কাপ্পাল সাত্তিরাম
মাদ্রাজএর গভর্নমেন্ট ওরিয়েন্টাল ম্যানুস্ক্রিপট
লাইব্রেরি, কাপ্পাল সাত্তিরাম পুঁথিটি টি পি পালানিয়াপ্পান পিল্লাইকে অনুবাদ,
সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়। পুস্তক প্রকাশ করে মুখবন্ধে সম্পাদক জানান, পুঁথিতে
অনেকগুলি ভুল ছিল। এই ভুলগুলি হয়েছে অনুবাদকের অপর্যাপ্ত জ্ঞান, আর বিষয়গুলি সম্বন্ধে না জানার জন্য। কাপ্পাল
সাত্তিরাম পুঁথিটি ৭১ পাতার। সাধারণ কাগজে লেখা। এতে ৪৬টি ভিরুত্তায়াপ্পু ধারার
শ্লোকসহ অমিত্রাক্ষর ছন্দে গদ্যাংশ রয়েছে। চার নম্বর শ্লোকের শেষ স্তবকে এই পুঁথির
অন্য একটি সংস্কৃতগন্ধী নাম পাওয়া গিয়েছে, নিগম চিগামনি।
পুঁথিটি অনেকগুলি ছোট ছোট বিভাগে
বিভক্ত, প্রত্যেকটি বিভাগ বিষয় গুরুত্বে যুক্তিপূর্ণভাবে শিরোনামযুক্ত। এই বইটিতে
লেখকের নাম নেই। শুধু লেখা রয়েছে সালাইকাটিরঙ্গন চোরপাদি এতানাইত্তামিল
সাইতিত্তান(salaikatirangan corpadi etanaittamil ceytittan) সালাইকাটিরঙ্গনএর মৌখিক নির্দেশে এই শ্লোকগুলি তামিল ভাষায় গ্রন্থিত হল।
পুঁথি শুরু দেবী সরস্বতীকে উদ্দেশ্য
করে স্তোতিরমএর মুখবন্ধে। তিন নম্বর শ্লোকে বিভিন্ন পরিমাপকগুলোর একক বর্ণনা করা
আছে। মুলাক্কোল, বা পরিমাপক দণ্ড হল এক কিউবিট(=এক হস্ত?)। এই পরিমাপগুলো যতদুর সম্ভব ভুলভাবে বর্ণনা করা রয়েছে। তামিল
অঙ্ক বিষয়ক পুঁথি, কনক্ককাটিকরমএর সঙ্গে মিলিয়ে এই পরিমাপগুলি পরে নতুন করে হিসেব
করা হয়েছে।
৮ অণু ১
কাতিরেলুতুগাল(সূর্যালোক)
৮
কাতিরেলুতুগাল ১
পাঞ্চিরুক্কাল(সুতা)
৮
পাঞ্চিরুক্কাল ১
মাইর মুনানি(চুলের আগা)
৮ মাইর
মুনানি ১
নুনমানাল(সূক্ষ্ম বালির বিন্দু)
৮
নুনমানাল ১ চিরুকাতিগু বা ইয়েলু(সর্ষে
দানা বা তিলের দানা)
৮ ইয়েলু ১
নেল্লু(ধান)
৮ নেল্লু ১
ভিরাল(আঙ্গুল)
৮ ভিরাল ১ চান(৯
ইঞ্চি)
৮ চান ১ মুলম(১
কিউবিট = ১৮ ইঞ্চি)
শেষের তিনটি একক ছাড়া অন্য এককগুলো নৌকো তৈরির কাজে লাগত না।
একটি নৌকোর
চরিত্র নির্ধারণ
পাঁচ নম্বর
শ্লোকে বলা হচ্ছে কি ভাবে সমুদ্রে যাওয়া জাহাজএর চরিত্র চিহ্নিত হবে। ‘একটি সমুদ্রগামী
জাহাজের গুনমান(ভঙ্গম) নির্ধারণ হবে, যতগুলি এড়া(কীল - keel) রয়েছে তাঁর মোট দৈর্ঘ জুড়ে দশটি ভাগে ভাগ করতে হবে। যদি কোনও ভাগশেষ না
থাকে, তবে সেই জাহাজটি সমুদ্রে যাওয়া জাহাজের মর্যাদা পাবে। জাহাজের সাতটি অংশ –
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম এবং দশমের সব কটি কান্নিদাই, কারুভিদাই,
এলাক্কিডাই এবং চুলিক্কাদাই(এগুলি সব কাঠের চরিত্র) দিয়ে তৈরি হয়। এই চার প্রকার
চরিত্রের কাঠদিয়ে তৈরি জাহাজের কিলগুলোর জোড় নরম হতে দেয় না, বরং এগুলকে আরও শক্ত
করে। করমন্ডল উপকূলের জাহাজ প্রযুক্তিবিদেরা বহু প্রাচীন কাল থেকেই নৌকো বা জাহাজ
তৈরিতে এই চার প্রকার চরিত্রের কাঠ ব্যাবহার করে আসছেন। পুঁথির রচনাকার নৌকোর
কারিগরদের নৌকো তৈরির সময় অনেকগুলো দিক বিচার করতে বলেছেন। যেমন, চতুর্থ, পঞ্চম
এবং অষ্টম বিভাগ তৈরির সময় অবশ্যই গিঁট বা নোড(কানু) দেওয়া কাঠ ব্যাবহার থেকে বিরত
থাকতে হবে। কোনও কাঠে গিঁট থাকলে, নৌকো তৈরির সময় হয় তা কেটে ফেলতে হবে, নয় সেই
কাঠকে বাদ দিতে হবে। যে কিলের ওপর গোটা নৌকো অথবা জাহাজটি তৈরি হচ্ছে, সেটিতেই যদি
গলদ থাকে তাহলে, জাহাজ তৈরিতেই সমঝোতা করতে হবে এবং হামেশাই দেখাযায়, এর ফলে নৌকো
বা জাহাজের গায়ে সূক্ষ্ম চিড় ধরতে পারে।
জাহাজ জলে
ভাসানর জন্য সঠিক দিন নির্বাচন করা
যে কোনও কাজের
শুভ দিন নির্ণয় করা, ভারতবর্ষের খুব পুরনো একটি প্রথা। শুধু এই একটি বিষয়েই একটি
অধ্যায় নির্বাচন করেছেন লেখক, যাতে প্রমান হয় বিশেষ দিনে জলযানটি সমুদ্রে ভাসানোর বিষয়টির
গুরুত্ব। এরই সঙ্গে জাহাজ যিনি তৈরি করছেন তাঁর ব্যাবহার, চরিত্রও কি হওয়া উচিত,
তাও পুঁথিতে বিশদে বর্ণনা হয়েছে। বলা হয়েছে জাহাজের চরিত্র আর গুনমান ঠিক করে তৈরি
হবে ভাঙ্গানাল (ভঙ্গম = জাহাজ, নাল = দিন), অর্থাৎ কোণ দিনে জাহাজটি কত ভালভাবে
তৈরি হল তাঁর জন্য, ঐ দিনটি বেছে টেস্ট রান করা হত।
ভাঙ্গানালের জন্য এই কয়েকটি বিষয় বাছা হত – জাহাজের কীলটি হস্ত
মাপনী(কিউবিট)তে করা হত, যা আদতে ২৫ আঙ্গুল।
কীলের মাপকে ২৪ দিয়ে গুণ করা হত। এই পরিমাপ থেকে ২৭ বিয়োগ করা হয় (২৭ হল
মোট চান্দ্র কন্সটেলেসন)। যদি ফল ১ হয় তবে ভাঙ্গানাল হবে অশ্বিনীতে, যদি ফল হয়ই ২
তবে ভাঙ্গানাল হবে ভারনীতে ইত্যাদি। জ্যোতিষ সিদ্ধান্তের মতে এই চান্দ্র
কন্সটেলেসন শুরু হয় অশ্বিনী নক্ষত্রকে দিয়ে, ২৭তমতি রেবতী। কিন্তু যদি ফল ২৭এর
বেশী হবে তাহলে কি ভাবে গনা হত জানা যায় না – হয়ত আবার অশ্বিনী নক্ষত্র দিয়ে গোনা
শুরু হত।
জাহাজের
মাস্তুল স্থাপন
১৩ নম্বর
শ্লোকে জাহাজের মাস্তুল(পায়-মরম) স্থাপন হবে রাশি অনুযায়ী, সুভ গ্রহ দেখে। তবে
কিভাবে তা নির্ধারণ করা হত তা বলা নেই।
দেবতা স্থাপন
১৫, ১৬, ১৭তম
শ্লোক তিনটিতে বিশদে বিগ্রহ(বাস্তু পুরুষন) স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। জাহাজএর
চরিত্র নির্বিশেষে দেবতা স্থাপন করতে হবে বলা হয়েছে। এবং নির্দিষ্ট স্থানে তাঁকে
স্থাপন করতে হবে। লেখক বলছেন এড়া যদি বাস্তু পুরুষনের মাথার নিচে স্থাপন করা হয়
তবেই সেই জলযানকে উত্তমম বলা হবে। বাস্তু পুরুষনের মাথার অবস্থান এবং দিক পরিবর্তন
না করার নির্দেশও দিচ্ছেন লেখক।
জ্যোতিষ
নির্দেশ
পুঁথিতে, জাহাজ
তৈরি সংক্রান্ত কোন কাজ কোন দিনে করতে হবে, তাঁর বিশদ বর্ণনা রয়েছে। ৯ নম্বর
শ্লোকে বলা হচ্ছে, মিথুন, কুম্ভ, মীন, ধনুষ এবং মকর, এই পাঁচটি রাশিতে জাহাজ
সংক্রান্ত যে কোনও কাজ আরম্ভ না হওয়া
প্রয়োজন। ১৪তম শ্লোকে বলা হয়েছে দূর দেশ থেকে দেশের দিকে আসার সময় নানান ধরণের
জ্যোতিষ চিহ্ন দেখেই রওনা হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে পুঁথিতে জ্যোতিষ গ্রহ চিন্তামনির
নির্দেশ পালন করতে বলা হয়েছে। ২১ থেকে ৪৬ শ্লোকে বিশদে সমুদ্র যাত্রায় নানান ধরণের
জ্যোতিষ চিহ্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সেল এবং
মাস্তুল - মাস্টের পরিমাপ
বিভিন্ন ধরণের
জলযানের জন্য নানান পরিমাপের হাল এবং মাস্তুলের আলোচনা করা হয়েছে। একটি উদাহরণ-
যদি কোনও জলযানের কীলের(এড়া) দৈর্ঘ ৪৫ হস্ত, এবং ১৫ হস্ত চওড়া হয়, তাহলে হাওয়া এবং
ঝড়ের আঘাত রুখতে আড়াই হস্ত লম্বা এবং ৩৭ হস্তের মাস্তুলের হাল(ওদুতাই) তৈরি
প্রয়োজন। হালের দীর্ঘ হবে ৩৭ হস্ত। এধরনের ১০ টি আলাদা আলাদা পরিমাপ দেওয়া হয়েছে।
এখানে দুটি সেল মাস্তুলের কথাও বলা হয়েছে, যাতে জলজান, সমুদ্র বাতাস অলম্বন
করে দ্রুত জল কেটে এগিয়ে যেতে পারে। আর দুটো সেল ব্যাবহার করা হত আরও বেশী মাল বহন
করার উদ্দেশ্যে।
নোঙরের মাপ
চার ধরণের
নোঙরের(নাঙ্গুরাম) কথা বলা হয়েছে এই পুঁথিতে। জাহাজের চরিত্র এবং ওজন অনুযায়ী
নোঙরের পরিমাপ করা হত। প্রথমে এড়ার মাপ নিয়ে সেতিকে ফুটে পরিণত করা হত। এক ফুট এড়া
মানে ২৬ রাত্তাল(পাউন্ড) হয়, তবে কীলের দৈর্ঘের সঙ্গে ২৬ গুণ করে নোঙরের মাপ তৈরি
হত। আরও অনেকগুলি মাপের কথা বলা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment