জাহানকোষা
মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ের কামান। জাহানকোষার
অর্থ জগজ্জয়ী। দৈর্ঘের ১২ হাত প্রস্থে সাড়ে তিন হাত। কলকাতা সেকালে একালে পুস্তকে গ্রন্থকার লিখছেন, এই তোপে সাতখানি পিত্তল ফলক মারাছিল। এই সমস্ত পিত্তলফলকে, সম্রাট শাহজাহান ও তাঁহার সময়ের
বঙ্গের সুবেদার ইসলাম খাঁ এবং এই তোপেরও যশকীর্ত্তন লিখিত আছে। একখানি ফলক হইতে প্রমাণিত হয় এই জাহানকোষা তোপ
জাহাঙ্গীরনগরে(ঢাকায়) দারোগা সের মহম্মদের ও পরিদর্শক হরবল্লভ দাসের তত্বাহধানে,
প্রধান কর্ম্মকার জনার্দ্দন দ্বারা ১০৮৭ হিজরা(১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে) নির্ম্মিত হয়। ইহার
ওজন ২১২মণ ও অগ্নি সংযোগ করিতে ২৮ সের বারুদের প্রয়োজন হয়। ইহা
ভিন্ন বাদসাওয়ালী বলিয়া আর একটী সুবৃহত তোপও মুরশীদাবাদ কেল্লায় দেখা যায়। ইহার
মুখের ব্যাস প্রায় দুই হাত। এই দুইটী তোপ ও মুরশীদাবাদের শেলেখানায়
রক্ষিত সেকালের পুরাণো অস্ত্রশস্ত্রাদি হইতে প্রমাণিত হয়, বাঙ্গালী কারিকরের
দ্বারা এই বাঙ্গালা দেশেই এইরূপ প্রকাণ্ড তোপ ও অস্ত্রাদি নির্ম্মিত হইত।
লেখক লিখছেন, প্রসিদ্ধ পর্যটক বার্ণিয়ার সাহেব
সাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে এ দেশে উপস্থিত ছিলেন। তিনি
তাঁহার ভ্রমণ বৃত্তান্তের একস্থানে লিখিয়াছেন – মিশর দেশই চিরকাল অতি উর্বর ও শস্যশালিনী বলিয়া
প্রসিদ্ধ – কিন্তু আমি দুইবার বাঙ্গালায় গিয়া যাহা দেখিয়া আসিয়াছি, তাহাতে বঙ্গদেশই
উর্ব্বরতা সম্বন্ধে শ্রেষ্ঠ দেশ। এখানে তণ্ডুল এত উত্পন্ন হয়, যে
নিকটবর্তী প্রদেশের কথা ছাড়িয়া দিয়াও অনেক দূরবর্ত্তী স্থান সমূহের অধিবাসীগণ
বাঙ্গালার অন্নে প্রতিপালিত হয়। সমস্ত ভারতবর্ষের নানান স্থানে এমন
কি আরব, মিসোপটেমিয়া প্রভৃতি দেশেও
বাঙ্গালার শস্য প্রেরিত হয়। নানান বিধ সুমিষ্ট ফল ও মিষ্টান্নের
জন্য, বাঙালা দেশে চিরপ্রসিদ্ধ। এখানকার লোকে অন্নভোজী বলিয়া, গমের
চাষ খুব কম হয়। চাউল, ঘৃত ও নানান প্রকার তরকারী এখানে অতি অল্পমূল্যে
বিক্রীত হইয়াথাকে। টাকায় কুড়িটার উপর উত্কৃষ্ট পক্ষী পাওয়া যায়। ছাগ ও
মেষ এদেশে প্রচুর। শূকর এতই প্রচূর যে পর্ত্তুগীজেরা এই মাংস খাইয়া
প্রাণধারম করে। এখানে নানা শ্রেণীর মত্স্য অপর্যাপ্ত পাওয়া যায়। এক
কথায় লোকের জীবনধারণোপযোগী দ্রব্যে বঙ্গদেশ পরিপূর্ণ। এই
জন্যই পর্ত্তুগীজেরা এদেশে স্থায়ীভাবে বাস করিতেছে।
...সায়েস্তা
খাঁর ধানের গোলা প্রবাদের কথা নহে।
ঢাকার এই গোলা নির্ম্মাণ করিয়া তাহার তোরণের শিরোদেশে লিখিয়া দেন – যে
শাসনকর্ত্তার শাসনকালে এই রূপ সুলভ মূল্যে চাউল পাওয়া না যাইবে –
তিনি যেন আমার গোলার দরজা না খুলেন।
নবাব শায়েস্তা খাঁর বহুপরে মুরশিদকুলী খাঁর আমলেও চাকায় পাঁচ ছয় মণ চাউল বিকাইত।
চাউল শস্তা থাকিলেই অন্যান্য দ্রব্য সুলভ হইবে। এই
জন্যই বিয়াজের গ্রন্থকার লিখিয়া গিয়াছেন – নবাবের আমলে মাসে এক টাকা আয় হইলে একজন লোক
দুবেলা উদরপূর্ণ করিয়া পোলাও-কালিয়া খাইতে পারিত।
দরিদ্র ফকিরগণ এই শস্তা গণ্ডার দিনে স্বচ্ছন্দে দিন কাটাইত।
No comments:
Post a Comment