পদ্মার তীরে
বসিয়া কুপ খনন করার বৃথা শ্রম করিয়া মরিতেছি
বাঙলার পল্লীবাসীদের মধ্যে কেহ কেহ নিরক্ষর থাকিলেও
তাহাদের শিক্ষার অভাব কেনও কালেই হয় নাই। আকবর লিখিতে পড়িতে জানিতেন না। ...অধ্যয়ণ ও অধ্যাপনার অর্থ – সমস্ত জ্ঞান
আয়ত্ত করিয়া চরিত্রের আঙ্গীভূত করা, জ্ঞান শুধু লিপি-পরিচয়-প্রচারের অপরিহার্য্য
অঙ্গীয় বলিয়া অনেক সময় বিবেচিত হইত না। আমাদের দেশের নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা মুখে মুখে এখনও বড় বড় গণিতের সমস্যা
পূরণ তাহারা করিতে পারে – তাহাদের
কতকগুলি এমনতর বাঁধা নিয়ম ছিল যাহাতে অতি সহজে তাহারা গণিতে এরূপ জ্ঞাণ অর্জ্জন
করিতে পারিত, যাহা অঙ্কশাস্ত্রে এম এ উপাধিধারীর পক্ষেও কষ্টসাধ্য। ১২৬৩ বাঃ
সনের (১৮৫৫ খৃঃ অব্দের) হাতে লেখা একখানি শুভঙ্করী আমার নিকট আছে, তাহাতে গণিতের
কতগুলি সূত্র ও দৃষ্টান্ত আছে। আমি (এর কিছু উদাহরণ পরে দেওয়া যাবে)। এই রূপ আর্যা
ও প্রশ্ন শত শত এখনও পাড়া গাঁয়ের অর্দ্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের জানা আছে – কিন্তু কিছুকাল পরে এই বিদ্যা যাহা প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার পক্ষে এখনও
অপরিহার্য্য, তাহা একেবারে নষ্ট হইবে।
আর একটা কথা, অঙ্কের অসংখ্যা পারিভাষিক শব্দ ছিল, তাহা বহু যুগ ধরিয়া
দেশময় প্রচলিত ছিল, সেগুলি উপেক্ষা করিয়া আমরা মনগড়া শব্দ নির্ম্মাণ করিতেছি – পদ্মার তীরে বসিয়া কুপ খনন করার বৃথা শ্রম করিয়া মরিতেছি। আমরা যাহাকে
পাটীগণিত বলি, হিন্দুস্থানীরা তাঁহাদের পরিভাষিক ঠিক রাখিয়া অঙ্কগণিত বলে। আমাদের মনগড়া
ক্ষেত্রতত্ব-শব্দ তাঁহাদের পারিভাষিকে রেখাগণিত। শুভঙ্করী অধ্যায়ে অনেক পারিভাষিক শব্দ আছে, তাহা কৃপা করিয়া গণিতের অধ্যাপকগণ চক্ষু খুলিয়া
একবার দেখিলে ভাল হয়। যথা – হার্য্য,
হারক, লব্ধ, হীন, হ্রস্বহরণ, দীর্ঘহরণ, পাতন ন্যাস, পর্যান্তঙ্ক। শুভঙ্করের
আর্য্যার প্রাচীন পাতড়া হইতে এই গদ্যাংশ উদ্ধৃত করিতেছিঃ- তাহার বিবরণ এই, যে
অঙ্ককে অঙ্কান্তর দ্বারা বিভাগ করা যায় তাহার মান হার্য্য, এবং যে অঙ্ক দ্বারা
তাহা হরণ করি তাহার নাম হারক, আর হরণ করিলে যে অঙ্ক পাওয়া যায় তাহার নাম লব্ধ। এবং হরণ করিলে
অবশিষ্ট যে থাকে তাহার নাম হৃতাবশেষ। এই পাতড়া-সাঙ্কেতিক অঙ্কসম্বন্ধে যে ব্যখ্যা আছে, তাহা আগে শিশুমাত্রই
জানিত। এখন
তাহার কতক জানা থাকিলেও অনেক শব্দ দুরুহ হইয়া উঠিয়াছে। পাতড়া হইতে
আর একটা অংশ উদ্ধৃত করিতেছিঃ- ১ – চন্দ্র, মহী,
শশী, গুরু, ২- পক্ষ, কর, পাখা, ভুজ, ৩- নেত্র, রাম, লোচন, অগ্নি, ৪- বেদ, যুগ, ৫-
বাণ, শর, ৬- মদ, ঋতু, ৭- সমুদ্র, অশ্ব, মুনি, ৮- বসু, গজ, ৯- গ্রহ, রন্ধ্র, ১০ –দিক, ১১ – রুদ্র। জমির মাপ – ৮যবে এক অঙ্গুলী, ৪ অঙ্গুলীতে এক মুট, ৩ মুটে এক বিগত্, ২ বিগতে এক হাত, ৫
হাত দীর্ঘ ৪ হাত প্রস্তে এক ছটাক, ১৬ ছটাকে এক কাঠা, ২০ কাঠায় ১ বিঘা, ১৬ বিঘায় এক
খাদা। সময়
নিরূপণ – ১৮ নিমিষে ১
কাষ্ঠা, ৩০ কাষ্ঠায় এক কলা, ৩০ কলায় এক অনুপল(ক্ষণ), ৬০ অনুপলে এক পল, ৬০ পলে এক
দণ্ড, সাড়ে সাত দণ্ডে এক প্রহর, ৮ প্রহরে এক দিবারাত্র, ৭ দিবসে এক সপ্তাহ, ১৫
দিবসে এক পক্ষ, দুই পক্ষে এক মাস, দুই মাসে এক ঋতু, ছয় ঋতুতে এক বত্সর, ১২ বত্সরে
একযুগ, ৭১ যুগে এক মন্বন্তর।
গণিতের অনেক সূত্র নিম্নশ্রেণীর লোকের মুখে মুখে
জানা ছিল। এ জন্য তাহাদের কাগজ কলম লইয়া ধ্বস্তাধ্বস্তি
করিয়া অঙ্ক কষিতে হইত না। তাহারা অতি জটিল হরণ-পূরণ, ও বাজার দরের
সূক্ষ্মতম হিসাব মুখে মুখে কষিতে পারিত। শ্রীমান সোমেশ বসু আমেরিকা, জার্ম্মানী প্রভৃতি
দেশে যাইয়া বড় বড় জটিল হরণ-পূরণ অতি অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশুদ্ধরূপে মুখে
মুখে বলিয়া সেথাকার মনীষী অধ্যাপকবৃন্দকে চমত্কৃত করিয়া দিয়া আসিয়াছেন। এই আশ্চর্য ক্ষমতা কী
যোগবলসম্ভূত! ভারতবর্ষে যেগবল অবিশ্বাস করা উচিত নহে। সেই বিশ্বাস আমাদের
অস্থি-মজ্জাগত, কিন্তু তাহাতে এত ভেল চলিয়াছে যে, তাহা অনেক সময় বৈজ্ঞানিক বিচারসহ
হয় না। হয়ত সে বিদ্যা জনসমাজে অনেক পরিমানে লুপ্ত হইয়াছে
এবং ভন্ডদের প্রতারণা এই বিদ্যার উপর একটা অশ্রদ্ধার ভাব আনিয়াছে। ...মুখে মুখে সাধারণ
লোকেরা এদেশে যেরূপ আশ্চর্য্য ভাবে গণিতের জটিল অঙ্ক কষিতে শিখিয়াছিল – তাহা এখন লুপ্ত হইতে বসিয়াছে। আমরা বার্ণাড স্মিথ
মুখস্থ করিতেছি, কিন্তু শুভঙ্কর, শিবরাম ও ভৃগুরামকে বিচারের সুবিধা না দিয়া বিদায়
করিয়া দিয়াছি। ... রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের সংখ্যায়
হিন্দুদের গণিত শিক্ষা-সম্বন্ধে যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল, তত্প্রতি সকলের
দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। পাদ্রী লঙ সাহেব শুভঙ্করকে দ্য ককার অব বেঙ্গল
উপাধি দিয়াছেন। এই নামে শুভঙ্করের কোন গৌরব বৃদ্ধি হয় নাই। গণিতের যে সকল
সূক্ষ্ম বিষয়ের সূত্র আবিষ্কার করিয়া শুভঙ্কর সমস্ত কূট প্রশ্নের সহজ
সমাধান করিয়াছেন, অন্যত্র তাহার দৃষ্টান্ত সুলভ নহে। লঙ সাহেব উনবিংশ
শতাব্দীর মধ্যভাগে লিখিয়াছিলেন, ১৪০ বত্সর যাবত্ শুভঙ্করের আর্য্যার আবৃত্তিতে
অনুমান ৪০,০০০ বঙ্গ বিদ্যালয় মুখরিত হইয়া আসিয়াছে। সুতরাং আমাদের ইংরেজী
শিশু-বিদ্যালয় সমূহে যে ভাবের শিক্ষা পরবর্ত্তী সময়ে প্রচলিত হইয়াছে তাহার পূর্ব্ব
গৌরব হিন্দুদেরই প্রাপ্য। হিন্দুরা মানসাঙ্ক বিদ্যায় ওস্তাদ ছিলেন। হিন্দুর এই
সুচিরাবলম্বিত পন্থা এখন মেন্টাল এরিথম্যাটিক আখ্যা পাইয়া শিক্ষিতদের মধ্যে
গৌরবান্বিত হইয়াছে। শুধু গণিতের নহে, জোতির্ব্বেদ্যার গুরুতর
প্রশ্নগুলি ডাক ও খনার প্রসাদে বাঙালী নিম্নশ্রেণীর লোকেরা এরূপ আশ্চর্য্যভাবে
সমাধান করিতে পারিত, যাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। কোন দিন চন্দ্র গ্রহণ হইবে, তাহা অতি সহজে নিম্নশ্রেণীর লোকে গণিয়া কহিতে পারে। - যে যে গৃহের রাশি
তার পশ্চিমে থাকে শশী, সেদিন হয় পৌর্ণমাসী, অবশ্য রাহু গ্রাসে শশী। দুই তিন পাঁচ ছয়
একাদশে দেখতে হয়। সহজে প্রশ্নটার উত্তর হইয়া গেল। আর কোন দেশের ইতর
জনসাধারণ এভাবে প্রশ্নটির সমাধান করিতে পারে তাহা আমি জানি না। আশ্চর্য্যের বিষয় যোগ
ও তন্ত্র সাধারণ লোকের মধ্যে এরূপ বহুল প্রচার লাভ করিয়াছিল যে, আমরা মনেই করিতে
পারি না, অশিক্ষিত অথবা অর্দ্ধশিক্ষিত লোকেরা কিরূপে এই দুরূহ সাধনার পথে অগ্রসর
হইতে সাহসী হইয়াছিল।
No comments:
Post a Comment