Wednesday, November 22, 2017

বীরভূমের লোহা শিল্প এবং চুয়াড় লড়াই৮ যোগেশ রাম মিশ্র

স্থানীয় নানান ধনী ব্যবসায়ীর দল জেলার লোহা উতপাদন এবং সরবরাহকে দখল করার চেষ্টা করছিল। যদিও এদের চিহ্নিত করা মুশকিল, কিন্তু যতদূর সম্ভব এরা ঔপনিবেশিকপূর্ব আন্তঃরাজ্য ব্যাপারে যুক্ত রাজার দপ্তর এবং বিভিন্ন বড় ব্যবসায়ী। ১৭৬৫র পরে কোম্পানির কর্মচারীরা আরেকটি স্বার্থগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই স্বার্থকেন্দ্রতে ছিল সাবকন্ট্রাক্টার, ইওরোপিয় ফাটকাবাজ এবং দালাল, এজেন্ট ইত্যাদি। কয়েকটি এলাকা চিহ্নিত করে এই স্বার্থগোষ্ঠী তাদের লোহা সরবরাহ নিশ্চিত করত। তবে স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত উৎপাদক এবং সওদাগরেদের এলাকা দখল বড় লড়াইএর অংশ ছিল।

বাজার দখলের লড়াই চলত রাজা আর কোম্পানির আমলাদের মধ্যে। যেহেতু ক্ষমতা থেকে বহুদূরে এই উৎপাদক অঞ্চল ফলে এই লড়ায়ের ফল সব সময় ঔপনিবেশিকদের পক্ষে যেত না।

টুপ্পা লুনি লোহা নিয়ে ১৭৭৮ সালে গণ্ডগোল লাগে। টুপ্পা উৎপাদন এবং ব্যবসার জগতে বড় ভূমিকা ছিল। সেই বছরের জানুয়ারি মাসে রাজার লুনির সাবকন্ট্রাক্টর রাজনারায়ণ ঘোষ দুজন অধমর্ণের বিরুদ্ধে বর্ধমানের কোম্পানির আদালতে মামলা করে। ব্যবসার ক্ষেত্রে রতন কুমার আর লোহারাম ঘোষের থেকে রাজনারায়ণ ৬৩৫ টাকা রা ৪৭ মন লোহা্র উত্তমর্ণ ছিল। অধমর্ণরা ডেউচায় বাস করত, এটা বীরভূমের লোহা মহলের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন এলাকা। কোম্পানি আদালত বীরভূমের নায়েবকে এই দুজন অধমর্নকে ধরে আনতে একজন পেয়াদা দিয়ে এত্তেলা পাঠাল। ফেব্রুয়ারিতে নায়েব চিঠি লিখে জানায় সে এত্তেলাটি ডেউচ্যার টুপ্পা পুলিশকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে লেখে যে একজনকে ধরা হয়েছে, কিন্তু জনগণ তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। এই হতভাগ্য পুলিশ আর আদালতের পিয়নকে পেটে এবং দুর্ব্যবহার করে।

এই উদাহরণ থেকে আমরা দেখতে পাই লোহা মহালের উৎপাদন আর ব্যবসা দখলে ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের অসহায়তার ছবি। কোম্পানির আদালতের তল্পিবাহক(পিয়ন) নাজিফ নায়েবের পরওয়ানা থানাদারের ভাই গোবিন্দরামের হাতে তুলে দেয়, এবং সে গোপনে এবং ভদ্রভাবে(gentle method) লোহারাম দাসকে গ্রেফতার করে। তল্পিবাহক তার পট্টি বেঁধে অধমর্ণকে ধরার আগেই দশ বারোজন এসে লোহারামকে মুক্ত করে। সে যখন আদালতের পরওয়ানা দেখায়, এরা তাকে হুঁশিয়ারি দিয়ে এদের থেকে দূরে থাকতে বলে (লোহারামকে নিয়ে) অদৃশ্য হয়ে যায়।

দলটির বেপরোয়া মনোভাবকে শুধুই অধমর্ণকে উদ্ধার করা হসেবে দেখলে ভুল হবে। আদতে এটা এই এলাকাটা নতুন যে আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থায় ঢুকতে চলেছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যখন গোবিন্দরাম কোম্পানির দেওয়ানের পাঠানো সনদ দেখিয়ে তার কাজের ঔচিত্য প্রমানে ব্যস্ত, তখন বিদ্রোহী দলটির নেতা পঞ্চানন হাজরা উঁচু গলায় বলে ওঠে, ‘আমি আমার (অশ্লীল শব্দ) দিয়ে তোমার সনদ ছিঁড়ে ফেলব’। কোম্পানির পাহারাদারাদারেরা কোম্পানি আর আদালত, আর আমলার নাম নিয়ে নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষা চাইলে, পঞ্চানন তাদের পেটায় এবং পরিধেয় ছিঁড়ে দেয়। এটাকে শুধু একজন উত্তমর্ণকে ছাড়ানোর ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে, এটা আদতে সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ, সেটা বর্ধমান কাউন্সিল বুঝেছিল। বীরভূমের কোম্পানির রেসিডেন্ট উইলিয়ান পায়ে পঞ্চানন কাণ্ড তদন্তে উত্তর দেয়, যে কোন আদালতের পক্ষে এই ঘটনা অপমানের সামিল এবং প্রত্যেক আদালতের এই ধরণের অধিকার অলঙ্ঘনীয়। পায়ের মতে এই ধরণের অবস্থা চলতে দেওয়া ‘highly prejudicial to the welfare of the Inhabitants & totally subversive of the Authority of your Board’।

পঞ্চানন তার কাজকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা করে। তার অভিযোগ ছিল বিরোধী পক্ষ কোম্পানি আদালতকে ভুল বুঝিয়েছে। আদালতের এই রায়ের ফলে উত্তমর্ণ লোহারাম দাসের থেকে তার বকেয়া উদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সে কিন্তু উপনিবেশের শত্রু ছিল না, বরং সে একজন ব্রিটিশ ফাটকাবাজ কলকাতার উইলিয়াম ব্রাইটহল সানারের স্থানীয় প্রতিনিধি। সে লোহারামকে ৫ বছরের লোহা সরবরাহ করার জন্যে দাদনও দিয়ে রেখেছে। সে স্থানীয় পর্তুগিজ কমিশনার জন রডরিগেজেরও প্রতিনিধি। জন ডেউচ্যায় সমান্তরাল রাজস্ব আদালত চালায়। মাসের পর মাস হাজার হাজার চিঠি দলিল দস্তাবেজ চালাচালির পর ঠিক হল জন তার কাজের জন্য আদালতের সামনে উপস্থিত হোক। অভিযোগ প্রত্যাভিযোগের মাঝখানে জানা গেল যে এর আগে কোম্পানি রডরিগেজকে আদালত চালানোর জন্য যে নির্দেশনামা দিয়েছিল সেটা তারা প্রত্যাহার করে নি। সে যখন হাতে থাকা কাগজপত্র আদালতকে দেখায়, তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির সব অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়।

বলা দরকার, বীরভূমের লোহা তৈরি আর ব্যবসার যে বিশাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায়, ঔপনিবেশিক আমলে সেটা দখলের দাবিদাওয়া প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হতে থাকে। কিন্তু লোহা মহালের অবস্থা এমনই উত্তুঙ্গ ছিল যে প্রত্যেকটি বিবাদের ঘটনা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করতে থাকে। ১৭৭০ সালেও কোম্পানি বাংলায় সরকারে চালালেও, এই ঘটনা তার পক্ষে যায় নি। সীমান্ত এলাকায় তার উপস্থিতি দৈবাধীন হয়েই থাকে। লোহা উৎপাদকেরা অন্যান্য মধ্যসত্ত্বভোগীদের বিরুদ্ধতার সামনে পড়ে, কেননা ব্যবসায় তাদের চরমতম ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে ছিল।
(চলবে)

No comments: