চতুর্থটি বিজ্ঞানমনস্কতা
নিয়ে। পশ্চিমের মত ভারতবর্ষের জ্ঞানচর্চায় বিজ্ঞান আলাদা জ্ঞানচর্চা হিসেবে
আলাদাভাবে খুব একটা উল্লিখিত হয়নি, ব্রিটিশদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে আসার আগে
পর্যন্ত। যা কিছু বিজ্ঞান সবই পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার ধারা, এই প্রবণতটি ক্ষতিকারক।
একটা টাটকা উদাহরণ উৎস মানুষ সংকলন আয়ুর্বেদে বিজ্ঞান। নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে
প্রতিপাদ্য। অর্থাৎ বিজ্ঞান আন্দোলনের মানুষেরা জানেন বিজ্ঞান কি। তারা জানেন
আয়ুর্বেদ বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান বলে যে
জিনিসটা তাঁরা বোঝেন, আয়ুর্বেদে সেই বিজ্ঞানের রেনুগুলো আদতে আছে কিনা তাই বিচার
করছেন। তারা কিন্তু এ্যালপাথিতে বিজ্ঞান খুজতে গেলেন না, কেন না সেটি পশ্চিমি
বিজ্ঞানেরই প্রডাক্ট। বিজ্ঞান আন্দোলনের মানুষেরা আসামী ঠিক করলেন, আসামির দোষ ঠিক
করলেন, তারাই বিচার করলেন, তারাই রায় দিলেন। বইতে যারা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
আয়ুর্বেদ ভিষগের, তাচ্ছিল্যভরে অনেক কিছু বোঝার চেষ্টা করছেন। তাদের অবলম্বন, পশ্চিমি জ্ঞানচর্চার সুত্রগুলি। প্রশ্নের উত্তরে একজন ভিষগ
বলছেন আয়ুর্বেদে বায়ু, পিত্ত, কফের মানে সাধারণ জীবনে আমরা যে মানে বুঝি তাঁর থেকে
আলাদা। জ্ঞানচর্চায় ব্যবহৃত শব্দের
নিগুঢ় মানে থাকাই স্বাভাবিক। যিনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তিনি প্রায় প্রশ্নে তাঁকে
ভেঙিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বুঝতেই পারছেন না। শহরে ইংরেজি শিক্ষিতরা মানিনা যে ভারতে
আদৌ জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা ছিল। সেই ধারনা সযত্নে তৈরি করতেই মেকলে, ম্যাক্সমুলারদের
তাত্বিক অবস্থান অবলম্বন করে পাঠ্যক্রম তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরেও ভারতেতিহাস বন্দনার ঘোমটা পরিয়ে ঔপনিবেশিক তত্ব
আজও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। সকলেই
আমরা পশ্চিমী জ্ঞানচর্চার প্রভাবে, ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাস, তার যুক্তি, তার
বাক্যবন্ধ না জেনে, নিজেদের মত করেই আয়ুর্বেদে পশ্চিমি বিজ্ঞান খুঁজে বেড়াচ্ছি। বিজ্ঞানমনস্কতার
এই দার্শনিক স্থানটা লেখক কিছুটা এড়িয়েই গিয়েছেন।
কিন্তু শুধু পশ্চিমকে
দোষ দিয়েত লাভ নেই। উল্টোদিকে দেখছি কিভাবে গ্রামীণ জ্ঞানচর্চাকে তাচ্ছিল্য করেছে,
দেশের অন্যতম প্রধান চিকিৎসা ব্যাবস্থা আয়ুর্বেদ। বইটির ৪ নম্বর মলাটে কবিরাজ ব্রজেন্দ্রচন্দ্র নাগ সম্পাদিত চরক
সংহিতা থেকে একটি প্রবচন উল্লেখ করেছেন সঙ্কলনকারীরা – বৈদ্যকুল ভাস্কর
প্রাতঃস্মরনীয় মহামহোপাধ্যায় গননাথ সেন মহাশয় রসিকতার সুরে বলেছিলেন, বাবা! কলির
আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসক হলেন পাঁচজন – মালাকারশ্চর্মকারঃ নাপিতো রজকস্তথা/ বৃদ্ধারণ্ডা
বিশেষণ কলৌ পঞ্চ চিকিৎসকঃ। অর্থাৎ, ফুলমালি(আমাদের ধারনা মালাকার শুধু ফুলমালি নয়।
হস্ত শিল্পীদের যে সংগঠনে আমরা যুক্ত, তার সম্পাদক দক্ষিণ দিনাজপুরের শোলা শিল্পী
মধুমঙ্গল মালাকার। মালদা থেকে কোচবিহার, এই ছয়টি জেলায় তার হাড়ভাঙ্গা ডাক্তারদের
বিশাল বাহিনী আজও সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা ব্যাবস্থার পাশাপাশি গ্রামীণদের সেবা
করে চলেছে(১৪২০র জ্যৈষ্ঠের ৪ তারিখ পর্যন্ত)। আমরা যারা নিজেদের বিশ্বাসের জ্ঞানচর্চাটির প্রাধান্য দাবি করি,
তারা নিজেদের দেশগাঁ চিনিনা),কর্মকার, নাপিত, রজক এবং পাড়ার বৃদ্ধা রাঁড়ি – এরাই
চিকিৎসক। যারা কিছুটা শহরের ছোঁয়া বাঁচানো গ্রামে কয়েক দশক আগেও বাস করতেন, তাঁরা
জানেন গ্রামের এই পাঁচটি সমাজ কিছু না কিছু চিকিৎসা করাতে পারতেন, আজও করেন।
রজকদের মত ফোঁড়াকাটার কাজ অতি দক্ষ শল্য চিকিতসক পারেন না, লেখক তার বড় প্রমান। আজকে
তাদের হাতুড়ে বলে গালি দিয়ে অ্যালপ্যাথির বাজার বাড়ানোর কাজ করি। বিশাল গ্রামীণ
জ্ঞানভাণ্ডারকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে শেষ পর্যন্ত আয়ুর্বেদও নিজের গরবেই আত্মসমর্পণ
করল অ্যালোপাথির কাছে? আচার্যর লেখার সুত্র ধরে রবীনবাবু বিশদে আলোচনা করেছেন
বিজ্ঞানচর্চা আদতে সমাজ নিরপেক্ষ কি না। বইটির অন্যতম সেরা প্রবন্ধ –
প্রাফুলচন্দ্রের বিজ্ঞানবোধ।
No comments:
Post a Comment