এই লেখাটি তৈরি করেছিলাম মার্চ মাসে, যখন আমরা দিনাজপুরের এক অজ পাড়াগাঁয়ের একটি হাট, চান্দল থেকে মেলা শেষ করে ফিরি।
আজ ঋতুর মৃত্যুর পরের দিনে কেন যেন মনে হল এই লেখাটা বড্ড প্রাসঙ্গিক। কিছুটা হলেও ইঙ্গিতে ঋতুর প্রতি হুল ফোটানো আছে।
পাঠকেরা নিশ্চয় বুঝবেন।
বিশ্বেন্দু
আজ ঋতুর মৃত্যুর পরের দিনে কেন যেন মনে হল এই লেখাটা বড্ড প্রাসঙ্গিক। কিছুটা হলেও ইঙ্গিতে ঋতুর প্রতি হুল ফোটানো আছে।
পাঠকেরা নিশ্চয় বুঝবেন।
বিশ্বেন্দু
সদাহাস্য দম্পতিকে চিনে নিন।
নীল জামা গলায় কণ্ঠী এই প্রায়-যুবকটি বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের অন্যতম সক্রিয় সদস্য শংকর সরকার। বয়স খুব বেশ হলে ১৭। সাকিন উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জের ফতেপুর গ্রাম। বছরখানেক হল শঙ্কর বিয়ে করেছে – গত বছর সংঘের ঠাকুরপুকুরের মেলায় অভিনয় করে যাওয়ার পরপরই।
নীল জামা গলায় কণ্ঠী এই প্রায়-যুবকটি বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের অন্যতম সক্রিয় সদস্য শংকর সরকার। বয়স খুব বেশ হলে ১৭। সাকিন উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জের ফতেপুর গ্রাম। বছরখানেক হল শঙ্কর বিয়ে করেছে – গত বছর সংঘের ঠাকুরপুকুরের মেলায় অভিনয় করে যাওয়ার পরপরই।
শঙ্কর অসামান্য অসামান্য অভিনেতা। দিনাজপুর জেলার নিজস্ব নাটক খন। খনে মহিলার ভূমিকায় অভিনয় করে সে। মঞ্চে বোঝার উপায় নেই তার পুরুষত্ব। অসামান্য তার বাচনিক দক্ষতা, অসামান্য তার সম্মোহনী যাদু, অসামান্য তার শারীরি আবেদন, অলৌকিক তার উপস্থাপন ক্ষমতা। অঞ্চলে তার অসামান্য জনপ্রিয়তা।
আমরা শহুরে কলকাত্তাইরা স্ত্রীবেশী অভিনেতা পুরুষ নিয়ে প্রচুর আদিখ্যেতা করেছি। রাতের পর রাত তিন দিক ঘেরা শহুরে মঞ্চে নাটক করেছি। সবুজ পত্রে গল্প লিখেছি। তার সামাজিক অবস্থাকে দুর্বিসহ ভেবে আহাউহু করেছি। ইন্তালেকচুয়াল সিনেমা বানিয়েছি। সিনেমা হিট করেছে। বহু অর্থ লাভ করেছি। দেশে-বিদেশে খ্যাতিও লাভ করেছি। সেইখ্যাতির পিছন পিছন এসেছে আরো অনেক উপাদান। হয়ে উঠেছি গুরুঠাকুর।
চলচ্চিত্র এক্কেবারেই পশ্চিমি শিল্প মাধ্যম। নির্দেশকের পশ্চিমি সভ্যতার শংসাপত্র লাভকরার মান্যতা অর্জন করা অন্যতম উদ্যেশ্য হয়ে পড়ে। পশ্চিমি দর্শণ,সামাজিক প্রথা, সংস্কৃতির প্রতি আদিখ্যেতা প্রদর্শণ করতে হয় অসীম দাম্ভিকতায়। এই দম্ভিকতার জন্মায় নিজের দেশ, নিজের সমাজকে না জানার শর্তে। কেননা শহুরেরা আজন্ম ভেবেছি, এ দেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম। গ্রামীণ সত্যি জানলেও দেশের সমাজকে ন্যুন দেখানোর শর্ত জুড়ে থাকে অদৃশ্যভাবে। ফলে বাস্তবতা প্রকাশ পায় না বললেই চলে। বাল্যের পড়াশোনাই(ইংরেজি অথবা বাংলা মাধ্যম) দম্ভ প্রকাশের দক্ষতা তিলে তিলে তৈরি করে দেয় (একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। আজও ভারতীয় সিনেমার অন্যতম দিক ফলক মৃগয়া। আথচ ছো নাচে মাদল বাজে। থাকে না বিন্দুমাত্র ছো নাচের শাস্ত্রীয়তার ব্যকরণ। একজনও বিশেষজ্ঞ এই তুচ্ছ দেশী বিষয়ে বিন্দুমাত্র অসূয়া প্রকাশ করেন না(বোধহয় জানেনও না)। আজও মৃগয়া নিয়ে শহুরে আদিখ্যতা শেষ হয় নি। আর মনের মানুষ নিয়ে যত কম কথা বলাযায় তত ভাল)।
নারীবেশী, পুরুষ অভিনেতাদের বিষয়ে তৈরি সিনেমার পরিচালক আরও প্রগতিশীল - এমন এক ছাপ্পা পেয়ে সামাজিকভাবে অন্যান্য শহুরে ছাপ্পায় কুসংস্কারগুলো নিয়ে ছবি করার পিঠচাপড়ানি এবং বিনিয়োগ লাভ করেন। অসামান্য ব্রিটিশ উচ্চারণে ভারতীয় (গ্রাম)সমাজ কত পিছিয়ে পড়া, এই তত্ব পরিস্কার বুঝিয়ে ছাড়েন। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উত্সবে সিনেমায় তিনি গুরুঠাকুর জুরির মর্যাদা পান। বাঙলা সিনেমা পথ ভাঙা কাজ করেছে, এই চিন্তায় কলকাত্তাই মধ্যবিত্ত আহ্লাদে ডগমগ - অনুগামীরা আনন্দে উদ্বাহু।
মাত্র হাজার দেড়-দুয়েক বছরের সভ্যতায় আজও পশ্চিমের নারীরা লড়াই করছেন অধিকারের জন্য। গ্রামীণ ভারতীয় সমাজে মহিলারা নানান বিধিনিষেধ মান্য করেই অসম্ভব নিজস্বতা বজায় রাখেন। তাঁত চালান, চাষ করেন, সংস্কৃতির নানান দিক ধরে রাখেন অসামান্য ঋজুতায়। কৌম স্মৃতিতে ধরা থাকে সামাজিক ইতিহাস। ভারতের পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চা গ্রামীন মহিলাদের কোনও দক্ষতা স্বীকার করে না। অথচ বহু সমাজে আজও নারীরা চালিকা শক্তি। বুননে, চাষে, শিল্প উত্পাদনে, সংসার পরিচালনায় নারীদের দক্ষতা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবুও শহুরেরা মনেকরে সমাজের কোন স্তর কেন্দ্রীয় ক্ষমতার কত কাছাকাছি, তাই দিয়ে সেই স্তরের সামজিক অবস্থান বিচার হয়, দক্ষতা নির্ণয় হয়। হয়ত সেই জন্যই গ্রামীণদের বর্ণনা করতে প্রান্তিক, দলিত, পিছড়ে বর্গ ইত্যাদিসব অশ্লীল অভিধা তৈরি হয় জ্ঞাণচর্চায়।
শহুরেরা অধিকাংশই গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। গ্রামের বাস্তবতা ভুলেছি। ঠিক যেমন ভুলে ছিলেন বিদ্যাসাগর, রামমোহনসহ অগুন্তি প্রায় সব আলকপ্রাপ্তরাই। তাদের পথ ধরে সহজ স্বাভাবিক গ্রামীণ প্রকাশভঙ্গী ভুলেছি অসামান্য শহুরে সভ্যতার মোড়কে। কেউ কেউ দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেই দেখাকে গ্রামীণ দর্শণে বোঝার চেষ্টা করিনা। ঠেকায় পড়ে কিছুখানি স্বীকার করলেও তাকে পশ্চিমি আধুনিকতার ছোঁয়ায় কোনও না কোনও একটা মোড়ক দিতে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ি। একই ঘটনা নারী বেশী পুরুষ অভিনেতা সাবজেক্টদের জীবন আলোচনায়ো ঘটেছে। তার সঙ্গে ক্যামারা বা কলম বাগিয়ে মাত্র তিন চার দিন কাটিয়েই পশ্চিমি বয়ানে সামাজিক এই কুসংস্কারটি ডকু করে বিভিন্ন ফোরামে ছুঁড়ে সাংস্কৃতিক মসিহার মর্যাদা অর্জন করেছেন নানান গবেষক। কেউ আখের গুছিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার নামি-অনামিসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ব বিভাগে অধ্যাপনার সম্মান(আদতে আরও সাংস্কৃতিক চাটুকারিতা) অর্জন করেছেন, কেউবা গবেষণা, অথবা লাখোইয়েন-পাউন্ড-ডলারের সাংস্কৃতিক প্রজেক্ট বাগিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আমার এই কাজ এই প্রথমবার আপনাদের সামনে এল, এই তথ্যে সব্বাইকে রাঙিয়ে, এগিয়ে থাকা ইওরোপের(আরআমেরিকার) দেশগুলির তুলনায় ভারত কত পিছিয়ে তার বয়ান বিবৃত করার কাজ করেছেন।
অথচ পুরুষ শঙ্কর, রাতের পর রাত, খন নাটকে স্ত্রী বেশে অভিনয় করে চলে। সমাজ তাকে শহুরেদের দৃষ্টিতে দেখে না। তার দাদা, বাবা অথবা মা কেউই অনুযোগ করে না, কেন মহিলা চরিত্রে আভিনয় করে সে তাদের সামাজিক সুনামে সে কলঙ্ক লেপন করছে। না, তথাকথিত পিছিয়েপড়া, কুস্কারগ্রস্ত গ্রামবাংলার সমাজ তাকে একঘরে করে রাখে নি। শহুরে ভাষায় নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াইও করতে হয় নি। উত্তর দিনাজপুরের ফতেপুর এলাকায় তার মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে বিন্দুমাত্রও কষ্টতো হয়ই নি বরং সে অসামান্য এক সামাজিক মর্যাদা প্রতিদিন সে এনজয় করে। তাই শঙ্করকে নিয়ে সিনেমা হয় না, গল্পও অসম্ভব।
সম্প্রতি তার বিয়ে হয়েছে। সে এক ছোট্ট সুন্দর বউ ঘরে এনেছে(এই দম্পতির বয়স পশ্চিম প্রভাবিত বুদ্ধিজীবিদের তৈরি সংবিধান অনুমোদিত না হলেও হাজার হাজার বছরের পরম্পরা বাজার রাখা বাঙলার সমাজ অনুমোদিততো বটেই)। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মাঝেমধ্যে বড্ড আহ্লাদ করে শঙ্করের অভিনয় দেখতে এসে আনন্দে লুটোপুটি খায়। নাটকে তার তথাকথিত অশ্লীল বাক্যবাণে আঁচলের তলায় মুখ লুকোয় না অথবা শঙ্করকে বলে না নাটকে তার অশ্লীল বাচন সমাজকে দূষিত করছে। অভিনয়ে শঙ্কর যখন শাড়ি তুলে অসম্ভব যৌনআবেদনময় কমনীয় উরুতট প্রকাশ করে পটু হাতে, তার এলাকায় তৈরি সোনালী পাটের সুতো তক্তিতে পাকায় অসম্ভব সামাজিক লাস্যে, যখন পর-পুরুষের সঙ্গে হাতের চুড়ির রিনিঝিনি তুলে ফস্টিনস্টি করে গায়ে গা ঠেকনা লাগিয়ে, যখন বুকের আঁচল সরিয়ে একটি নকল সোনালী গোলার্ধ খুলে স্বামীর বন্ধুকে হাল্কা করে যৌনতার প্রলোভন দেখায় রাজবংশী ছড়ায়, যখন অসামান্য পুরুষালি মহিলা গলায় ও মা... বলে লাস্যের ঢং করে তখন নাটক দেখতে জড়ো হওয়া পুরুষদের শ্বাস ঘন হয়ে আসে, কারোর কারোর দীর্ঘশ্বাস পড়ে, কারোর প্রাণ হয়ত আকুলিবিকুলি করে একটিবার অন্তত শঙ্করের হাত ধরতে, পাশে দাঁড়াতে, হয়ত নিষিদ্ধস্থানগুলো ছুঁয়ে দেখতে। আবার যখন মায়ের ভুমিকা অথবা অন্য অভিঘাতের হালুয়া-হালুয়ানিতে বোকা হালুয়ার চালাক স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করে তখনও তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর হৃদয় আকুলিবিকুলি করে কেঁদে বা হেসে ওঠে খলবলিয়ে। সে যৌনতা পারিবেশন করে না, নারী চরিত্র উপস্থাপন করে মাত্র।
মঞ্চে উঠলেই শঙ্কর যেন রূপান্তরিত হয়ে যায় অপার্থিব কিন্তু বাস্তবের রেণুগুলোয় ঢালা এক মায়াময় বাঙালি নারীর ভুমিকায়- যার পরিবার নেই, যার স্ত্রী নেই, যার সংসার নেই, যার রোজ দোকানে বসার দায় নেই, যার বাইকে চড়ে ঘোরার আকাঙ্খা নেই, যার মোবাইলে নতুন ধরণের গান বাজাবার ইচ্ছে নেই –শুধু রয়েছে ভারতীয় সভ্যতার এই অসামান্য দানের প্রতি অসামান্য আনুগত্য প্রদর্শণের নিবেদন। হাজার হাজার বছরের স্বীকৃত গ্রামীণ এই পরম্পরাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আর সামনে বসে থাকা আকুলিবিকুলি অগুন্তি দর্শককে জীবনের মধুর স্বাদ দেওয়ার দায়। সে এই কাজ সজ্ঞাণে মাথায় তুলে নেয়।
আমরা ভুলে যাই বাঙলার অথবা অধিকাংশ ভারতীয় সমাজেই নারীর যৌনতা কোনও দিনই আলাদা চর্চার বিষয় ছিল না - আদতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ। আজও। বাঙলার পোড়ামাটি, মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো অথবা কোণার্কএর মন্দির অলঙ্করণে রতিচিত্র, কালিদাসের কাব্যে শিবপার্বতীর বিপরীত রতিতুরাম বর্ণনা অথবা কুচযুগলশোভিত মুকুতা হারের প্রার্থনাসম্বলিত স্ত্রোত্র অথবা নানান গ্রামীণ কাব্যে সহজ স্বাভাবিকভাকে দেহবল্লরী বর্ণনা অথবা মৈথুন ভঙ্গীমা অতীতে প্রকাশিত হয়েছে, আজও হয়। মধ্যবিত্ত শহুরেরা ভিক্টোরিয় সংস্কৃতিতে আবাল্য জারিত থেকে যেগুলিকে গালাগালি ভেবে এসেছে, আজও গ্রামীণ সমাজ সেই শব্দবন্ধগুলো, সেই সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গীগুলো অসামান্য স্বাভাবিকতায় দৈনন্দিন ব্যবহার করে বহন করে নিয়ে চলে। তাই গ্রাম গ্রামই আছে, শহর হয় নি।
স্ত্রীবেশী পুরুষ শঙ্করই ১০ দিন ধরে অপার্থিব দক্ষতায় মেলা সঞ্চালন করে তার স্বেচ্ছাসেবক বন্ধুদের সঙ্গে মেলাস্থান ঝাঁটা নিয়ে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে, মেলায় উদ্ধত যুবক সাইকেল চড়ে ঢুকে এসে স্বাভাবিকভাবেখবরদারি করে (কেউ বলার সাহস রাখে না তুই মেয়ের ভুমিকায় আভিনয় করিস, আমাকে কিছু তোর বলার অধিকার নেই), গ্রামের বাইরে থেকে আসা শিল্পী বন্ধুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দোকান সাজায়-তোলে, আমন্ত্রিতসব্বাইকে খেতে দেয়, মেলায় কাজ ছাড়াও বাড়িতে গিয়ে দোকান দেয়, চাষ করে, হাট করে, বাড়ির কাজ করে, রুগ্ন মায়ের সেবা করে। সব কিছুই এত্ত স্বাভাবিক, এত্ত সামাজিক যে তাকে নিয়ে নতুন করে গল্পলেখা খুবই কষ্টকর।
গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এত্ত স্বাভাবিক এই ঘটনা শহুরে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। গ্রাম কত্ত পিছিয়ে পড়া তাই নিয়ে পরিশিলীত নাটক নভেল প্রবন্ধ লেখা হয়, রাজনৈতিক দল তৈরি হয়, এনজিওরা কোটি কোটি টাকায় মহিলাদের ক্ষমতায়ণের নামে করে-কম্মে খায়, টিভিতে মুখ দেখিয়ে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়, অর্থনীতিবিদ-সমাজতাত্বিকেরা ভারি ভারি প্রবন্ধ লিখে বিশ্ববন্দিতসব প্রাইজ কুড়োন, সমাজ সংস্কারের নামে, গ্রাম সমাজকে আরও ইওরোপিয়-আমেরিকিয় করে গড়ে তুলতে উঠতি যুবক যুবতীরা নতুন করে সাগর পারের সমাজ পরিবর্তনের তত্বে দীক্ষিত হয়।
এই মেলার সাত দিনে দেখলাম শঙ্করের বড় বন্ধু হয়ে উঠছেন মেলায় আসা গ্রামের শিল্পী দিদিরা। আমার সঙ্গে শঙ্করের যত বন্ধুত্ব, ঠিক তত বন্ধুত্ব বাতাসীদি অথবা আরতিদি আথবা দিল্লিদির সঙ্গে। আদতে আজও গ্রামের মেয়েরাই ভারাতীয় সংস্কৃতির প্রায় সবকিছু বয়ে নিয়ে চলেছেন। অসম্ভব মরমী স্বর-এ তারা শোনে শঙ্করের জীবন কথা। সে আক্ষেপে বলছিল তার মৃত বড় দাদার কথা। শঙ্করেরা তিন ভাই। ১০-১২ বিঘা সম্পত্তি, একটা দোকান, বাবা মা, বড় ভাই, বৌদিদি তাদের বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ভরা সংসার। সে তার এলাকায় প্রায় তারকার মর্যাদা অর্জন করেছে নিজস্ব দক্ষতায়। শঙ্কর জানে বোঝে এক জীবনে একজনের এর থেকে বেশি আর কী চাই! আমাদের জীবন খুব সুন্দরভাবে চলছিল। আমাকে নিয়ে পরিবারের সব্বাই আর পরিবারের সব্বাইকে নিয়ে আমি ভীষণ সুখী ছিলাম।
সময়মত বড় দাদার বিয়ে হল। বৌদি সংসারের সঙ্গে মিশে গেলেন। আমাদের সংসার যেমন ভাবে চলছিন তেমনিই চলতে লাগল। কিন্তু হঠাত দাদার মনে হতে লাগল বাড়ির চাষের, দোকানের রোজগারের তার পোষাচ্ছে না। আমি জানি দাদার এই মন বদলে বৌদির হাত ছিল না। দাদা পাশের ইটভাটায় কাজ নিল ট্রাক্টর চালানোর। বৌদি না চাইলেও উদয়াস্ত খাটুনি যে দাদার পোষাচ্ছে না বোঝা যাচ্ছিল তার স্বাভাবের পরিবরতনে। চাষের কাজে আনন্দ আছে, মেসিনের কাজে দুঃখ। দিনের শেষে ধুলিধুসরিত শরীর নিংড়ে অর্জিত অর্থ নিয়ে বাড়ি ঢোকা। বাড়িতে থেকেও যেন দিন দিন অচেনা হয়ে ওঠে দাদা। ট্রাক্টরের সঙ্গে থাকতে থাকতে দাদা মেসিন হয়ে যায় যেন। হঠাত একদিন ট্রাক্টরের পেছনে দাঁড়ানো দাদাকে অন্য ট্রাক্টরে পিষে দিল। হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে দেয়নি। তার আগেই শেষ হয়ে গেল জীবন।
বাবা আজ বিছানা শয্যায়। বৌদির দীর্ঘশ্বাস। আমি আর পারি না। শঙ্কর কেঁদে বলে এত টাকার কী দরকারছিল! আমরাতো বেশ সুখে ছিলাম। কেন যে দাদার অত টাকার দরকার হল আজও বুঝিনি। টাকাই দাদাকে মেরে ফেলল। কে উত্তর দেবে! মেলায় দোকান দিতে আসা শিল্পী মেয়েরা মুখে কাপড় দিয়ে কেঁদে ওঠে।
নারীবেশের পুরুষত্ব নয়, শঙ্করের পরিবারের জীবনকে ছারখার করেদিল আরও বেশি আরও বেশি চাওয়ার উন্নয়ণ তত্ব। এ নিয়ে কোনও গল্প লেখা হবে না, কোনও হাহুতাশ হবে না। মেশিন আর আরও চাওয়ার দর্শনেরউন্নয়ণ তত্ত্ব যে আধুনিকতার শহুরে চিহ্নবাহী। সেই তত্বে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারোর নেই।
তবুও মঞ্চে নারীর বেশ ধরা শঙ্করেরা গ্রামেই সুস্থভাবে বেঁচে থাকে। রাতের পর রাত জমিয়ে অভিনয় করে। অসামান্য লাস্যে, অদম্য উতসাহে গ্রাম-ভারত সভ্যতার প্রবাহমানতা বয়ে নিয়ে যায় নিজেরমত করে। গ্রামীণ এই সভ্যতার অন্যতম ধারকবাহক তারমত অভিনেতারা। তার দ্বায়িত্ব বোধহয় সে বোঝে। জানেও। এই বোধই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মঞ্চে মঞ্চে রাতের পর রাত। দাদার মৃত্যুর পর সে বোঝে উন্নয়ণ আসলে মৃত্যুই ডেকে আনে। কেউ শরীরে মরে কেউবা মনে।
শঙ্করেরা তাদের চোখ দিয়ে দেখে সেই উন্নয়ণ যজ্ঞথেকে গ্রামীণদের চোখ ফেরাবার চেষ্টাকরে নিজেদেরমত করেই। খন আর তার অভিনয় প্রকাশভঙ্গী হয়েওঠে আরও ধারালো আরও মায়াময়, জীবনের বড্ড কাছাকাছি। সংস্কৃতি যে জীবনেরই প্রকাশভঙ্গী। আরও বেশী করে জীবন আঁকড়ে ধরার কাজ সে করে চলে।
No comments:
Post a Comment