স্ত্রীশিক্ষা
বহু রূপকথা ও
গীতিকথায় দৃষ্ট হয় স্ত্রীলোক ও পুরুষ এক গুরুর নিকট এক পাঠশালায় বসিয়া পড়িতেন। সখীসেনার
গল্পে রাজকন্যা ও কোটালের পুত্র একত্র এক পাঠশালায় পড়িতেন – সেই সূত্রে একটা প্রতিশ্রুতির ফলে উভয়ে পলায়ন করিয়া স্বামী-স্ত্রীর মত
জীবন যাপন করিয়াছিলেন।
...এতগুলি রূপকথায় আমরা রমণী ও পুরুষের একত্র পড়াশোনার কথা পইতেছি, যাহাতে মনে
হয়, ইহা দেশব্যাপী একটা প্রাচীণ রীতির প্রতি অঙ্গুলিসঙ্কেত করিতেছে। কিন্তু
পাঠশালায় একত্র পড়াশোনা না করিলেও স্ত্রীলোকের পড়াশোনা যে এদেশে মুসলমান সময়েও
প্রচলিত ছিল, তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। আমরা গার্গী,
মৈত্রেয়ী, খনা অরুন্ধতী প্রভৃতি বিশ্বশ্রুতা ইতিহাস-পূর্ব্ব যুগের পণ্ডিতাদিগকে
লইয়া টানাটানি করিব না।
কালিদাস তাঁহার স্ত্রী ভোজরাজের কন্যার নিকট স্বীয় মুর্খতার জন্য বিড়ম্বিত
হইয়াছিলেন, কিংবা বিদ্যার ন্যায় রাজকুমারীরা পণ করিয়া বসিতেন যে, যে তাঁহাদিগকে
বিচারে পরাস্ত করিতে পারিবে, তাঁহাকেই বিবাহ করিবেন – এই সকল গল্পকেও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান দিব না। কিন্তু মধ্য
যুগে আমরা চণ্ডীদাসের প্রণয়িনী রামী, শিখা মাইতীর ভগিনী মাধবী এবং চন্দ্রাবতী
প্রভৃতি কবিদিগের লেখার সহিত পরিচিত হইয়াছি। চণ্ডাকাব্যে দেখা যাইতেছে যে বণিকের বধুরাও লিখিতে পড়িতে জানিতেন,
পল্লীগীতিকার জেলে-কৈবর্ত কন্যা মলুয়া ও খুল্লনা পত্রাদি লিখিতে পারিতেন – এরূপ উল্লিখিত আছে। ইহার সকলগুলিই গল্প কি না, কিংবা ইহাদের কোন কোন কাহিনী সত্যমূলক তাহা
নির্নয় করিবার অবসর আমাদের নাই। যাহারা শিল্পবিদ্যায় – সঙ্গীতে এবং
অপরাপর কলাবিদ্যায় এতটা পারদর্শী ছিলেন, তাঁহারা লেখাপড়া জানিতেন না এমন মনে হয়
না। আমরা
গত একশত-দেড়শত বত্সর পূর্ব্বের অনেক শিক্ষিতা মহিলার কথা জানি – তাঁহারা শুধু লেখাপড়া জানিতেন না – কিন্তু
অসাধারণ পণ্ডিত বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন।
ফরিদপুর
যপসা-গ্রাম নিবাসী লালা রামগতি সেনের কন্যা বিদুষী আনন্দময়ী দেবীর নাম সুপরিচিত। ইনি পলাশী
যুদ্ধের সময় জীবিত ছিলেন। ইনি
অথর্ব্ব বেদ হইতে যজ্ঞকুণ্ডের আকৃতি আঁকিয়া রাজা রাজবল্লভকে তাঁহার যজ্ঞের জন্য
দিয়াছিলেন। বেদ
নির্দ্দিষ্ট সেই যজ্ঞ কুণ্ডের খসড়া পণ্ডিতমণ্ডলীকর্ত্তৃক গৃহীত হইয়াছিল। তাহার
খুল্লতাত জয়নারায়ণ সেন যে হরিলীলা নামক কাব্য রচনা করেন, তাহাতে ইঁহার অনেক পদ
আছে, তাহাতে সংস্কৃতে তাঁহার অসামান্য অধিকার প্রমাণ করে। যোড়শ
শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি চন্দ্রাবতীর নাম এখন সুপরিচিত। ইনি সংস্কৃতে
ব্যুতপন্না ছিলেন, এবং মলুয়া, কেনারাম প্রভৃতি অনেক অপূর্ব্ব গীতিকা রচনা
করিয়াছিলেন, এবং পিতার আদেশে রমায়নের পদ্যানুবাদও করিয়াছিলেন। ...বঙ্গদেশের
পল্লীসাহিত্য খুঁজিলে আমরা বহু রমনী-কবির রচনা পাইতে পারি। কিন্তু
সংস্কৃতে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ১০০ বছরের পূর্ব্বেও কোন কোন বঙ্গ মহিলার আয়ত্ত ছিল,
তাহারও কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। শুধু চন্দ্রাবতী এবং আনন্দময়ী নহেন, বঙ্গদেশে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেও এমন
সকল পণ্ডিত রমণী ছিলেন, যাঁহারা বিদ্বত্সমাজে বিশিষ্ট স্থান পাইবার যোগ্য। ১৮৫১ খৃঃ অব্দের
১৯এপ্রিল তারিখের সম্বাদ-ভাস্কর নামক পত্রিকায় দ্রবময়ী দেবীর সবিস্তার উল্লেখ আছে। ইহার কাহিনী
আমার ছাত্র শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সম্বাদ-ভাস্করের প্রাচীন স্তুপ হইতে
আবিস্কার করেন এবং তাহার সহায়তায় শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এ
সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ প্রবাসীতে(১৩৩৮, ফাল্গুন) প্রকাশিত করিয়াছেন। দ্রবময়ী দেবী
১৮৫১ খৃষ্টাব্দে মাত্র চতুর্দ্দশ বত্সর বয়স্কা ছিলেন।
সম্বাদ-ভাস্করে তাঁহার সেই সময়ের কথাই লিখিত হইয়াছিল। এই অদ্ভুত
প্রতিভাশালিনী বালিকা কৈবর্ত্তের ব্রাহ্মণ চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের কন্যা। ইনি ১৮৩৭
খৃষ্টাব্দে খানাকুল কৃষ্ণনগরের সন্নিহিত বেড়াবেড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর আমরা
সম্বাদ-ভাস্কর হইতে উদ্ধৃতি করিতেছিঃ- দ্রবময়ী বালিকাকালে বিধবা হইয়া পিতা
চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের টোলে পড়িতে আরম্ভ করিলেন, তাহাতে সংক্ষিপ্তসার ব্যকরণ ও
মূল সাতখানি টীকা এবং অভিধান-পাঠ সমাপ্ত হইলে চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কার স্বকন্যার
ব্যুত্পত্তি দেখিয়া কাব্যলঙ্কার পড়াইলেন এবং ন্যায়শাস্ত্রেরও কিয়দংশ শিক্ষা
দিলেন, পরে দ্রবময়ী গৃহে আসিয়া পুরাণ মহাভারতাদি দেখিয়া হিন্দুজাতির প্রায়
সর্ব্বশাস্ত্রে সুশিক্ষিতা হইলেন, এইক্ষণ দ্রবময়ীর বয়ঃক্রম চৌদ্দবত্সর। পুরুষেরা
বিংশতি বত্সর শিক্ষা করিয়া যাহা শিক্ষা করিতে পারেন না, দ্রবময়ী চতুর্দ্দশ বত্সরের
মধ্যে ততোধিক শিক্ষা করিয়াছেন। এই ক্ষণে তাঁহার পিতা চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কার বৃদ্ধ হইয়াছেন, সকলদিন
ছাত্রগণকে পড়াইতে পারেন না, তাঁহার টোলে ১৫।১৬ জন ছাত্র আছেন, দ্রবময়ী
কিঞ্চিত শাস্ত্র পড়াইতেছেন, তাঁহার বিদ্যার বিবরণ শ্রবণ করিয়া নিকটস্থ অধ্যাপকেরা
অনেকে বিচার করিতে আসিয়াছিলেন, সকলে পরাজয় মানিয়া গিয়াছেন। দ্রবময়ী
কর্ণাটরাজের মহিষীর ন্যায় যবনিকান্তরিতা হিয়া বিচার করেন না। আপনি এক আসনে
বৈসেন, সম্মুখে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণকে বসিতে আসন দেন, তাঁহার মস্তক ও মুখ নিরাভরণ
থাকে, তিনি চর্ব্বাঙ্গী যুবতী হইয়াও পুরুষদিগের সাক্ষাতে বসিয়া বিচার করিতে শঙ্কা
করেন না, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা তাঁহার তুল্য সংস্কৃত ভাষা বলিতে পারেন না, গৌড়িয়
ভাষার বিচারেও পরাস্ত হন। দ্রবময়ীর ভাব দেখিতে বোধ হয় লক্ষ্মী কিংবা সরস্বতী হবেন, তাঁহাকে দর্শন
করিলে ভক্তি প্রকাশ পায়, এ স্ত্রীলোক দেখিবার জন্য কাহার উত্সাহ না হয়। বেড়াবাড়ী গ্রামে
যাইয়া দ্রবময়ীকে দেখুন, তাঁহার সহিত বিচার করুন, আমরা দ্রবময়ীর বিদ্যা-শিক্ষার
বিষয় যাহা লিখিলাম যদি ইহার একবর্ণও মিথ্যা হয়, তবে আমাদেগকে মিথ্যাজল্পক বলিবেন,
এরূপ সতী বিদ্যাবতী স্ত্রীলোক কেহ লীলাবতীর পরে এদেশে জন্মগ্রহণ করেন নাই।
No comments:
Post a Comment