বাঙলার আর্থিক
অবস্থায় প্রফুল্লচন্দ্র রায়মশাই বলছেন, বাঁকুড়া জেলায় ...হিন্দু ও মুসলমান
রাজত্বে, নিয়মিত ভাবে পুষ্করণী ও খাল কাটা হইত, বড় বড় বাঁধ দিয়া গ্রীষ্ণকালের জন্য
ধরিয়া রাখা হইত। কিন্তু বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বাংলার স্বাস্থ্য ও আর্থিক
উন্নতির পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় এই প্রথা লোপ পাইতে লাগিল। পলাশীর
যুদ্ধের ৪০ বত্সর পরে কোলব্রুক লিখিয়াছিলেন – বাঁধ, পুকুর, জলপথ প্রভৃতির উন্নতি হওয়া দূরে থাকুক, ঐ গুলির অবনতি হইয়াছে। ১৭৭০ খৃ্ষ্টাব্দ
হইতে আরম্ভ করিয়া বাঁকুড়ার অবস্থার আলোচনা করিলেই বিষয়টি বুঝা যাইবে। ১৭৬৯-৭০ সালের
দুর্ভিক্ষে(ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক মরিয়া গিয়াছিল। বাঁকুড়া ও
তাহার সংলগ্ন বীরভূমের উপর ইহার আক্রমণ প্রবল ভাবেই হইয়াছিল। তত্পূর্বে
মারাঠা অভিযানের ফলে এই অঞ্চল বিধ্বস্ত হইয়াছিল। এই
দুর্ভিক্ষের শোচনীয় পরিণাম বর্ণনা করিবার ভাষা নাই। - বাংলার প্রাচীণ পরিবার সমূহ, যাহারা মোগল
আমলে অর্ধ্ব স্বাধীণ ছিল, এবং ব্রিটিশ গভর্মেন্ট যাহাদিগকে জমিদার বা জমির
মালিক বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন, তাহাদের অবস্থাই অধিকতর শোচনীয় হইল। ১৭৭০
খৃষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া বাংলার প্রাচীণ বনিয়াদী সম্প্রদায়ের প্রায় দুই
তৃতীয়াংশ ধ্বংস প্রাপ্ত হইল। কিন্তু তত্সত্বেও জমিদার
জোতদারদের নিকট হইতে পাই পয়সা পর্যন্ত হিসাব করিয়া নিঃশেষে খাজনা আদায় করা
হইল। লর্ড কর্ণওয়ালিস এইরূপ
ধ্বংসপ্রাপ্ত কয়েকটি স্থান পরিদর্শণ করিয়া ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে বলেন, - জমি চাষ করা হয়
নাই। বাঙলায় কোম্পানীর সম্পত্তির
একতৃতীয়াংশ শ্বাপদসংকুল অরণ্যে পরিণত হইয়াছে। ইতিহাসে লিখিত
আছে বীরভূমের রাজা সাবালক হওয়ার এক
বত্সরের মধ্যেই বাকী খাজনার দায়ে কারারুদ্ধ হন এবং বিষ্ণুপুরের সম্ভ্রান্ত রাজা,
বহু বত্সর কষ্টভোগ করিবার পর কারামুক্ত হন ও অল্প দিনের মধ্যেই মারা যান। ...১৮০৬ খৃষ্টাব্দে বর্দ্ধমানের মহারাজা ইহার
একটি বৃহত অংশ ক্রয় করেন। ১৮১৯ সালের ৮নং রেগুলোশন, বিশেষভাবে বর্দ্ধমানরাজের স্বার্থরক্ষার জন্যই
প্রবর্তিত হয় এবং এই রেগুলেশনের দ্বারা বর্দ্ধমানের মহারাজা চিরস্থায়ী খাজনা
বন্দোবস্তে ৩৪১টি পত্তনী তালুক ইজারা দেন।
পত্তনিদাররা আবার দরপত্তনিদারদের ইজারা
দেয়। এইরূপ যে প্রথা প্রবর্তিত হয়, তাহার ফলে বাঁকুড়ার অধিবাসীরা, এবং কিয়ত্
পরিমানে অন্যান্য জেলার লোকেরাও বহু দুঃখ ভোগ করিয়া আসিতেছে।
বিষ্ণুপুরের
রাজা বিষ্ণুপুরেই থাকিতেন এবং প্রজাদের শাসন করিতেন। তিনি হাজার
হাজার বাঁধ নির্মাণ করিয়াছিলেন। বর্ষাকালে এই সব বাঁধ জল ভর্তি হইয়া থাকিত এবং গ্রীষ্ণকালে জলাভাবের সময়
তাহা কাজে লাগিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিী সর্বাপেক্ষা বড়
প্রবাসী ভূস্বামী হইয়া উঠিলেন। জগতে এইরূপ অস্বাভাবিক দৃষ্টান্ত দেখা যায় নাই। ...যে জলসেচ
প্রণালী বহু যত্নে, কৌশলে ও দূরদর্শিতার সহিত প্রবর্তিত হইয়াছিল, তাহা উপেক্ষিত ও
পরিত্যক্ত হইল।
মিঃ গুরুসদয়
দত্ত বাঁকুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট ও
কালেক্টররূপে কতকগুলি সমবায় সমিতি গঠন করিয়া ঐ জেলার কতগুলি পুরাতন বাঁধ সংস্কার
করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন – পশ্চিম বঙ্গে
পুকুর, বাঁধ প্রভৃতি জলসেচ প্রণালীর ধ্বংসের সহিত তাহার পল্লিধংসের কাহিনী
ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পশ্চিম বঙ্গের যে কোনও জেলায় গেলে
দেখা যাইবে, অনাবৃষ্টির পরিণাম হইতে আত্মরক্ষার জন্য জল সঞ্চয় করিয়া রাখিবার
উদ্দেশ্যে, সেকালের জমিদারেরা অসাধারণ দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তার সহিত – অসংখ্য বাঁধ ও পুকুর কাটিয়া ছিলেন। এই বাঁধ ও
পুকুর নির্মাণের জন্যই বাঁকুড়াই বিখ্যাত ছিল, - একদিকে মল্লভূমির
জমিদারেরা, অন্যদিকে বিষ্ণুপুরের রাজারা এই কার্যে বিশেষরূপে উদ্যোগী ছিলেন। আবার ইঁহাদেরই
বংশধরদের অদূরদর্শিতা, সঙ্কীর্ণতা ও আত্মহত্যাকর নীতির ফলে এই সব অসংখ্যা বাঁধ ও
পুকুর – যাহার উপর
সমগ্র জেলার স্বাস্থ্য নির্ভর করিত – ক্রমে ক্রমে
ধ্বংস হইয়া গেল। ছোট ছোট খাল দ্বারা বড় বড় বাঁধগুলি পুষ্ট হইত এবং এই সব বড় বড় বাঁধ
হইতে চতুর্দিকের জমিতে জল সেচনকরা হইত। এই সব বাঁধে
কেবল জমিতেই জল সেচন করা হইত না, মানুষ ও পশুর পানীয় জলের জন্যও ইহা ব্যবহৃত হইত। পরবর্তী বংশ
ধরেরা তাহার স্বাস্থ্য ও ঐশ্বর্যের উত্স স্বরূপ এই সব বাঁধ ও পুকুরকে উপেক্ষা
করিতে লাগিল। তাহাদের অকর্মণ্যতা ও ঔদাসীন্যের ফলে বত্সরের পর বত্সর পলি পড়িয়া এই সব
জলাধার ভরাট হইতে লাগিল, অবশেষে ঐগুলি সম্পূর্ণ শুষ্ক ভূমি অথবা ছোট ছোট ডোবাতে
পরিণত হইল। চারিপাশে উচ্চ বাঁধগুলি পতিত হইয়া দাঁড়াইল। ...ইহীর ফলে বাঁকুড়া আজ মরা পুকুরের দেশ। বহু বাঁধ একেবারে লুপ্ত
হইয়া গিয়াছে, কতগুলির সামান্য চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট আছে। কোনটি কোনটি
পঙ্কিল জল পূর্ণ সামান্য ডোবাতে পরিণত হইয়াছে। এক বাঁকুড়া
জেলাতেই প্রায় ৩০।৪০ হাজার বাঁধ, পুকুর প্রভৃতি ছিল, উপেক্ষা, অকর্মণ্যতা ও
ঔদাসীন্যের ফলে ঐগুলি ধ্বংস হইয়া গিয়াছে, এবং
বাঁকুড়া জেলাতে আজ যে দারিদ্র, ব্যাধি, অজন্মা, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ প্রভৃতির
প্রাদুর্ভাব হইয়াছে, তাহা ঐ প্রাচীণ জল ব্যবস্থা নষ্ট হইয়া যাইবার প্রত্যক্ষ ফল।
এর পর
প্রফুল্লবাবু লিখছেন, ...আমাদের অর্থনৈতিক দুর্গতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে
জড়িত, শ্বেত জাতির দায়িত্ব আমদানী হইবার সঙ্গে সঙ্গে এই সুন্দর বাঁকুড়া জেলা
নিশ্চিতরূপে ধ্বংসের পথে গিয়াছে।
দ্য রিকন্সট্রাকশন অব দ্য এনসিয়েন্ট ইরিগেশন অব বেঙ্গল-এ
উইলিয়ম উইলকক্স বলছেন, (অনুবাদ প্রফুল্ল চন্দ্র রায়) বাংলাদেশ এতকাল ধরিয়া
সমগ্র ভারতের সাধারণ তহবিলে লক্ষ লক্ষ টাকা যোগাইয়াছে, কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ
– বাঙলার এই দুই অংশই এই দেড়শত বত্সর
ধরিয়া, গভর্মেন্টের রাজধানী থাকা সত্ত্বেও অধিকতর দারিদ্র্যপীড়িত ও অস্বাস্থ্যকর
হইয়া উঠিয়াছে। ভারতে
একটী প্রবাদ আছে – প্রদীপের
নীচেই অন্ধকার, এ ক্ষেত্রে তাহা বিশেষভাবেই খাটে। ...কোনও
নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক কি অস্বীকার করিতে পারেন যে, ১৪শ শতাব্দীর পাঠান শাসকেরা ইংরাজ
আমলের বণিকরাজগণের অপেক্ষা অধিকতর দূরদর্শী, উদারনীতিক, লোকহিতপ্রবণ এবং প্রজাদের
প্রতি শ্রদ্ধার পাত্রছিল! বণিক রাজগণ আত্মপ্রশংসাতেই তৃপ্ত, প্রজাদের উন্নতির কোনও
ব্যবস্থার প্রতি তাঁহারা উদাসীন, এমন কি তত্সম্বন্ধে অবজ্ঞার ভাবই পোষণ করিয়াছেন,
এবং তাঁহাদের চোখের সম্মুখে যে অপূর্ব সভ্যতা ও শিল্পৈশ্বর্য ক্রমে ক্রমে নষ্ট
হইয়া গিয়াছে, সে জন্য তাঁহারা বিন্দুমাত্র লজ্জা অনুভব করেন নাই। সেই প্রাচীন
সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন এখোনো বর্তমান রহিয়াছে। কিরূপে তাহা জলসেচের ব্যবস্থা করিয়া শুষ্ক মরুভূমিবত স্থান সমূহকেও
পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম উর্বর ঔ ঐশ্বর্য্যশালী প্রদেশে পরিণত করিয়াছিল , তাহার
প্রমাণ এখনও আছে।...
যাঁহারা নিরপেক্ষ ও ধীর ভাবে ভারতের বর্তমান জনহিতকর কার্যাবলী পরীক্ষা করিবেন,
তাঁহারাই স্বীকার করিতে বাধ্য হইবেন যে, ভারতের লক্ষ লক্ষ লোকের পক্ষে পাঠান
ফিরোজের ৩৯ বত্সর শাসনকাল, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক শতাব্দী ব্যাপী শাসনকাল
অপেক্ষা অধিকতর কল্যাণকরছিল। তিনি ১৮৮৪ সালের রোহতক ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার উল্লেখ করছেন, ... সুলতান
অত্যন্ত জলাভাব দেখিয়া মহানুভবতার সঙ্গে হিসার ফিরোজা এবং ফতেবাদ সহরে জল সরবরাহের
ব্যবস্থা করিবার সঙ্কল্প পরিলেন। তিনি যমুনা ও শতদ্রু এই দুই নদী হইতে জল প্রবাহ সহরে আনিলেন। যমুনাগত জল
প্রবাহের নাম রাজিওয়া অন্যটির আলগখানি। এই জন প্রবাহই কর্ণালের নিকট দিয়া আসিয়াছিল এবং ৮০ ক্রোশ চলাবার পর একখানি
খাল দিয়া হিসার সহরে জল যোগাইয়াছিল। ... ইহার পূর্বের চৈত্রের ফসল নষ্ট হইত, কেন না জল ব্যতীত গম জন্মিতে পারে
না। খাল
কাটিবার পর ফসল ভাল হইতে লাগিল। ...আরও বহু ক্রোশ ব্যাপী স্থান কর্ষণযোগ্য হইয়া উঠিল। রোটক খালের উত্পত্তি
এইরূপে হইয়াছিল। ১৬৪৩
খৃষ্টাব্দে হিসার ফিরোজা(ফিরোজাবাদ) হইতে দিল্লী সহর পর্যন্ত জলসেচের জন্য একটি
খাল খনন করা হয়।
আলিমর্দন খাঁ আড়াই শত বত্সর পূর্বে তৈরী এই খালের সাহায্য যতদূর সম্ভব লইয়াছিলেন
এবম তাহা হইতে নতুন খাল কাটিয়াছিলেন।
জলসেচেই এই
অবস্থা! কিন্তু এই অভিশপ্ত জেলার(বাঁকুড়ার) দুঃখ দুর্দশা, আরও নানা কারণে এখন চরম
সীমায় পৌঁছিয়াছে। রেশমের
গুটী হইতে সূতাকাটা এবং বস্ত্র বয়ন এই জেলার একটি প্রধান শিল্প ছিল। সহস্র সহস্র
লোক এই বৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিত। পিতল ও কাঁসার শিল্পের দ্বারাও বহু সহস্র লোকের(কাঁসারীদের) অন্ন সংস্থান
হউত। কিন্তু
এই দুই শিল্পই একন ধ্বংসোন্মুখ।
রেশম বস্ত্র
শিল্পই বোধহয় বাঁকুড়ার সর্বাপেক্ষা প্রধান শিল্প। শত শত পরিবার ইহার উপর নির্ভর করিয়া থাকে। বিষ্ণুপুর,
সোনামুখী এবং বীরসিংহের তাঁতিরা, লাল, হলদে, নীলস বেগনি, সবুজ রঙের রেশমের শাড়ী
এবং বিবাহের জন্য রেশমের জোড় রপ্তানী করিয়া থাকে। এদেশে
মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা বিবাহ উপলক্ষে এই সব রেশমেপ শাড়ী ও জোড় বহুল
পরিমানে ব্যবহার করিয়া থাকে। পাঁচ ছয় বত্সর পূর্বেও প্রত্যেক তাঁতি পরিবার তাঁত পিছু দানিক দুই টাকা
হইতে তিন টাকা পর্যন্ত রোজগার করিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রদর্শনী হিবার কয়েক মাস পর হইতেই বিষ্ণুপুরের রেশম
কাপড়ের মূল্য হ্রাস হইতে থাকে। রেশমের সূতা, জরী প্রভৃতি কাঁচা মূল্য পূর্ববতই থাকে। রেশমের
কাপড়ের মূল্য কমিতে কমিতে এতদীর নামিয়া
আসিয়াছে যে, তাঁতিরা এনেকস্থলে বাধ্য হইয়া কাপড় বোনা ছাড়িয়া দিয়াছে।
দেশের প্রধান
ব্যক্তিগণ বা গভর্মেন্ট এ পর্যন্ত এই দুবস্থার কারণ নির্ণয় করিতে চেষ্টা করে নাই। বিষ্ণুপুর
শিল্প প্রধান শহর। এ
স্থানের অধিকাংশ লোক তন্তুবায়, কর্মকার বা শাঁখারী। এই তাঁতিদের
এবং কামারদের অত্যন্ত দুর্দশা হইয়াছে। পিতল শিল্পের বাজার অত্যন্ত মন্দা। বিদেশ হইতে আ্যালুমিলিয়ম ও এনামেলের বাসন আমদানীর ফলে এই শিল্পের অবনতি
হইয়াছে, এই শিল্পের পুণরুদ্ধারের আশা নাই।
No comments:
Post a Comment