয়।
No comments:
Post a Comment