জাহাজ নির্মাণ
কবিকঙ্কণ আর বংশীদাসে বিশদ বর্ণনা আছে। কোষা নামক
ডিঙির কথা পল্লী গাথায় পাওয়া যায়। ইশা খাঁর গীতিতে এই কোষার বর্ণনা আছে।
...জাহাজগুলিতে যেটিতে স্বয়ং সওদাগর থাকিতেন এবং যাহা সুসজ্জিত হইত তাহা মধুকর
নামে অভিহিত হইত। আমরা
কাব্যগুলিতে জাহাজের বহু নাম পাইয়াছি তাহার কোন কোনটি বেশ কবিত্বময়, যথা রাজবল্লভ,
রাজহংস, সমুদ্রফেনা, শঙ্খচূড়, উদয়তারা, গঙ্গাপ্রসাদ, দুর্গাবর। কোন কোন নাম
প্রাকৃত-যুগের, যথা – গুয়ারেখী,
চিয়াঠুটি, বিজু সুজু(বিজয় গুপ্ত)। ইহা পুরাকালে যে বৃহদাকৃতি হইত, তাহাতে সন্দেহ নাই। তখন রাজপুত্র
ও সওদাগরের পুত্রের মর্য্যাদা প্রায় তুল্য ছিল। চাঁদ সওদাগর
রাজদণ্ড কেন ব্যবহার করেন, লঙ্কার রাজা এই প্রশ্ন করিলে তিনি বলিয়াছিলেন, বাঙ্গালা
দেশে বণিকেরা রাজারমতই সম্মানিত। সপ্তগ্রাম বাঙ্গালার প্রাচীন বন্দর ছিল। এখানে জাহাজ
নির্ম্মিত হইত।
সমুদ্রযাত্রার প্রাক্কালে সরস্বতী নদী হইতে বণিকেরা মিঠা পানি তুলিয়া নিত। ঐ নদী শুকাইয়া
যাওয়ার পর সপ্তগ্রামের ঐশ্বর্য্য হরণ হয় এবং চট্টগ্রাম বঙ্গদেশে প্রধান
বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। চট্টগ্রামে নির্ম্মিত জাহাজে চড়িয়া বাঙ্গালীরা এককালে লঙ্কা, লাক্ষাদ্বীপ,
মাটাবাটান প্রভৃতি দেশে যাইতেন। নিলক্ষা শব্দ বোধহয় লক্ষাদ্বীপকে, প্রলম্ব প্রম্বনমকে ও আবর্ত্তনা
মাটাবানকে বুঝাইছে।
...চট্টগ্রাম ও তাম্রলিপ্ত বঙ্গদেশের এই দুই বন্দর বিশ্বশ্রুত। চট্টগ্রামের
কর্ণফুলীর তারবাসী বালামী নামক এক শ্রেণীর লোক জাহাজ নির্ম্মাণ করিত। এখনও
বালামীদের বংশধরেরা ছোট জাহাজ নির্ম্মাণ করিয়া থাকে। বালামী নোকো
ইহাদের নামানুসারে পরিচিত। চিন পরিব্রাজক মাহুন্দের লিখিত বিবরণ হইতে জানা যায় – একদা তুরস্কের সুলতান আলেকজান্ডিয়ার জাহাজ-নির্ম্মাণপদ্ধতিতে অসন্তুষ্ট
হইয়া চট্টগ্রাম হইতে অনেকগুলি জাহাজ নির্ম্মাণ করাইয়া লইয়াছিলেন। আরবী লেখক
ইদ্রিশ দ্বাদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সহিত বাণিজ্য-সম্বন্ধের উল্লেখ করিয়াছেন – তিনি সে দেশের নাম করিয়াছেন কর্ণবুল – এই শব্দ
কর্ণফুল শব্দের অপভ্রংশ। ১৪০৫
খৃঃ অব্দে চীন দেশের মন্ত্রী চেং হো বাণিজ্য-সম্বন্ধে কতগুলি প্রশ্নের সমাধানার্থ
স্বয়ং চট্টগ্রামে আসিয়াছিলেন, এবং ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে সুপ্রসিদ্ধ আরবীয় পর্য্যটক
ইবনবতুতা চট্টগ্রামের জাহাজ চড়িয়া জাবা ওবং চীনে গমন করিয়া ছিলেন। ১৫৫৩ খৃঃঅব্দে
পর্ত্তুগীজ নানু ডি চোনা(গোয়ার শাসনকর্ত্তা) তাঁহার সেনাপতি দি মান্নাকে
চট্টগ্রামে তাঁহাদের একটা বাণিজ্য-কেন্দ্রস্থাপনার্থ পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। ...চট্টগ্রামে অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক জাহাজের
মালিকদের নাম লোকে বলিয়া থাকে – তাঁহারা জগতের
সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালাইতেন। মুসলমান রজত্বের শেষভাগে তাঁহারা জীবিত ছিলেন – রঙ্গ, বসির, মালুম, মদন কেরানি, দাতারাম চৈধুরী প্রভৃতি জাহাজধক্ষ্যদের
কেন কেন জনের শতাধিক জাহাজ ছিল। ইঁহারা হার্ম্মাদদিগের অত্যাচারের সময় বৃহত্ নৌসঙ্ঘ লইয়া অগ্রসর হইতেন। এই শ্রেণীবদ্ধ
জাহাজগুলিকে শ্লুপবহর বলা হইত। যিনি হার্মাদদিগকে দমন করিয়া খ্যাতি লাভ করিয়ীছেন, তাঁহাকে বহরদার বলা হইত। উনবিংশ
শতাব্দীর আদিকালেও নাবিকগণের কেহ কেহ জীবিত ছিলেন, পিরু সদাগর, নসুমালুম, রামমোহন
দারোগা প্রভৃতির নাম এখোনও শোনা যায়। রামমোহন দারোগার জাহাজ বাণিজ্যদ্রব্য লইয়া স্কটলন্ডএর টুইড বন্দরে গিয়াছিল। চট্টগ্রাম-নির্ম্মিত
কতকগুলি জাহাজের বিবরণ সংক্ষেপে আমরা একানে দিবঃ-
১। বালাম নৌকা – ইহা পূর্ব্বে যত বড় হইত, এখন আর তত বড় হয় না। সাধারণতঃ
ইহারা ১৬ দাঁড়ে পাল উড়াইয়া চলে। ইহাদের মধ্যে বড় গুলি ২০০ এমন কি ২৫০ টন ধান্য বোঝাই লইয়া যাইতে পারে। কিন্তু ৫০
টনের অধিক মাল লইয়া ইহাদিগকে সমুদ্র-পথে যাইতে দেওয়া হয় না। এই
ক্ষিপ্রগামী বালাম নৌকা যন্ত্রাদির সাহায্য বিনাও অনায়াসে ভারত-সমুদ্রের উত্তাল
তরঙ্গ কাটিয়া চলিয়া যায়। এক সময়
ইহারা অতি প্রকাণ্ড হইত।
২। গোধা নৌকা – ইহাও অতি প্রাচীন। এই নৌকাগুলি সচরাচর অতি দীর্ঘ হয়। ইহারা সাধারণতঃ শুঁটকি মাছের কারবারের জন্য ব্যবহৃত হয়। বর্ত্তমান কালে
ইহারা সমুদ্রপথে সোনাদিয়া, লালদিয়া, রাঙ্গাবালী প্রভৃতি বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জে
মত্স্যের কারবার উপলক্ষ্যে যাতায়াত করে। এই নৌকাগুলি লোহার পেরেক দিয়া আটকানো হয় না। গল্লক নামক
বেত দিয়া নৌকাগুলি বিভিন্ন অংশ জোড়া দেওয়া হয়, এবং সেই বেতের অবকাশে শ্যামাগুলি(ছিদ্র)
দড়ি, ধুনা প্রভৃতি দ্বারা এমন শক্ত করিয়া আটকান হয় যে, তাহাতে জলপ্রবেশের কোন
সম্ভাবনা থাকে না। গোধা
নৌকার ভিন্ন ভিন্ন অংশ খুলিয়া রাখা হয়। বর্ষাকালে সেগুলি জোড়া দিয়া নৌকা সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়,
ইহাদের গলুই হাঙ্গরমুখো করা হয়। যখন বর্ষাকালে সমুদ্রপথ পর্য্যটন করিয়া বিপুল মত্স্যের পশার লইয়া শত শত
গোধা নৌকা কর্ণফুলী নদীতে আসিয়া নোঙর করে, তখন সেই মত্স্যব্যবসায়ীদের আত্মীয়স্বজন
দামামা, দগড়, ঢোল পিটিয়া ও বাঁশী বাজাইয়া তাহাদিগকে যেরূপ অভিনন্দন করে তাহা একটা
দর্শনীয় ব্যাপার।
৩। শ্লুপ
নৌকাগুলি অনেকটা বালামের মতই, পর্ত্তুগীজ প্রভাবে কতকটা রূপান্তরিত হইয়া ঐ নাম
পরিগ্রহ করিয়াছে। একটি বড় গাছ কুঁদিয়া নির্ম্মিত হয়।
৪। সারেঙ্গা নৌকা
– কতকটা ডোঙ্গা বা সালটির মত। এগুলি সমুদ্রে
যাইতে সাহসী হয় না,
৫। সাম্পান – অনেকটা হাঁসেরমত আকৃতি, ইহা চীনা নৌকার ধরণে প্রস্তুত।
৬। কোন্দা – চট্টগ্রামে অরণ্যসমূহের
সর্ব্বাপেক্ষা বৃহত্ বৃক্ষ কুঁদিয়া এই শ্রেণীর নৌকা তৈরী হয়। ইহা বহু মাল
লইয়া যাতাযাত করে, মাঝিরা ইহা লগিদিয়া ঠেলিয়া চালাইয়া থাকে।
...অধুনা মাধব,
কালীকুমার ও দ্বারকানাথ জাহাজ নির্ম্মাণে খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। আমাদের
স্বদেশী নেতাদের ইঁহাদিগকে উত্সাহ দেওয়া উচিত, দুঃখের বিষয় ইঁহাদের নাম পর্য্যন্ত অনেকেই জানেন না।
পল্লী-গীতিকা-সাহিত্যে
নসর মালুম নামক গাথায়(পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকা, ৪র্থ খণ্ড, ১-৪৪ পৃঃ) জাহাজ ও
সমুদ্রযাত্রাসম্বন্ধে অনেক তত্ব লিপিবদ্ধ হইয়াছে। মালুমেরা
সমুদ্রপথের সমস্ত বিষয় অবগত হইতেন, তাঁহারা দীর্ঘ পর্যটনের প্রাক্কালে মানচিত্র
আঁকিয়া লইতেন এবং নক্ষত্র দেখিয়া দিক নির্ণয় করিতে পারিতেন। ...জাহাজের
অংশগুলির যে নাম চট্টগ্রামে প্রচলিত আছে, তাহার কয়েকটি এখানে দিতেছিঃ- বাক(রিব), কাহন(ফ্লোর),
ইরাক(কিল), সুকানকিলা(কীলসন), গুদস্তা(স্টার্ন পোস্ট), রাজ(স্টেম), মাস্তুল(মাস্ট),মাস্তুলের
চালুতা(রেক অব দ্য মাস্ট) ইসকা(ব্যাটেন)। নুরন্নেহা ও
কবর নামকগাথায়(ঐ, ৯৩-১৩০) নৌ-সৈন্য লইয়া জাহাজের বহর কি ভাবে যুদ্ধ করিতে যাইত
তাহার একটা উল্লেখযোগ্য বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে।
No comments:
Post a Comment