তখনও জমিদার আর তাদের চুঙ্গিকর আধিকারিকেরা চলতি সায়ের আদায় করছে। এর থেকে
প্রমান হয় সম্পদ দখলের জন্য যতটা তাড়াতাড়ি ব্রিটিশ বাংলার ব্যবসা দখল করার চেষ্টা
করেছিল, তত তাড়াতাড়ি সে কাজ সম্পন্ন হয় নি। পুরনো আর নতুন ক্ষমতার লড়ায়ের মধ্যে
পড়ে বাংলা জোড়া একটা ছত্রভঙ্গ অবস্থা তৈরি হচ্ছিল। ঔপনিবেশিকপূর্ব সময়ে বীরভূমের
রাজারা ২০ রকমের সায়ের আদায় করতেন। উৎপাদন, বাজারে শুল্ক আদায় ছাড়াও পেশাদার এবং
যন্ত্রপাতির ওপরেও কর চাপাতেন। এই আদায়ের বড় একটা অংশ তারা ফিরিয়ে দিতেন স্থানীয়
অর্থনীতিতে, যেমন খরচ করতেন বিভিন্ন উৎসব, পার্বনে এবং দানধ্যানে (এইভাবেই এই
অর্থগুলো ফিরে যেত স্থানীয় মানুষদের কাছে পরোক্ষে)। ১৭৮৬ সালে কোম্পানি বীরভূমের
রাজার সায়ের চালান্তা আদায় নিষিদ্ধ করায় রাজার ক্ষতি হয় ৮৩৪১ টাকা। ১৭৯১তে সব
ধরণের সায়ের বাতিল করে রাজার জমার ওপরে ২০ হাজার টাকা ছাড় দেওয়া হল। এর ফলে কিন্তু
শুল্ক তোলার কাজ রাজা বন্ধ করল না, সেটা ঘোমটার আড়ালে চলতেই থাকল, বরং রাজার কাঁধ
থেকে বাজার হাত দেখাশোনার ‘বোঝা’টা নেমে গেল। অরাজক অবস্থায় বাজার এবং রাস্তাঘাটের
চূড়ান্ত অব্যবস্থা দ্যাখা দিল।
বাংলায় কোমপানি যে ধরণের ক্ষমতার বিন্যাস চাইছিল, সেটা ১৭৭০পর্যন্ত তৈরি হয়
নি। একটা কথা বলার, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন বিদ্রোহী এলাকা থেকে চলে গেলে
ব্যাপারটি ব্রিটিশদের মাথা ব্যথা বাড়িয়ে আবার ১৭৬৫র পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসত।
ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অত্যধিক দূরত্বএ অবস্থান এবং সুবাগুলির জাঙ্গুলে আর্থ
রাজনৈতিক চরিত্রের ফলে কোম্পানি সরকারের পক্ষে চূড়ান্ত রাজস্ব আদায় করা অসম্ভব হয়ে
পড়ছিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এই সব এলাকায় কোম্পানির অবস্থিতির পক্ষে বিপজ্জনক
হয়ে দাঁড়াচ্ছিল যেমন, তেমনি বীরভূমের রাজার মত নানান ধরণের স্থানীয় ক্ষমতাধর
অভিজাতদের সার্বভৌমত্বকেও চ্যালেঞ্জ করার অবস্থান থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। কোম্পানির
বাংলা ভূখণ্ডগুলির মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের রাজনৈতিক গতিশীলতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল
কেননা এই অঞ্চলে লোহা উৎপাদন হত।
বীরভূমের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় আলোচনা
করা যাক। এই রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশের বেশি অঞ্চল ঘণ জঙ্গলে পরিপূর্ণ, ফলে সেগুলির
অধিকাংশ এলাকাতেই ইওরোপিয়দের পা-ই পড়ে নি(Ranjan Gupta, The Economic Life of a
Bengal District Birbhum 1770-1857)। তাদের কাছে এই
ভূখণ্ড অপরিচিত এবং জনগণের উপস্থিতি নগণ্যপ্রায়, জঙ্গলে একজনও ইওরোপিয় ঢুকেছে কিনা
সন্দেহ। বিদেশী কোম্পানি আমলারা মাঝেমধ্যে চক্ষু বিষ্ফোরিত করে দেখছে/শুনছে কিছু
কালো মানুষের দল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে অজয় দামোদর নদ পার হয়ে শহর নগরে আক্রমণ
সানিয়ে আবার জঙ্গলে মিলিয়ে যাচ্ছে। যে ভাষায় এরা কথা বলে সেটা বোঝা যায় না, তাদের
প্রথা আর আচার আচরণ কোনটাই ঔপনিবেশিক আমলারা চেনেনা। এরা ভূমির মালিক নয়। তাদের
বাসস্থান নেই। হিন্দু মসলমান সমাজের সঙ্গে এদের সামাজিকতার কোন মিল নেই। তাদের
রাজাও নেই, শাসকও নেই। তাদের সমাজে কোন জাত-ব্যবস্থা নেই, বা ব্রিটিশদের পরিচিত
এদেশি কোন আচার আচরণও তারা পালন করে না। ঔপনিবেশিক আমলারা এদের কি নাম দেবে তাই
নিয়ে চিন্তিত হয়ে এদের চুয়াড় বা কোল নাম দিল। উনবিংশ শতকের শেষে আর বিংশ শতকের
শুরুতে সেই সময়ের আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বে জারিত হয়ে ঔপনিবেশিক জাতিবাদী তত্ত্বে
এই মানুষেরা কোন অঞ্চলে সাঁওতাল, কোন অঞ্চলে মুণ্ডা, কোন অঞ্চলে ওঁরাও, আগারি(E. T. Dalton, ‘The ‘Kols’ of Chota-Nagpore’, Transactions of the Ethnological Society of London,; J. Crawfurd, ‘On the Supposed Aborigines of India as
Distinguished from its Civilized Inhabitants’,
Transactions of the Ethnological Society of
London,; H. H. Risley, ‘The Study of Ethnology in India’, Journal of the Anthropological Institute of Great Britain and Ireland) আদিবাদী(ট্রাইব)
হিসেবে চিহ্নিত হলেন। পরের দিকে ট্রাইব শব্দটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে(বিনয় ভূষণ চৌধুরী
বলছেন চুয়াড় শব্দের অর্থ wild, ferocious and
illmannered, দেখুন তাঁর The Myth of the Tribe’? The Question Reconsidered প্রবন্ধ)। ১৭৭০ সালে এলাকাটির বীরভূম নামে প্রমান
কোম্পানির কর্মচারীরা কতটা বিহ্বল ছিল(ব্লখম্যান Contributions to the Geography and History of Bengalতে বলছেন ভূম উপসর্গ দেওয়া হয়েছে কেননা এটির
সঙ্গে jungly and hilly
frontier districts বলে)।
No comments:
Post a Comment