রসায়ানবিদ রবীন
মজুমদারবাবুর নানান সময়ের লেখনি সঙ্কলন করে, চর্চাপদ প্রকাশন, “আচার্য
প্রফুল্লচন্দ্র” প্রকাশ করেছেন। এটি দুটি কারনে এই ধরনের সময় লাঞ্ছিত বইগুলো থেকে
এক্কেবারে আলাদা। ১)
এই বই শুধু প্রফুল্লচন্দ্রের কৃতি নয়, তাঁর সময়ের মুল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রতিক
অতীতে বাঙলায় প্রফুল্লচন্দ্রচর্চার বিশদ ইতিহাসও নথিবদ্ধ করেছে। এর জন্য
বাংলার সবুজ পত্রিকাগুলো দায়ী। তারা রবীনবাবুকে দিয়ে কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে
লিখিয়ে নতুন দৃষ্টিতে আচার্য-মুল্যায়ন করাতে পেরেছেন, ২) ইতিহাস প্রমান, প্রখ্যাত
ব্যক্তিদের মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময়ের পরে এই কৃতি মুল্যায়নের বইগুলির আইডলস্তুতি,
ব্যাজস্তুতিতে পর্যবসিত হয়। সেই প্রবণতা
সমূলে নির্বাসন দিয়েছেন লেখক। বাঁহাতি ধনাগম বিষয়ে যিনি নিজের পূর্বজকেও রেয়াত
করেননি(এক শতাব্দী পূর্বে আমার প্রপিতামহ মাণিকলাল রায় কৃষ্ণনগরের
কালেক্টরেটের(রামমোহন রায়ের দেওয়ানি থেকে অবসর নেওয়ার কিছু পরে - লেখক)এবং পরে
যশোহরের কালেক্টরেটের দেওয়ান। এই পদে তিনি যে প্রভূত ধন সঞ্চয় করিয়াছিলেন, তাহাতে
সন্দেহ নাই।
আমার বাল্যকালে তাঁহার সঞ্চিত ধনের অদ্ভুত গল্প শুনিতাম।
তিনি মাঝে মাঝে মাটির হাঁড়ি ভরিয়া কোম্পানীর সিক্কা টাকা বাড়ীতে পাঠাইতেন। আমার পিতামহ আনন্দলাল রায় যশোরের সেরেস্তাদার
ছিলেন এবং প্রচুর ধন উপার্জন করিয়া পৈতৃক সম্পত্তি বৃদ্ধি করেন। ...১৮০০ খৃষ্টাব্দে তিনি যে ভূসম্পত্তি ক্রয় করেন, তাহা
তাঁহার ঐশ্বর্যের কিয়দংশ মাত্র।), যিনি চরকা দর্শনের সঙ্গে শিল্পবিপ্লবজাত শিল্প দর্শন মেলাতে চেয়েছিলেন, সেই মানুষটির জন্মসার্ধশতবছরে,
তাঁরই এক যোগ্য উত্তরসূরীর এক বই, তাকে নতুনভাবে দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশা কড়ায় গণ্ডায়
বাড়িয়ে দিয়েছে। বইটির
শুরুতে লেখকের কৈফিয়ত আর শেষে নির্ঘণ্ট ছাড়াও রয়েছে যে অধ্যায়গুলো- সার্ধশতবর্ষে
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রঃ তাঁর মতো
বিজ্ঞানীর দিন কি শেষ?, এক বিস্মৃত ও পরিত্যক্ত দিশারী, প্রফুল্লচন্দ্র ও পরিবেশ, সবুজ
ও স্থিতিশীল রসায়ন শিল্পের অগ্রদূত, প্রফুল্লচন্দ্র কি বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন?, প্রফুল্লচন্দ্রের
বিজ্ঞানবোধ, সুচিত হোক বিজ্ঞানচর্চার সংস্কৃতির পরিবর্তন, সার্ধশতবর্ষতো পালন হল,
এবার কি করব। লেখাগুলো
যেহেতু বছর দুয়েকের মধ্যে সবুজ পাত্রিকাগুলোর চাহিদায় তৈরি হয়েছিল, তাই দুএকটি
বিষয় অনেকবারই ঘুরেফিরে এসেছে। তবুও
এই বইতে পাঠক যা পেলেন তাও খুব একটা কম নয়। অঙ্গসজ্জায় চমক নেই, তবুও আকারে,
পরিপাট্যে, পরিবেশনে এবং শোভন বিষয়রুচিতে রবীনবাবুর “আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র” বাংলা
প্রকাশণ জগতে নতুন ধারাকে আরও একটু পুষ্ট করবে।
মারকিউরাস
নাইট্রাইটএর অস্ত্বিত্ব আছে কিনা সে বিষয়ে আমরা বিন্দুমাত্র রায় দেওয়ার অধিকারী
নই। ভারতীয় দর্শনে পাত্র, অপাত্রের স্পষ্ট ভেদ করা হয়েছে। সেই ভেদ আমরা মানি। রবীনবাবু
সেই আদ্যন্ত রাসায়নিক বিতর্কটি বিশদে এবং যথেষ্ট কুশলভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু বইতে
উল্লেখ না করা তিন-চারটি বিষয় আমাদের নাড়িয়েছে, সেই কটি আমরা একটু বিশদে আলোচনা
করব। প্রথমটি গান্ধিবাদী হওয়া
সত্তেও বড় শিল্পস্থাপনএর বিশদ পরিকল্পনা কেন করলেন। দ্বিতীয়ত বাংলা বা ভারতের অতীত নিয়ে তাঁর কিছু মন্তব্য
যার কিছু উদ্ধৃতি গ্রন্থকর্তা উল্লেখ করেছেন, তার দার্শনিক প্রতিপাদ্য খণ্ডন। সবার আগে তৃতীয় আর চতুর্থ
ফরিয়াদ। তৃতীয়টি একটু জোরালো,
সরাসরি। সেটি
কয়েকটি কথায় সাপ্টে নেওয়া যাক। শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর অন্যতম প্রিয় শব্দবন্ধ, “শ্রমবিমুখ
বাঙ্গালী” রবীনবাবুর লেখায় পেলাম(এক বিস্মৃত ও পরিত্যক্ত দিশারী, পৃষ্ঠা ৪৯)। এই শব্দবন্ধকে আচার্য তাঁর
সংস্কারকাজের দার্শনিক ভিত্তিভূমিরূপে ব্যবহার করেছেন। কিছুটা ধাক্কাতো লাগলই। রবীনবাবু একে মান্যতা দিয়েছেন বলেই। শুধু প্রফুল্লচন্দ্র
হলে সয়ে নিতাম। বড়জোর কৃতি মানুষটির
দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে দুটো স্তবক লিখে হাত মুছে বলতাম, বেশ। সম্প্রতি প্রয়াত এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক এই বিষয়টি ধরে বাংলার সর্বাধিক
প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় ঊষ্মা প্রকাশ করছিলেন। দেবী কালীকে, ন্যাংটো সাঁওতালী
রমণী লিখে প্রগতিশীলদের খুব হাততালিও কুড়িয়ে ছিলেন। এক সভা শেষে বাঙালির
শ্রমবিমুখতা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করায় তিনি আমাদের তাচ্ছিল্যস্বরে উত্তর দিয়েছিলেন,
আমি সব বাঙালীকেই মিন করেছি। উনিও কথা বাড়ানি, বিব্রত উদ্যোক্তারা আমাদের অন্য
প্রশ্নের সুযোগ দেননি। আমরা ব্যাপক হতাশ হয়েছিলাম। বাল্যকাল থেকে জেনে এসেছি তিনি মোটামুটি বামপন্থী ঘরানার লেখক। তাঁর মুখ থেকে এ ধরনের উক্তি শুনে আমাদের দলের অনেকেরই
শুধু মূর্ছা যেতে বাকি থেকেছিল।
আমরা রবীনবাবুর কাছে
নম্রভাবে আশাকরব, প্রখ্যাত সাহিত্যিকের মত নিশ্চয়ই তিনিও সমস্ত বাংলাভাষীকে এই
অশ্লীল দাগে দেগে দিতে চান নি। দীনেশচন্দ্র সেন গ্রাম্য মানুষদের ইতর বলে সম্বোধন
করেছেন। সঙ্গে মিলেছে তাঁর রায়বাহাদুর উপাধি। ফলে সোনায় সোহাগা। মোটামুটি উচ্চবর্ণের
চক্রান্ততত্ব খাড়া করে দেওয়া যায়। কিন্তু বৃহৎবঙ্গের নানান অধায়ে আমরা দেখেছি কি
শ্রদ্ধায় মানুষটি গ্রামীণদের কৃতি বিশদে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উল্লেখ করছেন। নানান
প্রচলিত মিথ-মিথ্যে স্পষ্টসব উদাহরণ দিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছেন। আমরা যারা তাঁর মত
দেশাভিমানী মানুষের দেখান পথ ধরে, পুরোনো বাংলার, গ্রামের মানুষের, শহরের তথাকথিত
অস্বচ্ছল মানুষদের দর্শন বোঝার, নথি করার কাজ করে চলেছি, তারা জানি মধ্যবিত্ত এবং
উচ্চবিত্ত মানুষেরা কি ভাষায় শ্রমজীবিদের সম্বোধন করেন। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মনে করে
তথাকথিত ভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে অস্বচ্ছল মানুষেরা “কামচোর”। কামচোর তাই বেশী
রোজগার করতে পারেন না। তাই গরীব। গরীব তাই কামচুরি করে পয়সা বাঁচাতে হয়। কামচুরি করেন
বলে বেশী কাজ পান না। তাই গরীব। বিষচক্রের অসম্ভবসব বিষতত্ব উঠেআসে মধ্যবিত্তের
সংলাপে।
সংগঠনে একজন বাদে সকলেই গ্রাম-শহরের সচ্ছল মধ্যবিত্ত
পরিবার থেকে এসেছি। আমাদের পূর্বজদের অনেকেই রাজনীতির আবহাওয়ায় জীবন ধারণ করতেন। তাঁদের পথ নিয়ে বিতর্ক আছে। তাঁরা এই প্রজন্মের অভিভাবকদের
থেকে একটু আলাদাই ছিলেন। কিন্তু
তাদের জাপন বিষয়ে আজও গর্ব করি। আমাদের
আশেপাশের চাকরিজীবি, স্বনিযুক্ত উচ্চ-মধ্যবিত্তরা যে ভাষায় শ্রমজীবিদের বিষয়ে কথা
বলেন সেটি সুখকর নয়। শহর বা গ্রামের ততটা আর্থিক চাহিদা, তথাকথিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা না
থাকা(যাদের অর্থনীতির ভাষায় গরীব, ভদ্র সমাজতত্বের ভাষায় নিম্নবিত্ত) মানুষরা
অসম্ভব খেটে, শ্রেণী বাছবিচার না করে সমাজকে ঠিকঠাক সেবা দেওয়ার, ঠিকঠাক জিনিস ঠিক
সময়ে উৎপাদন করার চেষ্টা করেন বলেই সমগ্র সভ্যতা আজও গড়গড়িয়ে চলতে পারছে। আমরা অনেকেই
গ্রামের সন্তান। দুর্ভাগ্য, শহরে বাস করি। বিগত ১৫ বছর কাজের, অকাজের, শখের সুবাদে,
গ্রামে, শহরের অগম্য স্থানগুলোতে বিচরন করতে হয়েছে।
আমরা অনেকেই নানা শ্রম সংগঠনেও যুক্ত থেকেছি।
কারু, বস্ত্রবয়ন আর আভিকর শিল্পীদের সঙ্গে মিলে এশিয়াজোড়া সংগঠন করেছি। আমরা কেউ
দেখিনি, বাংলা, ভারতের বা এশিয়ার কোনও চাষি, অথবা ভাগচাষী চাষের সময়, চাষ না করে
কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন; কোনও জুতো পালিশওালা কিছুটা জুতো পালিশ করে ক্লান্ত হয়ে বলছেন
এর বেশী আর করতে পারব না মশাই, পয়সাটা দিন, কেটে পড়ুন; কোনও রিকশা চালক সওয়ারিকে
অর্ধেক রাস্তা টেনে এনে বলছেন আর পারছিনা, এই ভাড়ায় এর বেশী যাওয়া যায় না, পয়সাটা
দিয়ে নেমে হেঁটে যান। না,
তাঁরা প্রথমে যতটুকু সেবা দেওয়ার অঙ্গিকার করেন, তার থেকে অনেক বেশিটুকু করেন।
আমাদের অভিজ্ঞতা উল্টো চাকরিজীবি মানুষদের নিয়ে। এ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, খুব
একটা বাগবৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। শহুরে মধ্যবিত্তকে মেকলের ঔপনিবেশিক তত্ত্বে কিভাবে
চাকুরিমুখী করে ঢেলে সাজানো হয়েছে, সে তত্ত্ব রবীনবাবুর জানতে বাকি নেই। সুযোগ
থাকলে বলা যেত। প্রফুল্লচন্দ্র আর রবীনবাবু উভয়েই শহুরে মধ্যবিত্ত, মেকলেপদ্ধতিতে
শিক্ষিত বাঙ্গালী যুবকদের উদ্যমহীনতার বিষয়টি উল্লেখ করছেন। আমাদের মনে হয়, এবার
থেকে বাঙালির শ্রমবিমুখতার আলোচনায়, কোন শ্রেণির বাঙ্গালীকে নিয়ে আলোচনাটি হচ্ছে
সেটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment